দাঁত দিয়ে যায় চেনা

লেখক : দীপালী ভট্টাচার্য (Dipali Bhattacharjee)

কাল থেকে কাজের মেয়েটিকে ফোন করছি, ফোন সে ধরলে তো! আজ সক্কাল সক্কাল ফোন করলাম তাও ধরে না! আজ অন্নপূর্ণা পুজো। ঘরের পুজো সেরে মন্দিরে যাব পুজো দিতে!

সকাল আটটায় সে এলো। “কিরে কাল থেকে ফোন করছি, ধরছিস না কেন?”

“ফোন সাইলেন ছিল গো! শোনতে পাইনি!” তারপর দাঁত কপাটি বার করে হেসে কাজল মানে কাজের মেয়েটি বলল, “একটা কথা বলব, রাগ করবেনি বলো!”

যখনই কাজে ফাঁকি মারার মতলব করে তখনই সে দাঁত বের করে এমন ধারা হাসে! রাগে যখন দাঁত কিড়মিড় করতে শুরু করেছি, তখনই সে বলল, আজ ঘর মোছবোনি, খালিঝাঁট দুবো। মন্দিরে পুজো দিতে যাব তাই।

“এই শুরু হল, রাগে গজগজ করতে করতে বললাম, “ঠাকুর ঘর মুছে যাবি।“

এদিকে কাজলের প্যানপ্যানানি ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। হাসুক কাঁদুক আগে দাঁতখানি সে বের করবে।

“আমরা গরীব মানুষ বলে কি আমাদের পুজো আচ্চা থাকতে পারেনি গো! এত করি তবু তোমার মন পাই নে! দু মাস যাবত একটাও কামাই নেই সেটি দেখবে নি!”

“ আমার দেরী হচ্ছে কিন্তু ……” ধমক দিতেই আর কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সে চলে গেল।

স্নান সেরে, ঘরের পুজো সেরে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রহনা হলাম। যেতে যেতে দেখলাম, পাশের বাড়ির টগরগাছে প্রচুর ফুল হয়েছে! গাছের টাটকা ফুল মায়ের পায়ে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না! কিন্তু না বলে নেওয়া কি উচিত হবে? ভাবতে ভাবতেই দেখি দাঁতন হাতে দাদা বেড়িয়ে এলেন। দাদাকে দেখেই বত্রিশ পাটি বের করে হেসে বললাম, ‘টগর ফুল নেবো দাদা, মন্দিরে পুজো দেবো!’ দাদা একটু দেঁতো হাসি হেসে বললেন, ‘নিন!’

নিলাম, তবে বেশি নিতে ভরসা পেলাম না!

মন্দিরে গিয়ে অঞ্জলি দেবার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। সর্বত্র লাইন! বাবা ভোলানাথ ভিক্ষার ঝুলি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন মায়ের পাশে। সেই ভিক্ষার ঝুলিতে চাল ডাল বিভিন্ন আনাজপাতি টাকা পয়সা ঢেলে দিচ্ছেন ভক্তজন। এই সব সামগ্রী দিয়ে পরের দিন দরিদ্র নারায়ণের সেবা হবে। সেখানেও লাইন! আমাদের অঞ্জলি লাইন এগিয়ে গেলে পুরোহিতের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। একজন মহিলা ভক্ত অঞ্জলি সমাপ্ত করে ভক্তি ভরে প্রণাম করে একশোটি টাকা ঠাকুর মশাইকে দিয়ে বাবা ভোলানাথের ঝোলায় দিয়ে দেবার অনুরোধ করলেন। মনে হল তাঁর পায়ে কিছু সমস্যা আছে। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে তাঁর অসুবিধা। তিনি আস্তে আস্তে চলে গেলেন। আমিও ভাবছিলাম ঠাকুর মশাইয়ের হাতেই একশো টাকা দিয়ে বলব বাবা ভোলানাথের ঝোলায় দিয়ে দিতে! এত লাইনে দাঁড়ানো যায় না! হঠাৎ দেখি ঠাকুর মশাই এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে সেই মহিলার দেওয়া টাকাটা নিজের পকেটে পুরে নিলেন! ভালো করে লক্ষ্য করলাম তিনি পকেট ধুতি পরেছেন। এই সব দেখেশুনে আমি তো হাঁ! ঠাকুর মশাই কিছু বুঝেই হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে অপ্রস্তুত হাসি হেসে বললেন, ফুল নাও মা! গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘আমার কাছে ফুল আছে’। সবাই অঞ্জলি দিচ্ছেন, আমি নিজে যতটুকু জানি, সেই মন্ত্রে মাকে অঞ্জলি দিয়ে বেড়িয়ে এলাম! লাইনে দাঁড়িয়ে আর ভোলানাথের ঝোলায় কিছু নিবেদন করা হল না! মনে মনে বললাম, বাবা, মা অন্নপূর্ণাই একমাত্র তোমার ভিক্ষার ঝুলি পূর্ণ করতে পারেন, আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের সে সাধ্য কই!

 বাইরে অনেক ভিখারি বসে আছে। “মাগো দুটো পয়সা দাও!” ক্ষীণ শরীর, হলদেটে দাঁত, সামনে যে বৃদ্ধকে দেখলাম, তাকেই সামান্য কিছু দিলাম। অন্যরাও ছুটে এল। কি করি! গাড়ি ভাড়ার পয়সাটা রেখে যা ছিল ব্যাগের মধ্যে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে দিয়ে দিলাম।

রাস্তার পাশে টোটো ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, সেই বৃদ্ধ ভিখারির দিকে নজর গেল। ওর সাদা হিন্দেলিয়ামের থালায় যে কটা টাকা পয়সা ছিল একটা চটের নীচে ঢুকিয়ে রাখল! মনে হল চটের তলায় বেশ অনেক টাকাই রয়েছে!

‘যাবেন নাকি দিদি!’ দেখি চেনা এক টোটোওলা ডাকছে! ফাঁকা গাড়ি। ভিখারির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে টোটোয় উঠলাম। টোটোওলা ছেলেটি বকবক করছে, বলল, “বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেব নাকি!”

“না গো সবাইকে দিতে দিতে সব টাকা শেষ! তুমি ওই মোরের মাথায় নামিয়ে দাও।”

“টাকার কথা বলেছি! আসলে একটু বাড়ি যাব, ওই পথেই তো, আপনাকে নামিয়ে দেব।” তারপর একটু চুপ করে হঠাৎই বলল, ওই যে দাদু, ভিক্ষা করছে, যার দিকে আপনি চেয়ে ছিলেন, উনি কিন্তু এখানকার সবচেয়ে ধনী ভিখারী। কোন্নগর থেকে কিছুটা এগোলে ওর নিজের পাকা বাড়ি আছে!” আমি হাঁ হয়ে শুনছিলাম, বললাম, ‘ওই তো রোগা, কেমন যেন উস্কোখুস্কো চেহারা, হলদেটে দাঁত’!

আমার কথা শুনে ছেলেটি দাঁত বের করে হা হা করে হাসতে লাগল। ‘কি হল হাসছ কেন?’ একটু রেগেই বললাম! আরে দিদি, জানেন না, এ চত্বরে সবাই জানে দাদুর সামনের দুটো দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো! ছেলেটি বলে চলেছে, দাদু এখন আর অভাবে ভিক্ষা করেনা! এখন এটা দাদুর পেশা! ছেলেটির কথায় কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেছিলাম!

 বাম্পার ছিল কিনা কে জানে! একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে হঠাৎই সামনের সিটের দিকে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম! অল্পের জন্য আমার সামনের পাটির দাঁতগুলি রক্ষা পেল। না হলে যে কি হত এতক্ষণে!

জয় মা অন্নপূর্ণা।

(সব চরিত্র কাল্পনিক)

 

 

 

 

 

লেখক পরিচিতি : দীপালী ভট্টাচার্য (Dipali Bhattacharjee)
আমি একজন গৃহবধূ। লেখালেখির শখ আছে। আমি সাধারণত গল্প এবং প্রবন্ধ লিখি। তবে দু একটি কবিতাও লিখেছি বর্তমানে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।