প্রাত্যহিক জীবনে পাখির কলকাকলির প্রভাব

লেখক : ড. উৎপল অধিকারী

নিভৃত রাতের মায়াবী নীরবতা ভঙ্গ করে ‘পিউ কাঁহা’, ‘পিউ কাঁহা’ শব্দের সুরঝংকার বর্ষিত হয় পাপিয়ার কন্ঠ থেকে। কাকের কা-কা শব্দ যখন কানে বিষ ঢালে, তখন কোকিলের অখিল প্রিয় সুমধুর গান আমাদের মুগ্ধ করে। ভোর এবং সন্ধ্যায় এমনই অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির ও কলকাকলি মিলে মিশে তৈরি হয় এক অদ্ভুত সিম্ফোনি, যার মায়াজালে আজন্ম মুগ্ধ মানুষ।
সুদূর অতীতে এমনই এক প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়েছিল মানুষ। তখন তার খাবার ছিল বিষমুক্ত, প্রকৃতির জল-হাওয়া ও তার অকৃত্রিম শব্দ শুনতে শুনতে সে বড় হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই সে প্রকৃতিচ্যুত হয়ে পড়ে, ফলে সে নিঃসঙ্গতাবোধ করে, চলে যায় তার মনের প্রশান্তি ও শারীরিক সুস্থতা। শিশুমন কলুষিত হয়, বয়স্ক মন হয় ভারাক্রান্ত। মানুষ আবারও শান্তির খোঁজ করতে লাগল প্রকৃতির মধ্যে, পাখির কলকাকলিতে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন শুনবো পাখির গান? বাস্তব জীবন ও তনু-মনে এর কি কোন প্রভাব আছে?
পৃথিবীতে পাখি এক অপূর্ব সুন্দর প্রাণী। বড়ই বৈচিত্রময় এই জগৎ। পক্ষীবিশারদ মতে পৃথিবীতে প্রায় 10 হাজার প্রজাতির পক্ষীকুলের মধ্যে মাত্র 5,000 প্রজাতি গাইতে পারে। প্রতিটি গানের যেমন সুর, ছন্দ, তাল ও লয় আছে, তেমনিই পাখির গানেও আছে এগুলি। তবে হ্যাঁ, কোনো কন্ঠস্বর হয় সুমধুর, কোনটি বা শ্রুতিকটু। জেনে রাখা ভালো, পাখি কেবল আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য গান শোনায় না বা ডাকাডাকিও করে না। আত্মরক্ষা, প্রজনন, নিজের অঞ্চল সুনির্দিষ্টকরন ইত্যাদির কারণে সে গান গায় বা চিৎকার করে।

বাস্তব ও প্রাত্যহিক জীবনে পাখির ঐকতান শান্তির দ্যুতি ছড়ায়, দেহ মনে আনে প্রশান্তি। মানুষ যখন যান্ত্রিকতায় পিষ্ট হয়ে যায়, তখন বনভূমি বা নিরিবিলি স্থানের প্রাকৃতিক শব্দ তার চাপমুক্তি ঘটায়, মনের হতাশা দূর করে। তাই অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভোর ও সন্ধ্যায় খেলাধুলা বা মুক্ত প্রাঙ্গণে হাটাচলার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই অভ্যাস মনের নেগেটিভ থটস্ দূর করে, পজেটিভ ভাইব্রেশন বৃদ্ধি করে, যা আমাদের সৃজনশীল কর্মে ব্রতী হতে সাহায্য করে। ‘দি সাউন্ড এজেন্সি’র জুলিয়ান ট্রেজারারের মতে পাখির গান শোনার অভ্যাস মানুষের হাজার বছরের পুরানো। এই শব্দ কেবল মানুষকে শারীরিকভাবে সতেজ রাখে তাই নয়, আমাদের বুদ্ধির বিকাশেও সাহায্য করে।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে অবস্থিত জৈবিক ঘড়ির মতন, ডন কোরাস বা ভোরের পাখির গান হল প্রাকৃতিক ঘড়ি। এই হরবোলা আমাদের রাতের অলসতা দূর করে, নতুন দিনের সূচনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। ইংল্যান্ডের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, বিজ্ঞানী ইলিয়ান র্যাপটক্লিফি ‘এনভারমেন্টাল সাইকোলজি’র উপর গবেষণা করে জানান যে, প্রাকৃতিক শব্দ যার অন্যতম পাখির কূজন আমাদের মন-মানসিকতা ভালো করে ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
দুপুরের খাদ্যগ্রহণ বা লাঞ্চের পর শিশু থেকে বয়স্ক প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটা ঘুম ঘুম ভাব তৈরি হয়, যাকে ‘পোস্ট লাঞ্চ ন্যা প’ বলে। এই ন্যা পের জন্য চীন থেকে শুরু করে উন্নত দেশগুলিতে কর্মীদের শয্যার ও নিদ্রার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের লিভারপুলের এক প্রাইমারি স্কুলের কচি-কাঁচাদের ওপর পরীক্ষামুলকভাবে র্যা নডম সাউন্ড হিসাবে পাখির গান শোনানো হয়, এটি করা হয় টিফিনের সময় ও টিফিন ব্রেকের পর। এতে দেখা গেল শিশুদের নিদ্রাচ্ছন্নভাবে কেটে যাচ্ছে ও পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে।
পাখির গানের আরো একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ হলো, সূচ ফোটানো জনিত ব্যথার সাময়িক উপশম ও সার্জিকাল ভীতি ভোলানোর জন্য ইংল্যান্ডের লিভারপুলের এল্ডার হে চিলড্রেন হসপিটালের বারান্দায় সর্বদা পাখির কিচিরমিচির বাজানো হয়। বলা ভালো, কিছুটা বন্যে পরিবেশ তৈরি করা হয় এখানে। এই শব্দ রেকর্ড করেন বন্যরশব্দ রেকর্ডের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব চেরিশ ওয়াটসন। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপে সর্বাপেক্ষা ব্যস্ততম শিশু চিকিৎসালয়ের পরিবেশকে ভয়মুক্ত করা। ওয়াটসন সৃষ্ট এই প্রাকৃতিক শব্দ ‘ভোরের বন্যশ সঙ্গীত’ নামে জনপ্রিয়তা পায়।
বর্তমানে শব্দবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা প্রচন্ড কোলাহলপূর্ণ স্থান, যথা: ট্রান্সপোর্ট হাবগুলিতে বার্ডস কোরাস সহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক শব্দ বাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এই ব্যাপারে অত্যন্ত সফল পদক্ষেপ হল আমস্টার্ডামের সিফল বিমানবন্দরে বার্ড সং বাজানো হয়, এতে যাত্রীরা অত্যন্ত রিলাক্স ফিল করে। এছাড়াও বিমানবন্দরের গাছের কোটরগুলিতে ছোট ছোট সাউন্ড বক্সের সাহায্যে তারা পাখির কিচিরমিচির বাজায়। ফলস্বরূপ, যাত্রী পরিষেবার দিক থেকে শিফল বিমানবন্দর এক উল্লেখযোগ্য নাম। এখানে আসা যাত্রীদের 95% যাত্রী বন্দরের পরিষেবাকে ভালো বা খুব ভালো বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সাউন্ড এক্সপার্ট জুলিয়ান ট্রেজারার সহ প্রায় সব শব্দ বিজ্ঞানীরা বলেন, পাখির গান মানুষের শ্রবণযন্ত্রের শব্দগ্রাহীতা বৃদ্ধি করে ও মনের প্রশান্তি দেয়।
এছাড়াও গ্রাহক পরিষেবা আরো উন্নত করা ও তাদের পজেটিভ ভাইব্রেশন দেওয়ার জন্য বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের ভিতরে বার্ডস্ সং বাজানো হয়, উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার কলোম্বিয়ায়।
শরীর এবং মনের ওপরও পাখির গানের প্রভাব অনস্বীকার্য। আমাদের শরীরের স্বাভাবিক পেইনকিলার হিসাবে কাজ করে বিটা এনডরফিন। মনের মত গান শোনা ও ভোরের পাখির হরবোলা শ্রবণের সময় আমাদের দেহে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এই রাসায়নিক পদার্থটি আমাদের মেজাজ ফুরফুরে রাখতে সাহায্য করে। যেকোনো ব্যথা-বেদনা রাত্রে ঘুমালে বা সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই চলে যায়। এর কারণ আমাদের রক্তের মধ্যে কম বেশি মাত্রায় বিটা এনডরফিন অবস্থিত। কিন্তু যেকোনো ভালোলাগা পরিবেশ আমাদের রক্তে এই রাসায়নিকটির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
নিরিবিলি ও স্বাভাবিক আনন্দময় পরিবেশে, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রক্তে ডোপামিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা চোখে মুখে একটা লাবণ্যের দীপ্তি ছড়ায়। সকাল বা সন্ধ্যার সময় প্রকৃতির মধ্যে ঘোরাফেরা করলে, স্বাভাবিকভাবেই পাখির কলকাকলি আমাদের কানে আসে। এর ফলস্বরূপ আমাদের রক্তে ডোপামিন, ইনসুলিন এবং হিউম্যান গ্রোথ হরমোনের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিক। এর ফলে বাচ্চাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি রক্ষিত হয়, জুভেনাইল ডায়াবেটিস সহ বড়দের ডায়াবেটিস থাকে নিয়ন্ত্রণে, রাত্রে ঘুম হয় স্বাভাবিক। এই কারণের জন্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই চীন, কম্বোডিয়া, জাপান সহ অন্যান্য নানান দেশে স্থানীয় পাখির সুমিষ্ট গান অথবা যেকোন ধীরলয়ের সংগীতকে দীর্ঘক্ষন ধরে স্বল্পশব্দে বাজানো হয়, যা আমাদের ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা দূর করে। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা, ধর্ষণ ইত্যাদির ফলে যে পোস্ট ট্রমাটিক স্টেজ তৈরি হয়, সেটা থেকে টেনে বের করতে বর্তমানে মিউজিক থেরাপির সাথে বার্ডস্ সং বাজানো হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোকিলের ডাক অথবা নাইটেঙ্গেলের গান শোনানোর রেওয়াজ আছে। অটিজম, হাইপারঅ্যাকটিভ শিশুদের শান্ত করতে আলো-আঁধারি এক পরিবেশ সৃষ্টি করে সুন্দরভাবে বন্যশব্দ: যেমন বৃষ্টির শব্দ, পাখির কিচির-মিচির, মৃদুমন্দ বাতাসে পাতা নড়ার শব্দ ইত্যাদি বাজানো হয়। ফলে শিশু আপনা থেকেই শান্ত হয়ে যায়। টেনশন এবং ট্রেসজনিত কারণে যে ইমপোটেন্সি দেখা যায়, স্বাভাবিক এই প্রাকৃতিক শব্দ তা দূর করে এবং সিমেন এর মধ্যে স্পার্ম কাউন্ট বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলো মিউজিক থেরাপি এবং ন্যাচারোপ্যাথিরই একটি বাস্তবিক প্রয়োগ বলেই ধরা হয়।
আজকের যুগের এই যান্ত্রিকতা এবং জটিলতা থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে, স্বাভাবিক বন্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। বেশি বেশি করে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে, কারণ আমরা জানি, গাছ লাগালেই আসবে পাখি, আসবে অন্যান্য প্রাণী- সেই সাথে আসবে মনের শান্তি, প্রাণের আরাম।


লেখক পরিচিতি : ড. উৎপল অধিকারী
সহ:শিক্ষক, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান, পিন 713401

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

2 Comments

  1. অজ্ঞাতনামা কেউ একজন

    খুব ভাল লিখেছ।অনেকের ধারণা পাখির কলকাকলি শুনে শুনেই ঋষিমূনিদের মনে বিভিন্ন সুরের উপলব্ধি হয়েছিল।তাই সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়েছিল মানব সভ্যতার ঊষালঘ্নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।