আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৮)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

আবারও কিছু অপ্রীতিকর কথা আসবে। মানা অথবা না মানা, আপনার মর্জি। যুক্তি সংগত আলোচনা হোক।

প্রদীপের নীচে অন্ধকার: এর আগের পর্বে “প্রদীপের নীচে অন্ধকার”-এ তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি অসংগতির কয়েকটা কথা। তাতে মূলত রয়েছে রাস্তা দখল করে দোকানদারী, জ্যাম এবং বেপরোয়া বাইকিং নিয়ে। রাস্তা দখল করে ব্যবসা করা, জ্যাম ইত্যাদি যেমন খুব কমন ব্যাপার, তেমনই তার ব্যতিক্রমও আছে। মেটিয়াবুরুজ থানা থেকে আপনি যদি আব্দুল খাবির রোড ধরে রাজাবাগানের দিকে যেতে থাকেন, রাস্তার কোথাও কোনও এনক্রোচমেন্ট নেই। রাস্তা তুলনামূলক ভাবে পরিস্কার এবং অনেকাংশেই শান্ত। সুতরাং এলাকার মানুষ যদি চায়, তবে সবই সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সচেতনতার।

এবারে আসি অন্ধকারের কথায়। সুমন বড়াল আর আমি একদিন উবার ধরে ফিরছিলাম। ক্যাব ড্রাইভার বিহারি। শুরু থেকেই তাঁর অসহিষ্ণুতা চোখে পড়ার মতো ছিলো। ভদ্রলোকের (?) মূলত দুটো অভিযোগ। মোল্লারা ভারি খারাপ জাত। নিয়ম মানে না, মাস্ক পরে না, নোংরা থাকে, নোংরা করে রাখে। একে তিনি মাস্ক পরা, তায় প্রথমেই হিন্দিতে বলা, দুইয়ে মিলে ধৈর্যের বাঁধ এক সময় ভেঙে গেলো। বারংবার একই কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে বলুন।
বুঝলাম তিনি বাংলা বেশ ভালোই বোঝেন। তবে হিন্দি বলার মধ্যে তাঁর ঔদ্ধত্য বেশি করে প্রকাশ পাচ্ছিল। এখন আমি পয়দাইশ ছোটলোক। এটা আমার কাছের সকলেই জানেন। আমিও খুব ঠাণ্ডা গলায় তাকে বললাম, “সাগরের মেলায় যখন কাতারে কাতারে বিহারি এসে কোলকাতা নোংরা করে দিয়ে যায়, তার বদলা হিসেবে কি সব বিহারি কে খিস্তি করা হয়? এই যে আপনি বাংলার খেয়ে, বাংলা থেকে কামিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আর বাংলাকেই গালাগাল দিচ্ছেন, বাংলা দিব্বি বুঝলেও, বাংলা বোঝেন না বলে দাবী করছেন, এতে কি একবারও আপনাকে আমি জাত তুলে গালাগাল দিয়েছি? যদিও দেওয়াই উচিত। তবুও আমার শিক্ষা আমাকে সেই কাজ করতে দেয়নি। অথচ আপনি অনায়াসেই এক দুজনের ভুলের দরুন গোটা একটা কমিউনিটিকে বদনাম করছেন কতো সহজে। এটা আপনার এবং আমার শিক্ষার তফাত।”
কিন্তু যে দুটো বিষয় ওই ক্যাব ড্রাইভারের বক্তব্য থেকে উঠে এসেছে, সেই অপরিচ্ছন্ন শহর অথবা মাস্ক না পরা, এই দুটো অভিযোগ কি মিথ্যে? আপনি নিজেও জানেন, অভিযোগ মিথ্যে নয়।

এবারে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করে দ্বিতীয় পয়েন্টে আসা যাক। সারা রাজ্য জুড়ে যখন ভ্যাক্সিনের জন্য হাহাকার, আমাদের বাড়ির কারোরই তখনও ভ্যাক্সিনেশন হয়নি। সরকারি হাসপাতালে ভ্যাক্সিন নিতে গেলে লম্বা লাইন। আমার ৭৬ বছরের মায়ের পক্ষে সেই অপেক্ষা করা খুব চাপের। আবার তিনজনের বেসরকারি হাসপাতালের ভ্যাক্সিন বাবদ বিল মেটানো সরকারের দেওয়া গোনাগুনতি টাকার বাজেটে যথেষ্টই বেশি। কথা প্রসঙ্গে দুলালকে সে কথা জানানোর পাঁচ মিনিট পরেই ডাক্তার আসিফের ফোন। “দাদা, চারটের মধ্যে চলে এসো আমার সেন্টারে।”
ক্যাব ধরে সেন্টারে পৌঁছানোর পরে দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে আসিফ স্বয়ং। সাকুল্যে মিনিট পঁয়তাল্লিশ খরচা করে ভ্যাক্সিন পর্ব শেষ করে বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় সারি দিয়ে দোকানে গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে। অপরিচ্ছন্ন দোকান, মাংসের গায়ে মাছি বসছে। খোলা ড্রেন। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আমার মা ভালো করেই জানে আমার গো মাংস প্রীতির কথা। মা খুব চিন্তিত হয়েই জানতে চাইলো এভাবে নোংরা পরিবেশে খাওয়ার জিনিস যদি বিক্রি হয়, সেটা খেয়ে তো শরীর খারাপ করতে পারে যে কোনও সময়েই। আমারও মাথায় স্ট্রাইক করলো বিষয়টা।

  • বজবজ ট্রাংক রোডের ওপর ডাকঘর ছেড়ে বজবজের দিকে একটু এগিয়ে গেলে উষা ফ্যাক্টরির ঠিক আগেই বিকট দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে। ওখানে একটা কসাইখানা আছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং রাস্তার দুপাশে নোংরায় ভর্তি।
  • মেটিয়াবুরুজ থানার সামনে থেকে বিচালিঘাট হয়ে খিদিরপুরের দিকে এগোতে থাকলে গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডিং কোম্পানির মেইন গেট পার হয়েই রাস্তার বাঁদিকে একই দুর্গন্ধ এবং গরুর গোশত রাস্তার ধারে খোলামেলাভাবে ঝুলিয়ে বিক্রি হয়।

গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ধারে খোলামেলা ভাবে ঝুলিয়ে গোশত বিক্রি করাটা যথেষ্ট দৃষ্টিকটুই লাগে। এই সব রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী প্রতিটি অমুসলিম এই দৃশ্য দেখার পর একটা বিরূপ ধারণা নিয়ে যায়, এবং কালক্রমে সেই বিরূপ ধারণা বিদ্বেষে পরিণত হয়।
প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে এই কসাইখানাগুলো আধুনিক সুবিধাযুক্ত Slaughter House বানানোই যায়। প্রয়োজন হলে নিকটবর্তী অন্য কোন জায়গায় আধুনিক সুবিধাযুক্ত Slaughter House বানানো কঠিন কিছু না।
এগুলো আসলে জিইয়ে রাখা হয় বিদ্বেষের পটভূমি তৈরির জন্য। খুব সচেতনভাবেই এগুলোর প্রচার হয় তোষণ নাম দিয়ে, অথচ ট্যাগ লাগানো হয় উগ্র, ধর্মান্ধ, বর্বর অশিক্ষিত ইত্যাদি…।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি যদি চায়, এই বদনাম ঘুচতে সময় বেশি লাগবে না। শুধু দরকার সদিচ্ছার। আর আন্তরিকতার।
অথচ সমগ্র রাজ্য সহ গোটা কলকাতায় খাসির মাংসের যতো দোকান রয়েছে, তার প্রায় সিংহভাগের মালিক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। হিন্দুরাও স্বচ্ছন্দে সেইসব দোকান থেকেই কেনাকাটা করেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন খাসির মাংসের প্রতিটি দোকান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। কোথাও ছিঁটেফোঁটাও নোংরা নেই। তবে কেন গোমাংসের দোকানের প্রতি এতো অবহেলা? গরীব মানুষ খায় বলে? উত্তর জানা নেই।

দ্বিতীয় যে পয়েন্টটা উল্লেখ করা দরকার, তার আগে একটু হেজিয়ে নেই। কলকাতার আশেপাশে বহু এলাকা আছে, যেখানে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব। এমনকি অনেক পাড়া আছে, যেখানে এক ক্লাবে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হওয়ায় ক্লাব ভেঙে গড়ে ওঠে নতুন ক্লাব। এখন এই ক্লাবের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কিছু উপকার হয়? হয় না এটা বলাই বাহুল্য।
আভি সিধা মুদ্দে পে আতে হ্যায়। জানি না, আমার মতের সপক্ষে ক’জন মানুষের সমর্থন পাবো। মেটিয়াবুরুজের পথে পথে ঘুরে একটা আশ্চর্য বিষয় নজরে এসেছে। সেটা হচ্ছে মসজিদের সংখ্যা। এক আলোচনায় শুনেছিলাম এই ছোট্ট এলাকায় মসজিদের সংখ্যা ২০০+। মোটামুটি ৮-৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় এতো গুলো মসজিদ কেন? যে ধর্ম মানুষকে শিখিয়েছে অন্নের অপচয় না করতে, দুঃখী, অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়াতে, এতো টাকা ব্যয় করে এতগুলো মসজিদ বানানো কি সেই ধর্মের মানুষের সাজে? আল্লাহ এই দীনদুনিয়ার মালিক। তাঁকে তাঁর বান্দা যে কোনও পরিস্কার পবিত্র জায়গায় ডাকতে পারেন বলেই আমার ধারণা (আমার ভুল জানা হতেই পারে)। বরং সেই অর্থে অনায়াসেই আল আমিন মিশনের মতো কোনও সংস্থা গড়ে তোলা যায়, যেখানে এই অঞ্চলের তথা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মেধাবী অথচ দরিদ্র ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। তাদের পড়াশোনা, থাকা, খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে এই অর্থ ব্যয় করলে উপরওয়ালা দোয়া করবেন বলেই মনে হয়। গড়ে তোলা যেতে পারে চেন্নাইয়ের সাঁইবাবার ভক্তদের গড়ে তোলা হাসপাতালের মডেলে অত্যাধুনিক হাসপাতাল, যেখানে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চিকিৎসার জন্য আসবেন। গরীব মানুষের চিকিৎসা সেখানে বিনামূল্যে করা হবে। আমার মেটিয়াবুরুজের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

পরবর্তী পর্ব আসবে। অনুরোধ, যদি আমার বক্তব্যে সহমত হন, লেখাটা ছড়িয়ে দিন, যাতে আগামী দিনে আমরা জনমত গড়ে তুলতে পারি এইসব সমস্যা দূর করার জন্য।

পরের পর্বের লিঙ্ক এখানে


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৭)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৯) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।