লেখক : সোহিনী খাঁ
আচ্ছা, বেশ কেমন হতো যদি জীবনে নিজেদের হাত দুটো দিয়ে যা খুশি তাই করা যেত, কিন্তু তার কোনো পরিণতি না থাকতো? কারণ, কাজটা তো আমার হাত করেছে, আমি তো নই। সুতরাং দায়ও তো ঠিক আমার না! আচ্ছা, কয়েকটা উদাহরণ দিই। এই ধরুন ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছেন; এইসময় হঠাৎ দিলেন ট্রেনের চেনটা টেনে। কিংবা ধরুন বাসের সিটে বসে থাকা এক দাদুর দাড়ি ধরে মারলেন এক হ্যাঁচকা টান। বা ধরুন রেস্তোরাঁয় পাশের টেবিলে বসে থাকা ভদ্রমহিলার প্লেট থেকে তুলে নিলেন কিছুটা খাবার!!!
প্রসঙ্গত একটা সতর্কবাণী দিয়ে রাখি, দয়া করে ভাববেন না আমি এসব করার জন্যে আপনাদের উসকাচ্ছি এবং কিরকম গালাগালি খাবেন সেই ভেবে খুব হাসছি! পাঠকদের কাছে অনুরোধ, সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পড়ুন ও তারপরে বিবেচনা করুন যে এরকম অদ্ভুত খেয়াল মাথাতে এলেও, সেটা আদৌ করবেন কিনা। আর এইসব করার পর যদি ‘হাতের দোষ আমার না’-র দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যায়, তবে তো আর কথাই নেই! ‘কোনো নিয়ম মানি না’ ব্রতে ব্রতী হয়ে যা খুশি তাই করলেই হলো।
ব্যাপারটা কিন্তু ‘হলে বেশ হতো’ মনে হলেও, বাস্তবে হলে কিন্তু ‘এ তো মহা ঝামেলায় পড়া গেলো’ই মনে হতো। ভাবছেন কি উল্টো পাল্টা বকছি, তাইতো? আসলে আজ আমি লিখতে চলেছি Alien Hand Syndrome (AHS) (কিংবা যাকে বলে Dr. Strangelove Syndrome) নামক এক রোগ নিয়ে। সেটা আবার কি বস্তু? আসুন জেনে নেওয়া যাক –
AHS হলো একধরণের বিরল স্নায়বিক রোগ, যাতে সাধারণত একটি হাতের (বিশেষত বাঁহাতের) ওপর থেকে মানুষ সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত অদ্ভুতরকম খামখেয়ালী আচরণ করতে শুরু করে, বলা যায় ‘having a mind of its own’ এর মতোই কাজ করতে থাকে হাত।
এতো গেলো সংজ্ঞা। কিন্তু রোগটা কিরকম, সেটা বোঝার জন্য এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের অভিজ্ঞতা শোনা দরকার।
৫৫ বছর বয়সী এক মহিলা, নিউ জার্সির বাসিন্দা, Karen Bryne ছিলেন এই রোগের শিকার। আসলে ২৭ বছর বয়সী Karen ছিলেন এপিলেপ্সির শিকার। যার ফলে ওনার মস্তিষ্কে একটা সার্জারি করতে হয়। এই সার্জারিতে ওনার মস্তিষ্কের মধ্য থেকে মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল উৎপন্ন করা অংশটিকে কেটে বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। Karen এর মস্তিষ্কে সেই অংশ ঠিকঠাকভাবে চিহ্নিত করতে না পারায়, বাধ্য হয়ে ডাক্তারকে ওনার মস্তিষ্কের করপাস ক্যালসামের কিছুটা অংশও কেটে বাদ দিতে হয়। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, করপাস ক্যালসাম মস্তিষ্কের দুই ভাগ – ডান ও বাম হেমিস্ফিয়ারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে)।
সার্জারির পর Karen এর এপিলেপ্সি সেরে যায় তবে তার শরীরে দেখা দেয় অদ্ভুত সমস্যা। একবার তিনি ডাক্তারের চেম্বারে বসে; এমনসময় হঠাৎ ডাক্তার O’Connor অবাক হয়ে ওনাকে প্রশ্ন করেন,-‘Karen আপনি এটা কি করছেন? আপনি (আপনার হাত) জামা খুলছেন কেন?’ প্রচন্ড অবাক হয়ে Karen খেয়াল করেন, যে তার বাঁ হাত তার শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করেছে। বিব্রত হয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের ডান হাত দিয়ে জামার বোতাম লাগিয়ে নেন। কিন্তু ওনার বাঁ হাত আবারও ওনার জামার বোতাম খুলতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে সেদিন ওনাকে তড়িঘড়ি করে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
এখানেই শেষ নয়। Karen যখনই ডান হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে অ্যাশ-ট্রেতে ব্যালেন্স করিয়ে রাখতেন, ওনার বাঁ হাত সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে সেটাকে নিভিয়ে দিত। আবার কখনো ওনার ব্যাগ থেকে কখন যে ওনার বাঁ হাত কিছু বের করে নিতো, উনি বুঝতেও পারতেন না; যার ফলে অনেক জিনিস তিনি হারিয়েও ফেলতেন।
Karen এর সমস্যাটা জন্ম নেয় মূলত ওনার মস্তিষ্কে চলতে থাকা প্রতিনিয়ত এক দ্বন্দ্বের কারণে। আসলে আমাদের মস্তিষ্কের বাম হেমিস্ফিয়ার শরীরের ডানদিক চালনা করে এবং ডান হেমিস্ফিয়ার চালনা করে বাঁদিকটি। তবে সাধারণত বাম হেমিস্ফিয়ারের প্রভাব বেশি এবং এটাই ঠিক করে যে আমরা কোন কাজটা করবো আর কোনটা করবো না। কিন্তু Karen এর ক্ষেত্রে, ওনার সার্জারির পর থেকে, ওনার মস্তিষ্কের ডান হেমিস্ফিয়ার, বাম হেমিস্ফিয়ারের এই নিয়ন্ত্রণ মানতে অস্বীকার করে দেয়। যাইহোক, সৌভাগ্যবশত ১৮ বছর AHS এ ভোগার পর, চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির কারণে, বর্তমানে ওষুধের দ্বারা ওনার মস্তিষ্কের ডান হেমিস্ফিয়ারকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
AHS রোগে আক্রান্ত ৬৫ বছর বয়সী অন্য এক ভদ্রলোকের জবানিতে –
“আমি একদিন বাসে করে যাওয়ার সময় হঠাৎ খেয়াল করি, একটা হাত পিছন থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর আমায় ধরার চেষ্টা করছে। হাতটা এরপর আমার ট্রাউজারের ওপর থেকে আমার পা টাকে শক্ত করে চেপে ধরে। আমি প্রথমে ভাবলাম বাসের কেউ আমায় হেনস্থা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই আমি উপলব্ধি করি, যে সেটা আমার নিজেরই ডান হাত; যদিও আমি সেটা একদমই অনুভব করতে পারিনি। আমি তখন আমার ডান হাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পুরোপুরি অক্ষম হয়ে পড়ি এবং ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। সেইরাত্রে আমি এই ভেবে ভয়ে ঘুমোতে পারিনি যে আমার ডান হাত আমায় হেনস্থা করতে পারে, এমনকি ঘুমন্ত অবস্থায় আমায় মেরেও ফেলতে পারে।”
AHS রোগটি প্রথম ধরা পড়ে ১৯০৮ সালে এবং ১৯৪০ থেকে কেসের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যাইহোক, এবার জানা যাক আসলে কোন পরিস্থিতিতে মানুষ এমন রোগের শিকার হয়।
সাধারণত স্ট্রোক, টিউমার ও নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের কারণে মানুষের মস্তিষ্কের ৩ টি অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, যার ফলাফলস্বরুপ মানুষের মধ্যে এই সিনড্রোম দেখা দিতে পারে –
১। মেডিয়াল ফ্রন্টাল কর্টেক্স
২। করপাস ক্যালসাম
৩। পেরিয়েটাল লোব
১ নং অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগীর হাত আবেগের বশবর্তী হয়ে অনর্থক চারদিক হাতড়ে বেড়াতে থাকে। ২ নং অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগীর হাত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং মাঝে মাঝেই দেখা যায় তার রোগগ্রস্ত হাত ও সুস্থ হাত একে অপরের সাথে মারামারি করছে; চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই অবস্থার নাম diagnostic dyspraxia। তৃতীয় ক্ষেত্রে রোগীর এরকম অনুভূতি হয় যেন তাদের হাত, তাদের শরীর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন, যেখানে শুধু এমন না যে তারা তাদের হাত কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, বরং তাদের মনে হতে থাকে যেন বাকি সমস্ত শরীর তার নিজের হলেও, হাত টা অন্য কারো।
এই তো গেল কারণ ও ফলাফল। রোগটাকে আরেকটু সহজভাবে বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দি। ধরুন আপনি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়, সবসময় ‘আজকাল কি করা হয়’ জানতে চেয়ে বিরক্ত করা কাকিমাদের ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা দেখলেন। আপনার মস্তিষ্ক জানে যে বেলটা আপনি টিপে দৌঁড়ে পালাতে পারবেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বেলটা আপনি টিপবেন, হয়তো ভদ্রতার খাতিরে কাজটা করবেনই না। কিন্তু একটি AHS -এ আক্রান্ত ব্যক্তির হাত ‘আমি এই কাজটা করতে পারবো’ আর ‘আমি এই কাজটা করবো’ -এর মাঝের ফারাক টা ধরতে পারে না। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির হাত কলিং বেলটি বাজাতে পারে, ব্যক্তিটির সম্মতি-সহ কিংবা সম্মতি-ছাড়া।
১৯৬৪ তে মুক্তি পাওয়া, “Stanley Kuberick” এর পরিচালিত সিনেমা “Dr Strangelove” এ আমরা দেখতে পাই Peter Seller –এর অভিনীত চরিত্র AHS -এ আক্রান্ত এবং উনি নিজের হাত কে কিছুতেই আটকাতে পারেন না ‘Nazi Salute’ করা থেকে – এইখান থেকে রোগটির আরেক নাম হয় ‘Dr Strangelove’ Syndrome.
এখন যখন প্রতিবেদনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছেন, এবার বসে ভাবুন তো, আপনি যা করবেন সেটার দায় আপনার, নাকি আপনার হাতের?
তথ্যসূত্র:
- https://youtu.be/LvYjJyGkEko (Youtube_channel:SciShowPsych)
- https://www.google.com/amp/s/www.bbc.com/news/uk-12225163.amp
- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Alien_hand_syndrome
- https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5155497/
লেখক পরিচিতি : সোহিনী খাঁ
আমি রসায়নের ছাত্রী।বতর্মানে আমি সেন্ট্রাল উনিভার্সিটি অফ কর্ণাটক থেকে MSc করছি।পড়াশোনার পাশাপাশি বিজ্ঞান নিয়ে মজার প্রবন্ধ লেখায় আগ্রহী আমি,যাতে যাঁরা বিজ্ঞানের ছাত্র/ছাত্রী নন তারাও আগ্রহী হন বিজ্ঞান বিষয়ে। বিজ্ঞান বিষয়টিকে কে আরো সহজ করে তুলে ধরাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য।