হাবুকথা : ফুলে ফুলে

লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী

গত বছর এপ্রিল থেকে হাবুর সময়টা খুব কষ্টে কেটেছে। লকডাউন শুরু হতেই কাজটা চলে যায়। তারপর সব্জি, দুধ, আরও টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করে কোনওরকমে দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকে। বন্ধুদের সহায়তা আর রাজনৈতিক দলের সাহায্যে চলা সস্তার ক্যান্টিনের দৌলতে দু’বেলার খাবারটা জুটে যেত। পুজোর আগে ঠেকের বন্ধুরা মিলে হাজার দশেক টাকা তুলে দিলাম। তা দিয়ে সস্তার শাড়ি আর জামা কিনে সাইকেল করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি শুরু করে। কিছু টাকা লাভও হয়। কালি পুজোর পরে কাজটা ফিরে পেতেই সব্জি বিক্রির কাজটা বন্ধ করে দিল।

সব্জি বিক্রিটা বন্ধ করলি কেন? দুটো পয়সা বাড়তি আসলে কি ক্ষতি হত?

কেলোর প্রশ্নের উত্তরে হাবু যে জবাবটা দিয়েছিল শুনে আমরা থ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘যারা নিয়মিত বাজারে বসে তাদের বিক্রিতেই তো আমি ভাগ বসিয়েছিলাম। বেঁচে থাকার জন্য ওদের ঐ বেচাকেনাটুকুই সম্বল। এখন আমার হাতে যখন অন্য কাজ আছে তখন ওদের জায়গাটা ছেড়ে দেওয়াই উচিত।’

সহজভাবে বলা কথাগুলো আমাদের হিসেবি মানসিকতার গালে সপাটে এক চড় কষিয়েছিল।

সেদিন অনেকদিন পরে হাবুকে আবার পুরোনো মেজাজে পাওয়া গেল। ফুরফুরে মেজাজে গাঁজায় দম দিয়ে বলল, শালা ভোটের বাজারে শুরুতেই বুড়োদা ক্যালানি খেয়ে গেল!

— বলিস কিরে! বুড়োদা তো কাউন্সিলারের ডান হাত।

— আর বলিস না। সে এক মজার গল্প।

— একটা লোক মার খেয়েছে আর তুই বলছিস মজার গল্প।

দাঁত বের করে হেসে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হাবু বলল, পুরোটা শোন তাহলেই বুঝবি।

বুড়োদা ভোটের আগে আগেই কাউন্সিলরের লেজ ধরে ফুল পাল্টেছে। নিজেকে এখন হনুমানের থেকে কিছু কম ভাবে না। লম্ফঝম্পও বেড়ে গেছে। ‘বুড়ো সাধুর’ নেশা লাগা চোখেই সকাল বেলা চান করে রেডি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বউদিকে হেঁকে বলল – পাঞ্জাবি দাও। আজ ক্যান্ডিডেটকে নিয়ে বড় মিটিং আছে। বউদি রসিক মানুষ। রান্নাঘর থেকে মুচকি হেসে বলে, তোমাদের ক্যান্ডিডেটের পর্দায় ক্যান্ডিড শট বেশ ভাল। কিন্তু ফুল ফুটবে বলে তো মনে হয় না।

তোমার সাথে বাজে বকার সময় নেই। তাড়াতাড়ি দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

খাটের উপর রেখেছি নিয়ে নাও।

বুড়োদা ঘরে ঢুকে দেখে খাটের উপর সাদা, লাল, সবুজ আর হলুদ রঙের চারটে পাঞ্জাবি। লাল পাঞ্জাবিটা এক সময় খুব প্রিয় ছিল বুড়োদার। গত পাঁচ বছরে এক দিনও গায় দেয়নি। এক পাশে সরিয়ে রেখে বিড়বিড় করে, মার খাওয়া থেকে বাঁচতে তোকে ছেড়েছি। তোর কথা সময় এলে ভাবা যাবে। সাদাটাকে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলে, তুই শ্রাদ্ধ বাড়ির জন্য সাইড লাইনে বসে থাক। সবুজ পাঞ্জাবিটা গায়ে হাত বোলায় আর বলে, ইদানিং তুইই আমার সঙ্গী ছিলি। আজ তোকেও ছাড়তে হচ্ছে। রইল বাকি হলুদ।

কাছাকাছি আছে রংটা। এটাই পড়ি। আর আমাদের ঘিলুহীন দাদাও মাঝে মাঝে এই রঙের পাঞ্জাবি পড়ে। আপন মনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে হলুদ পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়েই চমকে ওঠে বুড়োদা।

বৌদি এর মধ্যে কখন যেন দাদার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বুড়োদাকে চমকে উঠতে দেখে বলে, কি হল?

বুড়োদা ব্যাজার মুখে পাঞ্জাবিটা তুলে ধরে বৌদির সামনে। বাঁদিকের বুকের কাছটা দেখিয়ে বলে, তুমি কত যত্ন করে ফুল দুটো এমব্রয়ডারি করে দিয়েছিলে। কিন্তু এখন তো এটা পুরোনো হয়ে গেছে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যায় বুড়োদার। বউদির কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বলে প্রব্লেম সলভড। যোগদান মেলায় সবাইকে বড় ফুলের একটা করে ব্রোচ দিয়েছিল। সেটা দিয়েই পুরোনো ফুলটা ঢেকে দেব।

হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে বুড়োদা হাজির হল মিটিংয়ে। বুকের উপর জ্বলজ্বল করছে নতুন ফুলটা। প্রার্থী আসার পরেই ষ্টেজের মধ্যে ভিড় বেড়ে গেল। নতুন গু খেতে শেখা কাকেরা প্রার্থীর কাছে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করল। বুড়োদা চুপ করে ষ্টেজের এক পাশে দাঁড়িয়ে। কাউন্সিলর দাদা প্রার্থীর গলায় মালা পড়ালেই সেও গিয়ে হাত মিলিয়ে আসবে। ঠিক এইসময় ঠেলাঠেলিতে সোনালি চুলের এক ছোকরা টাল সামলাতে না পেরে বুড়োদার গায়ে গিয়ে পড়ল। তার হাতের ধাক্কায় বুড়োদার ব্রোচ ছিঁড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকল। বেরিয়ে পড়ল পুরোনো ফুল।

শুরু হল নতুন হুল্লোড়। বুড়োদাকে বিরোধী পক্ষের লোক ভেবে টানতে টানতে ষ্টেজ থেকে নামিয়ে দিল ছোকরার দল। দু’ এক ঘা পড়ল ঘাড়ে পিঠে। একজন তো সুযোগ বুঝে পুরোনো রাগ মিটিয়ে নিল ক্যাঁত করে এক লাথি কষিয়ে। টানাটানিতে বুড়োদার পাঞ্জাবি গেল ছিঁড়ে। কোনও মতে বাড়ি ফিরেছে বুড়োদা।

হাবু একটু থামল।

কেলো চাপা গলায় বলল, গাঁজার ঘোরে গ্যাঁজাখুরি ভালই দিচ্ছিস।

কি বললি? হাবুর জড়ানো গলায় প্রশ্ন।

কেলো হেসে বলল। না, বলছি তারপর কি হল?

তারপর আর কি? বরফ ঘষে, পেইন কিলার খেয়ে বুড়োদা একটু সুস্থ হল। পরের দিন পাড়ায় প্রার্থীকে নিয়ে মিছিল বেরোল। ভোট চাওয়ার সাথে সাথে দলের একনিষ্ঠ কর্মীর উপর হামলার প্রতিবাদে মুখর হল গলিপথ।

আর থাকতে না পেরে ভুতো বলেই দিল – ঢপটা ভালই দিস। তবে ফুলে ফুলে ঢলাঢলি করলে এমনই হয়।

ধোঁয়া ছেড়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল হাবু। ঢপ তো লাগবেই। তোরা সুশীল সমাজ। নীচু তলার পেটের খবর রাখবি কেন?

বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল হাবু। আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলল, তারাগুলো আজ বড্ড টিমটিমে। তাই ধুলোর ফুল নয়তো পাঁকের ফুল নিয়েই মেতে থাকতে হচ্ছে।


লেখকের কন্ঠে শুনুন রচনাটির পাঠ:


লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।