আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৭)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

প্রথমেই একটা কথা বলে নেই, এই লেখার জন্য কেউ আমাকে বরাত দেয়নি। আমি কোনও লেখক নই। নিজের দেখা, শোনা এবং জ্ঞান বুদ্ধি মতে যা সঠিক মনে হয়, সেই কথাই লিখে যাই। এই লেখা পড়ে একজনের চিন্তাভাবনাও যদি প্রভাবিত হয়, সেটাই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

প্রদীপের নীচের অন্ধকার: আমাদের সব থেকে প্রিয় সম্পর্ক গুলির মধ্যে মা অন্যতম। তাই আমরা দেশ কে মা মনে করি, নিজের ভাষাকে মাতৃভাষা বলি, যে মাটি আমাদের অন্ন জোগায়, তাকে মায়ের মতো যত্ন করি। কিন্তু এই ধারণা প্রবল ধাক্কা খায় আমার প্রিয় মেটিয়াবুরুজে এসে। যে মেটিয়াবুরুজ কয়েক হাজার মানুষের মুখে অন্ন জোগায়, সেই জন্মভূমি বা কর্মভূমি, যে নামেই ডাকা হোক, তার ভালো মন্দের সাথে অঞ্চলের মানুষের যেন একটা বিচ্ছিন্নতা আমার চোখে পড়েছে। মনে হয়েছে যেন “ভাগের মা গঙ্গা পায় না” প্রবচনটা মেটিয়াবুরুজের জন্য একশ শতাংশ সত্যি। কেন? আসুন সেই কথাই আজ আলোচনা করা যাক।
আপনি বাইরে থেকে জীবনে প্রথমবার মেটিয়াবুরুজ এসেছেন। খিদিরপুর, রামনগর, সন্তোষপুর, অথবা অন্য যে কোনও দিক থেকেই আসুন না কেন, প্রথমেই আপনার নজরে পড়বে ভাঙাচোরা, সরু রাস্তা। তার অনেকটাই আবার ফুটপাতের দোকানদারেরা দখল করে রেখেছে। আর তার ফাঁক ফোকর দিয়ে বাইক, ট্যাক্সি, বাস, ভ্যান রিকশা, অটো, মানুষ, সকলেই যেন রেস লাগিয়েছে। কে কার আগে যাবে, তার প্রতিযোগিতা চলেছে। বিনা যুদ্ধে কেউ সূচাগ্র রাস্তাও ছাড়তে রাজি নয়। ফল? অনিবার্য জ্যাম। সেই জ্যামে অ্যাম্বুলেন্স হোক আর নবাব ওয়াজিদ আলী শাহ, সকলেই অপেক্ষায়। কখন একটু এগোনোর চান্স পাওয়া যাবে। মেটিয়াবুরুজ থানার সামনে দু’চার জন ট্রাফিক পুলিশের দেখা মিললেই মিলতে পারে। বাকি পথে আপনার ভরসা একমাত্র উপরওয়ালা।

এই জ্যাম পুরো জ্যাম জমাট হয়ে জমে ক্ষীর হয়ে যায় শনিবার এবং রবিবার। জব্বার হাট, ABM হাট, কোয়ালিটি হাটকে কেন্দ্র করে রেডিমেড গারমেন্টসের যে পাইকারি বাজার বসে, তাতে কেনাকাটা করতে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা। এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকেই আসেন সওদা করতে। ফলে মেটিয়াবুরুজের এই জ্যামের কারণে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সকলকেই।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা আপনার নজরে আসবেই তা হচ্ছে বাইক এবং বাইকের আরোহী। এই দেশে পাওয়া যায় যে সব লেটেস্ট মডেলের বাইক, তার সবই আপনি পাবেন মেটিয়াবুরুজে। সেই সব বাইকের যা দাম, তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে একটা ভালো কন্ডিশনের চার চাকা কেনা যাবে। কিন্তু যেটা দেখবেন না, সেটা হচ্ছে হেলমেট। মেটিয়াবুরুজে আপনি স্বচ্ছন্দে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারেন। একজন বাইক আরোহীর মাথায় হেলমেট দেখাতে পারলে প্রথম পুরস্কার এক লক্ষ টাকা। আমি নিশ্চিত, আপনার পুরস্কারের টাকা আপনার পকেটেই থাকবে।

তৃতীয় আর একটা বিষয়, যেটা একাধারে উদ্বেগজনক এবং চূড়ান্ত বিপদজনক, সেটা হচ্ছে বাইক আরোহীদের বয়স। এই অঞ্চলে আপনি দেখবেন অজস্র বাইক আরোহী, যাদের গড় বয়স ১২-১৪ বছর। স্বাভাবিক ভাবেই গতির ওপরে নিয়ন্ত্রণ, সঠিক ভাবে ড্রাইভিং, এসব এদের কাছে আউট অফ সিলেবাস। এরা যখন কাউকে ধাক্কা মারবে, তখন বহু ক্ষেত্রেই এদের অভিভাবক এদের হয়ে লড়তে চলে আসবে।

নেই, নেই, প্রতিকারের চেষ্টা এক্কেবারেই নেই। না এলাকার মানুষের, না সরকারের। গোটা এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেও আপনি একখানা হোর্ডিংও পাবেনা, যেখানে হেলমেট পরার প্রচার দেখতে পাবেন। এলাকার থানাগুলিতে সার্ভে করে দেখুন বছরে ক’খানা বিনা হেলমেট পরা অথবা ওভার স্পিডিংয়ের কেস হয়। দেখতে পাবেন সংখ্যাটা শূন্যের খুব কাছাকাছি।

আপনি যদি সাধারণ কোনও হিন্দু বাঙালির সাথে মুসলিম কমিউনিটি সম্পর্কে আলোচনা করতে যান, যে অভিযোগের তালিকার একেবারে ওপরের দিকে থাকবে বিনা হেলমেটে বাইক চালানো এবং সেই সম্পর্কে পুলিশি নিস্ক্রিয়তা। আমার খুব কাছের একজন মানুষ, মানসিক ভাবে যথেষ্ট উদার, আমার এই লেখা প্রসঙ্গে তারও অভিযোগ এই একটাই। আচ্ছা, কখনো কি আপনাদের মনে হয় না বিনা হেলমেটে বাইক চালানোর ক্ষেত্রে এই “বিশেষ পুলিশি ডিসকাউন্ট” আদতে গোটা কমিউনিটিকেই দায়ী করে তুলছে? হিন্দুত্ব বাদীদের হাতে বাড়তি অস্ত্র জোগান দিচ্ছে? আমাকে পাঁচটা গালাগাল দিতেই পারেন। কিন্তু অনুরোধ করছি, ভাবুন, গভীর ভাবে ভেবে দেখুন।

এই প্রসঙ্গে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। প্রাইভেট টিউশন করবার জন্য বছর চার আগেও আমাকে নিয়মিত পার্ক সার্কাস অঞ্চলে যেতে হতো। ডালহৌসি থেকে ২৪A/১ বাস ধরে গিয়ে নামতাম পার্ক সার্কাস লোহা পুলের আগে। CIT রোড যেখানে পার্ক সার্কাসে এসে মিশেছে, সেখানে ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকানে অসাধারণ রসগোল্লা পাওয়া যায়। আর তার পাশেই একটা দোকানে দুর্দান্ত কাবাব বানায়। এই দুইয়ের অমোঘ টানে এক স্টপেজ আগে নেমে কিঞ্চিৎ উদরপূর্তি করবার পরেই নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটা লাগাতাম।

ক্রমে এই ক্রসিংয়ে মাঝেমাঝে ডিউটি করা এক ট্রাফিক সার্জেন্টের কাজকর্ম দেখে নিয়মিত তাঁকে দেখতে পেলেই অপেক্ষা করতাম। হাতে একটা ওয়াকিটকি, আর সঙ্গী একজন কনস্টেবল। এই নিয়েই এলাকার বিনা হেলমেটের বাইক রাইডারদের যম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রলোক। যেই দূর থেকে কাউকে বিনা হেলমেটে আসতে দেখতেন, ওয়াকিটকিতে সিগনাল লাল করবার আদেশ দিয়েই পাকড়াও করতেন সেই হিরোকে। কনস্টেবল বাইকের চাবি খুলে নিতেন। আর উনি লাইসেন্স জমা দিতে বলতেন। কোনও ওজর আপত্তি, অজুহাত কিছুতেই দমতে দেখিনি ওঁকে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন পুলিশ চাইলে সাত দিনে এমন ব্যবস্থা করা যায়, যাতে বিনা হেলমেটে কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার কথা ভাববেও না।
পুলিশ চায় না, কারণ সরকার চায় না। কিন্তু এলাকার মানুষ? তারা কেন চায় না? উত্তর জানা নেই।

এলাকার সমস্ত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ, এলাকার সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে আবেদন, বিষয়টা নিয়ে আপনারা ভাবুন। প্রশাসনকে বাধ্য করুন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। এলাকার বদনাম মানে আপনারও বদনাম, আপনার কমিউনিটির বদনাম। আসুন আমরা সকলে মিলেই এই সমস্যার মোকাবিলা করতে উদ্যোগ নেই বরং।

আজ এখানেই ইতি টানি। তবে “প্রদীপের নীচে অন্ধকার” এই পর্ব আর এক বা দুই দিন লাগবে শেষ করতে।

পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৬)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৮) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum