হাবুকথা: সেলসম্যান

লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী

লকডাউনের বাজার। নাইট কার্ফু। তার মধ্যে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। পুলিসের নজর বাঁচিয়ে আমাদের আড্ডা জমে উঠেছে। ভুতো হঠাৎ বলে উঠল, সিঙ্গারা হলে জমে যেত। কোণার দিকে ধোঁয়ার কুন্ডলীর মধ্যে থেকে হাবু ব্যঙ্গ করে বলে উঠল, জমে যেত! কাজ কম্ম বন্ধ হয়ে শরীরের রক্তটুকু ছাড়া আর সবই তো জমে গেছে।

হাবুর হতাশার কারণ আছে। সবে একটু গাড়ি লাইনে আসতে না আসতেই আবার লকডাউন। এখন ওর আর চলেছেই না। সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আর কয়েকটা দিন কষ্ট কর। তাড়াতাড়িই সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যিই বড়বাজার না খুললে তোর খুবই অসুবিধা।

হাবু গম্ভীরভাবে বলল, বড় বাজার কোনদিন বন্ধ হয় না। চোখের সামনে না হলেও আড়ালে বেচাকেনা চলতেই থাকে।

গম্ভীর গলায় দার্শনিক ষ্টাইলে কথা বলা মানেই ব্যাটার নেশা ধরেছে। দুলতে দুলতে বলল, বড়বাজারের কথাই যখন বললি তখন তোদের একটা গল্প শোনাই। পাকড়াশিদার গল্প।

বৃষ্টি বাদলার দিনে গেজেলটা আবার একে কোথা থেকে পাকরাও করল কে জানে! কেলো ফুট কাটল।

হাবু নির্বিকার। গাঁজা ভর্তি বিড়িটায় লম্বা টান দিয়ে সামনে ছুঁড়ে ফেলল। আড়মোড়া দিয়ে বলল, পাকড়াশিকে বুঝতে গেলে তোদের আরও কয়েকটা জন্ম নিতে হবে। গল্পটা শোন কাজে লাগবে।

হাবু মুডে আছে। এখন ওকে রাগালে আর গল্প বলবে না। আড্ডাটাই মাটি হয়ে যাবে। ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বললাম, তোরা থামবি। হাবুর দিকে ফিরে বললাম, আপনি বলুন স্যার।

স্যা-অ্যা-র। ঠিক বলেছিস। আমিও ঐ নামেই ডাকতাম লোকটাকে।

কোন লোকটা? কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকলাম।

আরে ঐ শিল্পি মালটা। পাকড়াশি।

আবার মুখ খারাপ করছিস!

পাকড়াশির গল্প শুনলে তোরাও তাই বলবি।

তোরা তো জানিসই আমার প্রথম চাকরি ‘সুগন্ধ’ ধুপ কোম্পানিতে। বড় বাজারে অফিস। মানে অফিস-কারখানা সবই এক জায়গায়। একটা বড় গুদাম ঘরের মধ্যে। আমার পোষ্টের একটা গাল ভরা নামও ছিল সেলস একজিকিউটিভ। আসলে ঘুরে ঘুরে ধুপকাঠি বিক্রি করা।

ট্রেনে ধুপকাঠি বিক্রি করা হকারের নাম সেলস একজিকিউটিভ! কেলো চাপা গলায় আওয়াজ দিল।

হাবু না শোনার ভান করে নিজের কথা বলে যেতে লাগল। কাজ যাই হোক, যুতসই একটা নাম দেওয়া দরকার। কেলোর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, আমাদের চারজন ফেরিওয়ালার সুপারভাইজার ছিল পাকড়াশিদা। মার্কেটিং সুপারভাইজার। আসল কাজ ছিল আমাদের পেছনে ডান্ডা করা। ভোকাল টনিক দিয়ে উদ্দীপ্ত করত আরও মাল বেচতে। একটা কথা মুদ্রা দোষের মত বলত – বাঁচতে গেলে বেচতে হবে।

কথা দিয়ে মাল বেচার কায়দা বোঝাত। আমরাও ট্রেনে উঠে উচ্চস্বরে আউড়ে যেতাম – দাদা-দিদি-ভাই-বোনেরা, প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে ধিকি ধিকি জ্বলে গিয়েও আপনারা মানবিকতার সুগন্ধ ছড়িয়ে দেন সমাজের বুকে। ঠিক তেমনি ভাবেই নীরবে জ্বলে গিয়ে আপনার ঘর সুগন্ধে ভরিয়ে দেবে সুগন্ধ কোম্পানির ধুপ। চন্দন, গোলাপ, জুঁই যে গন্ধ পছন্দ নিয়ে যান। এক প্যাকেট …

মাঝে মাঝেই নতুন নতুন অফার নিয়ে আসত পাকড়াশিদা। মাল বেচার হরেক কায়দা জানত। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারলাম না ঐ কোম্পানিতে।

কেন?

একদিন শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠে সবে বলতে শুরু করেছি দাদা-দিদি … জানলার ধারে মুখোমুখি বসা দুটো ছেলে বলে উঠল, ও দাদা এদিকে শুনুন। বেশ আনন্দ নিয়ে এগোলাম। রোজই তো দেখে। একই কথা আর কি শুনবে! নিশ্চয়ই মাল কেনার জন্য ডাকছে।

কত প্যাকেট? কথাটা বলতে যাওয়ার আগেই বাক্যবাণ ধেয়ে এল।

ঢপবাজি আর কতদিন? ধিকি ধিকি জ্বলে সুগন্ধ ছড়াবে? শালা, আমরা তো সারাদিন রগড়ানি খাওয়ার পর নেতিয়ে পড়ি। আপনার ধুপকাঠি তো একটু জ্বলার পরেই কেলিয়ে যায়। একটা গোটা ধুপকাঠি জ্বালাতে যা দেশলাই কাঠি লাগে তার দাম ধুপের থেকে বেশি।

পাশের ছেলেটা আরও উপরে গলা চড়িয়ে বলে চার প্যাকেট ধুপিকাঠির
দাম ফেরত দিন।

আশপাশ থেকে দু’একজন গলা মেলাল। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। বেকার মাল দিয়ে গেছে। একটা কাঠিও ঠিক মত জ্বলে না।

হাওয়া খারাপ। চুপচাপ কেটে পড়াই ভাল। কিন্তু নেতা দুটোকে তো থামাতে হবে। ছেলে দুটোর হাতে চার প্যাকেট ধুপ ধরিয়ে নিচু গলায় বললাম, ঐ লটটায় গন্ডগোল ছিল। ততক্ষণে ট্রেন ষ্টেশনে ঢুকে পড়েছে। এক লাফে প্লাটফর্মে নেমে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

পাকড়াশিদাকে ঘটনাটা বলতেই রেগে গেল।

চার প্যাকেট ধুপকাঠি নষ্ট করলি?

নষ্ট! দাম ফেরত চাইছিল। তার বদলে দিয়েছি। না দিলে নির্ঘাত চড়-চাপটা খেতাম।

দুর! তোদের দিয়ে হবে না। তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বলে সিগারেটে লম্বা টান দিল পাকড়াশিদা। তারপর এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমি থাকলে উল্টে আরও কিছু মাল বেচে আসতাম।

বুঝলাম এই কাজ আমার দ্বারা হবে না। মাল বেচতে গিয়ে ঢপ দিই ঠিক আছে। কিন্তু খারাপ মাল গছিয়ে মার খাওয়ার রিস্ক নিতে পারব না। সেলসের কাজ ছেড়ে দিলাম।

তারপর যোগ দিলি অ্যাকাউন্টসের কাজে তাই তো? একটা ফিচেল হাসি হেসে কথাগুলি বলল ভুতো।

তোরা তো সবই জানিস। ধুপের কোম্পানি ছেড়ে গেলাম সাবান কোম্পানিতে। কোম্পানির প্রোডাক্টের নাম ‘ধবধবে’ ডিটারজেন্ট পাউডার। রোজের খুচরো জমা-খরচের হিসাব রাখার কাজ। কয়েকদিন পরে দেখি সেখানেও হাজির পাকড়াশি।

তুমি এখানে?

তুই কেমন কাজকম্ম করছিস দেখতে এলাম। হাসতে বলল পাকড়াশিদা।

বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, বাজে কথা নয়। কি ধান্দায় এসেছ বলো।

পাকড়াশি পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, আমার হাবুভাইকে ছেড়ে আমি থাকতে পারি! তোর মত আমিও ধুপের ধোঁয়া ছেড়ে সাবানের ফেনায় ভাসলাম। তবে নিজের লাইন ছাড়িনি। আরও উঁচু পোষ্টে জয়েন করলাম। সেলস ম্যানেজার।

কথায় কথায় জানলাম পঞ্চাশ টাকা বেশি মাইনে শুনেই কোম্পানি বদলে ফেলেছে পাকড়াশি।

এই এক গুণ ছিল লোকটার সামান্য বেশি টাকা পেলেই এক কোম্পানি ছেড়ে আরেকটায় যোগ দিত। নিজেই বলত, মার্কেটিং লাইনে এসব খুব চলে। এই কোম্পানি ঐ কোম্পানি যাতায়াত জলভাত। মাল যাই হোক আসল কথা হল নিজেকে ভাল বেচুবাবু হিসাবে প্রমাণ করতে হবে। আমি অবশ্য নক্কা-ছক্কার ঐ খুচরো হিসাবের কাজটা বেশিদিন করিনি। কিন্তু বাজারের সাথে যোগাযোগটা ছিল। নিজেকে ভাল বেচুবাবু প্রমাণ করে পাকড়াশি বছর দুয়েকের মধ্যেই দু’বার ধুপ-সাবানে যাতায়াত করে ফেলল।

দুটো আলাদা কোম্পানির মধ্যে যাতায়াতে কাজের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয় না। কারণ দুটো মালের বাজার আলাদা। বেচার কায়দাও আলাদা। কিন্তু আসল খেলা দেখাল পাকড়াশি কয়েক বছর পর। ধবধবে ডিটারজেন্টের মালিক মারা যেতেই দুই ভাইয়ের মধ্যে লাগল গন্ডগোল। ছোট ভাই আলাদা কোম্পানি খুলল। ঝলমলে ওয়াশ। বাজার ধরতে মার্কেটিংয়ের দায়িত্ব দিল পাকড়াশিকে। এক লাফে বেতন বাড়ল ২০০ টাকা।

টেকো বুড়োর চেহারায় জেল্লা বেড়ে গেছে। রাস্তায় দেখা হতেই সিগারেট খাওয়াল। ফোকটের সিগারেটে টান মেরে বললাম, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে যে মালের গুনগান করতে তাকে এখন খারাপ বলবে কিভাবে?

দুর পাগল। খারাপ বলব কেন! মার্কেটে কান পাতলেই শুনবি – বাপ মারা যাবার পর কোম্পানি চালানো নিয়ে দুই ভাইয়ে ঝামেলা শুরু হল। ছোটভাই চাইল নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে আরও উন্নত মাল বানাতে। বড় ভাই ইনভেস্ট করতে রাজি নয়। ব্যস, ছোট আলাদা হয়ে গেল। নতুন প্রযুক্তির হাত ধরে নতুন কোম্পানি। ঝলমলে ডিটারজেন্ট। দামে কম, মানে ভাল।

এ নিশ্চয়ই তোমার বুদ্ধি। কায়দা করে কথাটা মার্কেটে ছড়িয়ে দিয়েছ।

খ্যাক খ্যাক করে ঘিনঘিনে একটা হাসি দিল ব্যাটা। তারপর ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, চলিরে হাবু। ডিলারদের সাথে একটা আর্জেন্ট মিটিং আছে।

হাঁ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম পাকড়াশির দিকে। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, শালা জাত হারামি।

এলেম আছে বল লোকটার। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাবু লাফিয়ে উঠল, তা আর বলতে। শালা ছয়মাস যেতে না যেতেই আবার পুরোনো কোম্পানিতে।

মানে! আবার ধবধবেতে?

তবে আর বলছি কি! কি বলে এবার মাল বেচবে ভাবতে ভাবতে একদিন চায়ের দোকানে দেখা হয়ে গেল। চেপে ধরলাম, একই মাল তাও আবার একবার ছেড়ে আসা কোম্পানির। বেচতে পারবে?

একই জিনিস মোড়ক বদলিয়ে উল্টে-পাল্টে বেচাতেই তো আনন্দ।

সে তো বুঝলাম। কিন্তু কি বলে বেচবে?

কাছে এসে গলাটা নামিয়ে বলল। তুই আমার কাছের লোক। তাই তোকে বলছি। কথাটা পাঁচ কান করবি না।

বেচব কি রে! অলরেডি মার্কেট ধরে নিয়েছি। সব ডিলাররা জেনে গেছে, কম দামে ভাল মাল দেওয়ার ছক আর বেশিদিন থাকবে না। দাম বাড়বে। তারপর ট্যাক্সের ঝামেলাও আছে। তার থেকে সোজা পথে ব্যবসা করা আমার পুরনো কোম্পানিই ভাল।

ট্যাক্সের ঝামেলাটা কি সত্যি?

একদম সত্যি। তারপর চোখ মেরে বলল, ঐ ঝামেলা সব কোম্পানিতেই আছে।

চায়ের দাম মিটিয়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই পাকড়াশির হাতটা ধরলাম। কয়েকদিন পরে কটা বেশি টাকা পেলেই আবার তুমি ঝলমলে ছেড়ে ধবধবেতে যাবে। তখন আবার কি ঢপ দেবে?

সে দেখা যাবে। তবে একটা কথা বাজারে ঠিক খাইয়ে দেব।

কি কথা?

ভাল মাল যেখানে আমি সেখানে। পাকড়াশি খারাপ মাল বেচে না।

পাকড়াশি চলে গেল। আমি হাঁ হয়ে ভাবতে থাকলাম। নিজেকে বললাম, লোকটার থেকে কিছু শেখো হাবুচন্দ্র। বেচতে না জানলে বাঁচতে পারবে না।

গল্প শেষ। হাবু উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি বললাম, তাহলে সার কথা তোকে শিখিয়েছে বল লোকটা।

শিখতে আর পারলাম কই! ওর মত হারামি হতে পারলে কি আর তোদের সাথে বসে ডালে ডালে দোল খেয়ে বেচার গল্প বলতাম।

কি করতিস?

কত বড় বড় বাজার আছে। সেখানে একই জিনিস উল্টে-পাল্টে দিনের পর দিন বেচে যেতাম। সেজেগুজে লোককে ফেরিওয়ালা হওয়ার মন্ত্র দিতাম। নিজেকে বেচতে শিখলাম না। তাই বাঁচতে গিয়ে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। চলি।

দুলকি চালে হেঁটে চলে গেল হাবু। কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল। বাঁচতে গেলে বেচতে হবে …


লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।