কথার ঝুলি

লেখক : বিপ্লব চন্দ্র দত্ত

প্রবচন হল কবি,সাহিত্যিক বা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সৃষ্টি। প্রবাদের কোন লিখিত ভিত্তি নেই। প্রবাদকে বলা হয় লোকসমাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস। একক কোন ব্যক্তি এর রচয়িতা হিসেবে দাবি করতে পারে না। অন্যদিকে প্রবচন ব্যক্তিগত প্রতিভার দ্বারা সৃষ্ট বাক্য বা বাক্যাংশ। প্রতিনিয়ত কথাশিল্পীদের কথার মারপ্যাঁচে কত কথাই না শুনতে হয় আমাদেরকে। বাংলাভাষায় রয়েছে হাজারো রকমের প্রবাদ, প্রবচন, শ্লোক, ধাঁধাঁ ইত্যাদি। লোকমুখে প্রচলিত কিছু কথাকে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই!

বাগধারা কখন থেকে কিভাবে প্রচলন হয়েছিল তাও জানা যায় না। লোকসাহিত্যের শক্তিশালী মাধ্যম হল প্রবাদ। ছড়ার সাথে প্রবাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। প্রবাদের মধ্যে দিয়ে একটি জাতির সামগ্রিক জীবন চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখেমুখে চমৎকার এই বাক্য বা বক্তব্যগুলো, অর্থাৎ প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহৃত হলে তা এখন শুধু মানুষের মুখে সীমাবদ্ধ নয়। সাহিত্যে তার বিচরণ যত্রতত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এগুলো এখন বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ এবং ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। জনপ্রিয় প্রবাদ-প্রবচনগুলো কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাই, এবারে অধিক গুরুত্ব সহকারে কিছু প্রবাদ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে চাই!

ধরুন, আপনি একজন লেখক। আপনাকে কেউ যদি বলে-দাদা, আপনিতো লেখালেখি করেন, একটা রম্য লেখা চাই আপনার। ধরে নিলাম রম্য লেখার ক্ষমতা আপনার একেবারেই নেই। তবুও যদি আবোল-তাবোল লেখার তাগাদা অনুভব করে কিছু একটা লিখে ফেলার চেষ্টায় ব্রতী হন তাহলে সেটা হবে- অনুরোধে ঢেঁকি গেলা! কি কথা রে বাবা! একজন যদি অনুরোধ করেই ফেলে তাহলে আমি ঢেঁকি গিলতে যাব কেন? ঢেঁকি কি গেলার মত জিনিস! কোনদিন, কোনকালে কেউ কি ঢেঁকি গিলেছিল? গর্দভ ছাত্রকে পড়াতে গিয়ে শিক্ষক ক্লান্ত! বুঝিয়ে দিলেও সহজে বুঝতে চায় না। অপাত্রে উত্তম জিনিস দানকে বলে থাকি – উলুবনে মুক্তো ছড়ানো! মুক্তো খুব দামী একটা বস্তু। কারো হাতে মুক্তো থাকলে উলুবনে কেন, ঘরে আলমারীতে, কেবিনেটে কিংবা ট্রাংকে বা সিন্দুকে লুকিয়ে রাখবে। ছড়াবে কেন? কেউ মুক্তো কুড়িয়ে পেলে কোথায় লুকিয়ে রাখবে তার ঠিকঠিকানা নেই। অথচ আমরা উলুবনে মুক্তো ছড়াই। তাও যদি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় হত! সেলুনে বসে একই রেজার, ব্লেড বা ক্ষুর দিয়ে কত মানুষের শেভ হয়, কামানো হয়, মুড়ানো হয়। তারা কি সবাই একই স্বভাবজাত? বলি যে বেটারা একক্ষুরে মাথা কামিয়েছে! আবার বলি, এক ঢিলে দুই পাখি মারা! আশ্চর্য! এক ঢিলে কেউ জীবনে একটা পাখিও মারতে পেরেছে বলে শুনিনি। দুই পাখি মারা তো দূরের কথা। এরপর আছে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া। ব্যাপারটা যারা ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে, তাদের জন্য হলে কোন কথা ছিল না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে বলা হলে কেমন বেমানান লাগে! মানুষ কি ঘাস খায়? যদি খেতেই চায়, তবে ঘোড়াকে ডিঙাতে হবে কেন? পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়, অথবা ঘোড়াকে তাড়িয়ে দিয়েও তো ঘাস খাওয়া যেতে পারে!

অগ্নিপরীক্ষাকে বলা হয় খুব কঠিন একটা পরীক্ষা। এ জমানায় কেউ কি আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে ভেবেছেন! নিষ্ফল আবেদন বুঝাতে আমরা বলি অরণ্যে রোদন। রোদন করতে হলে কি অরণ্যে যেতে হয়? শিক্ষার সূচনাকে বলি হাতে খড়ি। খড়ি হল সাদা রঙের মাটি বা চক। আগের দিনে মাটির বা টিনের তৈরি স্লেটে লিখার প্রচলন ছিল। এজন্যই জীবনে প্রথম হাতে খড়ি নিলেই বুঝা যেত তার শিক্ষার সূচনা হয়েছে। অন্ধকারে ঢিল মারা মানে-আন্দাজে কাজ করা। অন্ধকারে কি কেউ ঢিল মারে? হঠাৎ বড়লোক হওয়াকে আমরা বলি – আঙুল ফুলে কলাগাছ । এ তো ভীষণ রকমের ফালতু কথা মনে হয়। আঙুল ফুলতে পারে, তবে তা কলাগাছ হয়ে যাবে! ভীষণ বিপদে পড়াকে বলি মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। কেউ কোনদিন দেখেছেন কারো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে? আমি অন্তত হলফ করেই বলতে পারি। মাথায় পড়ুক আর নাই পড়ুক, আকাশ তো এক জায়গাতেই স্থির আছে কখনো ভেঙেছে বলেও তো মনে হয়না। আকাশ কি কোনদিন ভেঙ্গে পড়েছিল, তাও আবার কারো মাথায়?

কথায় বলে টাকায় কি না পাওয়া যায়! চাইলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। আমি কিন্তু তা মনে করি না। কারণ, টাকা থাকলেই বাঘের দুধ পাওয়ার কথা না। আপনার টাকা থাকলেই কে আপনার কাছে বাঘের দুধ বিক্রি করতে আসবে? গোপন কথা ফাঁস করে দেওয়ার নাম হাটে হাঁড়ি ভাঙা। ইচ্ছে করে কেউ হাঁড়ি ভাঙবে হাটে গিয়ে – ভাবা যায়? কার এত দায় পড়েছে?

আগেকার দিনে কোন অচিন দেশের রাজকুমার পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিত। এখন পঙ্খীরাজ ঘোড়াও নাই, সেই রাজকুমারও নাই। থাকলে হয়ত সাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত কাঁদত! একটা সাগর বা একটা নদী পাড়ি দিবার সামর্থ্যই তাদের নাই! হয়ত সাঁতারই শেখেনি! এজন্য ইদানিং প্রায়ই দেখা যায় বিদেশগামী ছেলেরা সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে মারা যায়। এরা সত্যিই বড় অভাগা। কিন্তু কথায় আছে-অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়! হায়,হায়! এরা চাইলেই যদি সাগর শুকিয়ে যেত, তাহলে অথৈ পানিতে তলিয়ে যেত না!

একটু বেশি মাত্রার চালাকের গলায় দঁড়ি কেন? কেউ গলায় দঁড়ি পেঁচিয়ে রাখলেই আমরা বুঝে নেব সে অতিচালাক! ধনীর আদরের সন্তানকে বলা হয় -আলালের ঘরের দুলাল! ধনী লোকটি আলাল না হলেই কি! আবার তার ছেলের নাম দুলাল না হলেই কার কি এসে যায়! আলালের ছেলে দুলাল হতেই হবে বা দুলালের বাবার নাম আলাল হতেই হবে কেন?

মাথা খাওয়ার দিব্যি দিচ্ছে সারাক্ষণ, কাছের জন।বলছে- এই কাজটি তুমি যদি কর তবে আমার মাথা খাও! একজনের মাথা অন্যজনে খাবে কিভাবে? এই মাথা দিয়ে কি মুড়িঘন্ট হবে? আর হলেই কেউ খেতে পারবে? এছাড়া যিনি বলছেন, তিনিই কি নিজ মস্তককে এগিয়ে কারো পাতে তুলে দিবেন? তিনি কি আসলেই মাথাটা খাওয়ার জন্য বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত! আচ্ছা করে ধোলাই দিলে বা পেটানো হলে উত্তম-মধ্যম হয়। এখানে অধম বাদ যাবে কেন? সকল ক্যাটাগরিতেই যদি প্রহার করা হয় তাহলে সেটা উত্তম, মধ্যম এবং অধম হওয়া উচিৎ! সুখে থাকা মানেই কি দুধেভাতে থাকা? দুধভাত না খেলে কি সুখে থাকা যায় না! অনেকের তো দুধ খেলে অম্ল হয়! কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইলে আমরা সহজে তা মানি না। আবার উড়ে আসতে চাইলে তার ডানা ঝাপটাতে হবে, পাখা নাড়তে হবে! যিনি আসলেন তিনি কি আসলেই পাখির মত উড়ে এসেছেন?

এই যে এত কথা বলছি, তাতে কি কারো মনে আঁচড় কাটতে পারছি? আসলে কথায় চিঁড়ে ভেজানো যায় না কখনো। আর ভিজবেই বা কি করে! এও তো ভারী অসম্ভব। অনেক বন্ধুকে দেখেছি করমর্দন করতে গিয়ে অতি মোলায়েম করে অন্যের হাত ধরে টানাটানি করতে শুরু করে। এই হাতটান কিন্তু সেই হাতটান নয় যেটাকে আমরা বলি চুরির অভ্যাস! সহজলভ্য বস্তু হল ছেলের হাতের মোয়া! কেন? ছেলের হাতে কি শুধু মোয়াই থাকবে। মিষ্টি, সন্দেশ, এসব থাকলে দোষের কি? আজকালকার ছেলেরা এত সহজেই মোয়াটা দিয়ে দিবে মনে করেছেন! বউকে শেখাতে হলে ঝিকে কি মারতেই হয়? টাকা মেরে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হলেই আমরা তাকে টাকার কুমির বলি। যারা স্পষ্টভাষী তাদের কি ঠোঁট কাটা’ই থাকে? কৌশলে কার্যোদ্ধার করাকে বলি ধরি মাছ না ছুঁই পানি। বলেন – পানি না ছুঁয়ে কি মাছ আদৌ ধরা যাবে? বুক ফেটে যাওয়া। সাংঘাতিক ব্যাপার! বুকটা ফেটে গেলে কি বেঁচে থাকা সম্ভব? প্রাণঢালা অভিনন্দন-কাউকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে আমরা নিজ নিজ প্রাণকে ঢেলে দেই। অভিনন্দন জানানো যায়, তবে প্রাণঢেলে কেন? আজকাল আবার অনেককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়। চোখে যদি আঙুলের খোঁচা লাগে, কি অবস্থা হতে পাওে ভেবে দেখেছেন? এই যে এখন মধুমাস। আম কাঁঠালের মৌসুম। কি সহজেই আমরা পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাই! কাউকে কি পরের মাথায় পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে দেখা গেছে? হরহামেশাই আমরা খাঁটি ঘি খুঁজে মরি। বাজারে আজকাল খাঁটি ঘি পাওয়া খুব মুস্কিল! তার উপরে আবার কেউ যদি ছাই ভস্মে ঘি ঢালেন, তবে কেমনটা লাগে! আবার দেখুন মশা মারতে কামান দাগা’র কথা বলা হয়েছে। কামান কি ভুরিভুরি রয়েছে এদেশে? কামানের কথা বাদই দিলাম। যদি রাইফেলের কথাই ধরি, ক’জনের সামর্থ্য রয়েছে রাইফেল নিয়ে মশাকে তাড়া করতে? এরপর রয়েছে সাত খুন মাফ! আহারে! যদি একবার প্রমাণিত হয় যে, খুন করেছেন সেক্ষেত্রে মাফ তো দূরের কথা, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে থাকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় থাকতে হবে! জীবনে কেউ মাত্র একখানা খুন করেও মাফ পেয়েছে বলে মনে হয়না, আবার সাত খুন! কেউ কেউ আবার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। তার কি আর কোন কাজ নেই? প্রথম কথা হল, বনের মোষ এখন গৃহপালিত। দ্বিতীয়ত, ঘরে না খেয়ে অন্যের বাড়িতে খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে বনে গমন করতে দোষের কি! এরপর চোখ কপালে তোলা- অবাক হতে গিয়ে কেউ কখনো চোখ কপালে তুলেছে কিনা আমার জানা নেই। অপচয় মানেই নয়-ছয় নয়! মিছরির ছুরি আমি কোথাও দেখিনি। এ বিষয়টিকে আরো সহজে বলা হয়ে থাকে- মুখে মধু অন্তরে বিষ! কিন্তু কখনও কারো মুখে মধু এবং হৃদয়ে বিষ পাওয়া যায়নি! জীবনে অর্ধ-সেঞ্চুরি পার করে এসে মনে করতে পারছিনা যে, কোন একটা বছর আঠারো মাসে গেছে। সবার জন্যই বারো মাসে বছর হওয়া উচিৎ। সংসার যিনি পরিচালনা করেন তিনিই একমাত্র জানেন কত ধানে কত চাল! এটা আবার কোন ধরনের হিসাব, বুঝিনা! যত ধান তত চাল- সোজা হিসাব! একটু ধৈর্য ধরুন, একটু সবুর করুন! বলা হয়ে থাকে যে- ধৈর্য ধরে থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায়, অর্থাৎ সবুরে মেওয়া ফলে। মেওয়া গাছে নাকি অনেক দেরিতে ফল ধরে। এজন্য গাছের মালিককে সবুর বা ধৈর্য ধারন করে থাকতে হয়। গাছে কাঁঠাল থাকলেই গোঁফে তেল লাগানোর প্রয়োজনীয়তা কেন? কাঁঠাল গাছের মালিকের যদি গোঁফ না থাকে কিংবা তার যদি কোন গাছই না থাকে? আবার গাছে কাঁঠাল নাইবা থাকল, বাজার থেকে কিনে খেতে চাইলেও কি গোঁফে তেল দিতেই হয়?

ধরুন, আপনার বাড়িতে চোর এসেছিল। আপনি টের পেয়ে চোরকে তাড়া করলেন। কিন্তু ধরতে পারলেন না। চোর পালিয়ে গেল। আপনার কি তাহলে বুদ্ধি গজাবে? কারণ, চোর পালালে নাকি বুদ্ধি বাড়ে! জলে বাস করে এমন কোন লোকের সন্ধান আমি আজও পাইনি। জলে বাস করলে নাকি কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যাবে না। তাছাড়া কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করার সময় পাবেন তো? নাকি বিবাদে জড়ানোর আগেই কুমিরের পেটে চলে যাবেন! আগেকার দিনে মানুষ শাক দিয়ে মাছ ঢাকত। আর এখন কোন শাকই বাজারে সুলভ নয়, বরং ফিশারির মাছ সুলভ। তাই এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেয়ে মাছ দিয়ে শাক ঢাকা অনেক সহজ! আজকাল মামা না থাকলে নাকি কিছুই হয়না! মামার জোরে অনেক কিছ লাভ করা যায়! যাদের মামা নাই, তাদের দুঃখের সীমা নাই! এজন্য নাই মামার চেয়ে একটা কানা মামাই যথেষ্ট!

চেনা বামুনের যদি পৈতের দরকার না লাগে, তবে পৈতে ধারণ করার জন্য কত যাগ-যজ্ঞের প্রয়োজন হয় কেন? শাস্ত্রানুষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দু বালকেরা ব্রাহ্মণ্যসংস্কারে দীক্ষিত হয়। উপনয়ন শরীরে উপবীত বা পৈতে ধারণ করা হয়। উপবীত প্রকৃতপক্ষে তিনটি পবিত্র সুতো, যা দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী ও সাবিত্রীর প্রতীক। উপনয়নের পর উপবীতধারীকে দ্বিজ বলা হয়। দ্বিজ শব্দের অর্থ দুইবার জাত। প্রথমবার ব্যক্তির জন্ম হয় মাতৃগর্ভ থেকে এবং দ্বিতীয়বার জন্ম হয় উপবীত ধারণ করে। খাল কেটে কুমির আনা। খাল কাটলেই কুমির চলে আসবে, এমন কোন কথা নেই! বাংলাদেশের অনেক নদীতেই কুমির পাওয়া যায়না, আবার খালে! চোরের মায়ের কি গলার সাইজ বড় থাকে? নাকি উঁচুগলায় কথা বলে? স্বপ্ন দেখা ভালো। তবে তা যদি হয় লাখ টাকার, তাহলে তো আর কোন কথাই নেই। আবার লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে হলে অবশ্যই ছেঁড়া কাঁথায় শুতে হবেই! স্বর্গ নরক নাকি পরকালের জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং তা কেবল মানবের তরে। অন্যান্য জীবজন্তু –গাছপালার কথা যদি বাদই দিতে হয় তবে ঢেঁকি কি করে স্বর্গে যাবে এবং সেখানে গিয়েও নাকি ধান ভানবে? আবার ধরুন, আপনার গুড়ের আড়ত আছে। আপনি গুড়ের ব্যবসায়ী। আপনার লাভের অংশের যে গুড়, তা পিঁপড়েতে খেয়ে ফেলবে। অথবা কোন এক লোক অল্প কিছু অর্থপ্রাপ্তি হবার পর গুড় কিনে আনলো। কিন্তু তার আর তা খাওয়ার ভাগ্য হলোনা, পিঁপড়েই তা খেয়ে ফেললো। আসলে কোন ব্যবসায় সামান্য লাভ হলে তা দিয়ে আর নতুন কোন বড় কাজ করা যায়না, অল্প লাভ এদিক-সেদিকই নষ্ট হয়ে যায়। তাই কেউ লাভ করে তা ভোগ করতে না পারলে এই প্রবাদ। ঢেঁকিতে ধান ভানা হত আগেকার দিনে। একাজে অংশ নিত দুই-তিনজন মহিলা। তারা গল্প-গুজব করে কষ্টটাকে হালকা করত! তবে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাইত কি না জানিনা! শুনেছি, কাল সাপে দংশন করলে আর বাঁচার কোন উপায় থাকেনা। তাহলে মানুষ কেন যে জেনে বুঝে দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পোষতে যায়!

কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ পাঁকলে করে ঠাস ঠাস। বাঁশকে কাঁচা অবস্থাতেই বাকানো যায়। পেকে গেলে তা শক্ত হয়ে যায়, বাকাতে চাইলে ঠাস করে সোজা হয়ে যায়। তেমন ভাবে সঠিক সময়ে বদঅভ্যাসের লাগাম টেনে না ধরলে পরে তা পরিবর্তন করা যায় না। তাই যে কোন কিছু নিয়ন্ত্রন করতে চাইলে প্রাথমিক অবস্থাতেই করা উচিত তা বোঝাতে এই প্রবাদ। ‘‘পোলা হওয়ার খবর নাই, হাজমের লগে দোস্তি”। ‘‘গাছে কাঠাল, গোফে তেল” এর সমতূল্য একটি প্রবাদ। এক লোকের এখনো ছেলে হয়নি,কিন্তু হলে তার খৎনা করাতে হবে ভেবে এখন থেকেই সে হাজম (সুন্নতে খতনা অথবা মুসলমানি করাবার পেশাদার লোক) এর সাথে বন্ধুত্ব করে রাখছে। কোন কাজের জন্য অতি আগাম প্রস্তুতি নিলে এই প্রবাদের বব্যবহার হয়।

একসময় পাত্র পক্ষ নারীর জাত দেখে মূলত বিয়ের সম্বন্ধ আনতো। এক্ষেত্রে নারী কতটা শিক্ষিত বা কতটা গুণী তার চেয়ে বেশি তার জাত ভালো কিনা তা দেখা হতো। জাতের নারী কালোই ভালো, কিন্তু তাদের কপাল মোটেও ভালো নয়! শুধু জাতের মেয়ে হয়ে বড়াই করার দিন এখন আর নেই! আবার নদীর ঘোলা জল দিয়ে এখন আর কেউ পিপাসা মেটাতে আগ্রহী নন। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই কেন? পিসতুতো, কাকাতো, মামাতো হলে ক্ষতি কি ছিল? এদেশের দরিদ্র লোকেরা শীতের দিনে কাবু হয়ে যায়। অনেক কষ্ট পায়। শীতে জবুথবু হয়ে দিনের বেলায় রোদ পোহায়। অথচ, শীতের পৌষ মাসকে সর্বনাশের বিপরীতে স্থান দেয়া হয়েছে। বলা হয়ে থাকে-কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ! আমরা এত অতিথিপরায়ন যে, নিজে ঘুমানোর জায়গা না পেলেও শংকরাকে ডিকে নিই! এখানে শুধু শংকরা না হয়ে ললিতা, বিশাখাকে কি শুতে বলা যেত না?

গরু মেরে জুতা দান করতে হলে আগে জুতা বানানো জানতে হবে। আবার জুতা বানানো জানতে হলে মুচি হতে হবে। খুব কঠিন কাজ। তাই এখন আর কেউ গরু মারতেও যাবেনা, জুতাও দান করবে না। কোন কাজ না থাকলে কি মানুষ খই ভাজে? খই ভাজাও তো একটা কাজ, একটা শিল্প! কি অবলীলায় আমরা বলি-নাই কাজ তো খই ভাজ!

সর্দার নিধিরাম। যার ঢালও নেই, তলোয়ারও নেই! আজ-কালকার দিনে ক’জনের ঢাল-তলোয়ার আছে? শুধু শুধু নিধিরাম বেচারার যত দোষ! কোন গোপন কথা বা গোপন শলা-পরামর্শ করতে গিয়ে আমরা বলে ফেলি-দেয়ালেরও কান আছে! দেয়ালের কান থাকলে প্রাণও থাকতে হবে। সেটাকি কখনো ভেবে দেখেছি? এই যে এত গরমে হাসফাস করছে মানুষ, তারমধ্যে আবার সময় বের করে,কষ্ট করে এই লেখাটা পড়ছেন। হয়ত বলবেন- আমি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছি! আসলে কারো কাটা ঘায়ে কেউ নুন ছিটাতে পারবে? মানুষ কি এতটাই খারাপ? আবার এমনও হতে পারে যে, এত বড় লেখা পড়তে দিয়ে আমি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছি!

কান টানলে নাকি মাথা আসে! কান বেশি জোরে টানলে ছিঁড়েও যেতে পারে। আর কেবল কান ধরেই না টেনে চুল ধরে,কলার ধরেও টানা যেতে পারে! নটরাজ, নটবর, নর্তকী নাচতে না জানলে উঠোনের দোষ না দিয়ে যে আসর বা স্টেজে নাচবে তার দোষ দিতে পারে! কুত্তার পেটে আবার ঘি সয় না। কুত্তাকে কেউ কোনদিন এক চামচ ঘি খেতে দিয়েছিল? যার বিয়া তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই। এখন আর সেইদিন নাই। যার বিয়া তার খবর আগেই হয়! নিজেই পছন্দ করে পালিয়ে যায়,দূরে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। খবর তৈরি করে। পাড়াপড়শিরা বরং কিছুই টের পায়না। পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকে। জাহাজের খবর রাখার দোষ কেবলমাত্র আদার ব্যবসায়ীর ঘাড়ে কেন? কলারবেপারি, আলুরবেপারি, পেঁয়াজবেপারিরা কোথায়?। মক্কার মানুষ না কি হজ্ব পায়না। কেন? কে দেখেছে, মক্কার মানুষকে হজ¦ না করতে?

মাথা ন্যাড়া থাকলে বা মাথাভর্তি টাক থাকলে একটু সাবধানেই চলাফেরা করতে হয়! যত্রতত্র ঠুসঠাস লাগতে পারে। তাই ন্যাড়াকে ধরেবেঁধেও বেলতলায় একবারের জন্যও নিয়ে যাওয়া কঠিন! নাহ্, কঠিন হবেনা হয়ত! ন্যাড়া নাকি একবারই বেলতলায় যায়! দুই চারটে লাইন কবিতা লিখে কিংবা অর্থহীন প্যাঁচাল পারলেই যদি কবি/লেখক হওয়া যেত তাহলে, ‘‘ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম’’ হত না! অনেক হম্বিতম্বি করে এবার লেখার ইতি টানতে যাচ্ছি! অনেক রাত হয়ে গেছে! ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করতে আজ্ঞা হয়! কথার ঝুলি শেষ রাতে শেষ হয়ে গেল! ঐদি আরও রাত থাকত, তবে ঝুলিতে আরও কিছু কথা থাকত বোধ হয়! তখন বলা যেত-‘রাত বাকি, বাত ভি বাকি’ আবার ওস্তাদের মারও নাকি শেষ রাতে!

লেখক পরিচিতি : বিপ্লব চন্দ্র দত্ত
বাংলাদেশ ব্যাংক ময়মনসিংহ অফিসে যুগ্মপরিচালক হিসেবে কর্মরত। জন্ম-বাংলা 1374 সনের 20 কার্ত্তিক নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার ধারাম গ্রামে। শিক্ষাগত যোগ্যতা-এমবিএ(ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং)।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।