আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৯)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

গত পর্বের লিঙ্ক এখানে

আজ শুরুতে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। মেটিয়াবুরুজ সংক্রান্ত না হলেও আশা করি ভালো লাগবে। বর্ধমানের রাজেশ, মানে রাজেশ মল্লিককে আপনারা অনেকেই চেনেন। রাজেশের খুড়তুতো ভাই কিছুদিন আগে বাইক চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে। প্রাথমিক ভাবে ডাক্তার বাবুরা মনে করেন ফিমার বোন ফ্র্যাকচার। সেই মতো প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। রক্তের প্রয়োজন জানতে পারার পরেই রাজেশ এবং সোলেমান নার্সিং হোমে যায়। দূর্ভাগ্যবশত ছেলেটার কিডনিতে আঘাত লেগেছিল, যেটা তাৎক্ষণিক ভাবে ধরা যায়নি। ফলতঃ, কিডনিতে আঘাতজনিত কারণে ওর ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং ছেলেটি অকালে প্রাণ হারায়।

যেহেতু অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু, তাই পোস্টমর্টেম হওয়ার পরে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে। সুতরাং রাত্রে ডেডবডি মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। মর্গের দায়িত্ব প্রাপ্ত ডোম বাবাজী দরজা খুলে দিয়েই হাওয়া। অগত্যা রাজেশ এবং সোলেমানই ভরসা। রাজেশ মর্গে জাস্ট ঢুকতে যাবে, হঠাৎই সোলেমান তার হাত টেনে ধরে। রাজেশ কারণ জিজ্ঞাসা করলে সোলেমান ওকে কাছে ডেকে নিয়ে বিড়বিড় করে কিছু পাঠ করে ওর মাথায় তিনবার ফুঁ দিয়ে তারপর ওকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে।
কাজ মিটে যাওয়ার পরে রাজেশ সোলেমানকে জিজ্ঞাসা করে, “তুই কি পড়ছিলিস?” সোলেমান ওকে বলে, “আমি কোরানের আয়াত পড়ে দিলাম, যাতে কেউ তোর ক্ষতি করতে না পারে।” রাজেশ সেখ বা আমার অন্য কোনও ভাই যখন আমাদের বাড়ি আসে, মা থাকলে তাদের যাওয়ার সময় বলে “দুর্গা-দুর্গা”। এখন এই কোরানের আয়াত অথবা দুর্গা-দুর্গা বলা কে আপনি যদি ধর্মীয় অ্যাঙ্গেল থেকে দেখেন, তাহলে সেটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কাছে দুটোই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। যে যেমন ভাবে দেখে, সেটা সম্পূর্ণই তার জীবনদর্শন।

আমাদের হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে কিছু অদ্ভুত ধারণা রয়েছে। একটা বড় অংশের হিন্দুদের কাছে মুসলিম মানে “দাড়ি-টুপি-লুঙ্গি”, “টেররিস্ট”, “ধর্মান্ধ”, “আধুনিক শিক্ষার পরিপন্থী” ইত্যাদি। বিভিন্ন সিনেমা, সিরিজ দেখলে এই ধারণা আরও পোক্ত হবে। এমনকি এই মুহুর্তে অন্যতম জনপ্রিয় সিরিজ “ফ্যামিলি ম্যান-২” তে এই বিষের বীজ বপন করা হয়েছে সুনিপুণ ভাবে। সেখানে তামিল টাইগারের লোকেরা “Rebels” আর মুসলিম চরিত্র “Terrorist”।
বাংলার সংস্কৃতির গোড়ার কথা ছিল “ইনক্লুসিভ”। ” দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে” এই মন্ত্রে বাঙালির বেড়ে ওঠা। পাশাপাশি দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। অনেকে লাফিয়ে পড়ে দাঙ্গার ইতিহাস শোনাতে আসবেন। একটা পরিবারের সব সদস্যরা পরস্পরের রক্তের সম্পর্কে বাঁধা থাকলেও তাদের মধ্যে সংঘাত হয়। তার থেকে শিক্ষা নিতে হয়। কিন্তু সংঘাতের ইতিহাসের থেকে ভালোবাসার ইতিহাস দীর্ঘ। আর সেই ইতিহাসের শক্তিও অনেক বেশি। বাংলার মানুষের মধ্যেকার সিমেন্টিং মেটিরিয়াল সেই ভালোবাসার বন্ধন।

মেটিয়াবুরুজ নিয়ে লেখার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হচ্ছে। অভাব উপযুক্ত তথ্যের। তবে চেষ্টার কসুর নেই। টুকরো টুকরো তথ্য যেখান থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে, জুড়ে জুড়ে একটা কোলাজ তৈরি করবার চেষ্টা করছি। তার কোনও টুকরো উজ্বল, রঙিন, আবার কোনও টুকরো রঙচটা, ম্যাড়মেড়ে। তা সেই জোড়াতালি দেওয়ার কাজ চলতে থাকুক। এই অবসরে আসুন বরং আজ আপনাদের একটা গল্প শোনাই।

তাঁর জন্ম ১৯২৬ সালের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের করাচী শহর থেকে দূরে এধি (Edhi) গ্রামে। ভদ্রলোকের নাম আব্দুল সাত্তার এধি। অনেকেই তাঁকে “দয়া কি ফরিস্তা”, “The Reachest Poor”, “Father Teresa of Pakistan”, এমন বহু নামেও ডাকেন। এই মানুষটিরও দাড়ি-টুপি-লুঙ্গি ট্রেডমার্ক। ১৯৫০ সালে করাচীর বন্দর এলাকায় এক অজানা জ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। কোভিড সংক্রমণের ফলে সারা বিশ্বের বর্তমানে যে হাল, তার সাথে অনেকটা মিল পাবেন সেই সময়ের পাকিস্তানের। সেই অজানা জ্বর মহামারীর আকার নেয় দ্রুত। পথে ঘাটে অসুস্থ অসহায় মানুষ পড়ে রয়েছে। এধি দেখেন, ভাবেন কিছু করা দরকার। কিন্তু কিভাবে করবেন? তিনি নিজেই তখন কপর্দকশূন্য অবস্থায় রয়েছেন।
কিন্তু এধি দমে যাওয়ার মানুষ নন। শুরু হলো দোরে দোরে সাহায্য চাওয়া। আর তার সাথে ডাক্তারী পড়ছেন, এমন ছাত্রদের নিয়ে শুরু করে দেন ফ্লু আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার কাজ। প্রথমে ফুটপাতেই বেঞ্চ জড়ো করে এবং তারপর কিছু টাকা হলে আট ফুট বাই আট ফুট একটা ঘরে শুরু হয় চিকিৎসার কাজ। একটা ফ্রি মেডিসিন সেন্টার গড়ে তোলা হয়। এবং ১৯৫৭ সালের মধ্যেই জোড়াতালি দিয়ে একটা হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেন এধি। জন্ম নেয় এঢি ফাউন্ডেশন।
১৯৬৫ সালে ভারত পাক যুদ্ধের সময় এধি ফাউন্ডেশন তাদের প্রথম অ্যাম্বুলেন্স কেনে। যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া সৈনিকদের মরদেহ উদ্ধার করে মৃতদেহ সৎকার করা ছিল এধি ফাউন্ডেশনের অন্যতম কাজ। আজ এধি ফাউন্ডেশনের ১৮০০র বেশি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। কুড়ি হাজারের বেশি বাচ্চার অভিভাবক আবদুল সাত্তার এধি। গোটা পাকিস্তান জুড়ে এধি ফাউন্ডেশন ৩০০র বেশি সেন্টার দক্ষতার সাথে চালাচ্ছে।
শুধু পাকিস্তানেই নয়, এধি ফাউন্ডেশন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। মানুষ যেখানেই বিপন্ন, সে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ কিংবা ঘুর্ণিঝড় “ক্যাটরিনা”য় ক্ষতিগ্রস্ত, এধি ফাউন্ডেশন মানুষের পাশে রয়েছে নীরবে।
পাকিস্তানের মতো দেশে থেকেও আব্দুল সাত্তার এধি ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্ধ্বে মানবতার বার্তাকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তাঁর সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি মোল্লাতন্ত্র। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে মুর্ত প্রতিবাদের নাম আব্দুল সাত্তার এধি। ২০১৬ সালের ১০ই জুলাই কিডনি ফেইলিওরের ফলে ৮৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বড় ছেলে বর্তমানে এধি ফাউন্ডেশনের দায়িত্বভার সামলাচ্ছেন। চার সন্তান এবং স্ত্রী বিলকিস এধি আজও তাঁর মহান ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছেন।

পুরস্কার:
Lenin Peace Prize (1988)
Nishan-e-Imtiaz (1989)
Wolf of Bhogio Peace Award, Italy (2005)
Gandhi Peace Award (2007)
Ahmadiyya Muslim Peace Prize (2010)
UNESCO-Madanjeet Singh Prize.

এছাড়াও একাধিক বার তাঁর নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নমিনেটেড হয়।

সাথে রইলো আব্দুল সাত্তার এধির ওপরে লেখা একটা নিউজ লিংক। https://www.khaleejtimes.com/international/pakistan/angel-of-mercy


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ৮)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১০) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।