লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য
গত পর্বের লিঙ্ক এখানে
আরও একবার কিছু অপ্রীতিকর কথা আসবে। কিছু ভাবনা, যা হয়তো ব্যবসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। আসুন সেই বিষয় গুলি নাড়াচাড়া করে দেখা যাক। এই পর্ব এক বা একাধিক ভাগে হবে। বেশ কিছু তাত্ত্বিক কচকচিও থাকবে। কষ্ট করে হলেও যদি মন দিয়ে পড়েন, আগামী দিনে মেটিয়াবুরুজ কেন্দ্রীক গারমেন্টস শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
ব্যবসায়ী কমিউনিটি হিসেবে ভারতে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের স্থান পয়লা নম্বরে। আশাকরি এই নিয়ে কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব কারোর নেই। আপনি যদি ব্যবসায়ী কমিউনিটি হিসেবে মাড়োয়ারিদের এই লিডিং রোলের কারণ পর্যালোচনা করেন, তবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উঠে আসবে।
প্রথমেই যে পয়েন্টটি আপনার নজরে আসবে সেটা হচ্ছে মাড়োয়ারিদের কৌম ভাবনা। একজন মাড়োয়ারি যে কোনও ক্ষেত্রেই সবথেকে বেশি নির্ভর করে নিজের কমিউনিটির উপরে। এবং এই কমিউনিটি বন্ডিং তাদের ব্যবসায় অগ্রগতির অন্যতম কারণ। কমিউনিটি বন্ডিং এর সাথে অবশ্যই যুক্ত করতে হবে কমিউনিটি হিসেবে মাড়োয়ারিদের অ্যাগ্রেসিভ নেচার।
অন্যদিকে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যেও কৌম ভাবনা এবং বন্ডিং যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও অ্যাগ্রেসিভ নেচার একেবারেই নেই। বাঙালি মুসলিম কোম্পানিতে আপনি বাঙালি হিন্দু দায়িত্বশীল পদে আছে, এমনটা হামেশাই পাবেন। কিন্তু সচরাচর কোনও মাড়োয়ারি কোম্পানিতে দায়িত্বশীল পদে অন্য কমিউনিটির মানুষের উপস্থিতি শূন্যের কাছাকাছি।
দ্বিতীয় যে পয়েন্টটি নজরে এসেছে, সেটা মনে হয় সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি কোনও মাড়োয়ারি পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে থাকেন, তাহলে দেখবেন ওদের প্রতিটি অ্যাক্টিভিটি’র সাথেই জড়িয়ে আছে বিজনেস। সেটা পড়াশোনার ক্ষেত্র পছন্দ করাই হোক, অথবা বৈবাহিক সম্পর্ক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি।
প্রাইভেট টিউশন করার দরুন কলকাতার বহু স্বনামধন্য মাড়োয়ারি পরিবারের সাথে আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বা আছে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে ছেলে বা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো, তাকে পারিবারিক কারণে (বলা ভালো পারিবারিক ব্যবসার কথা মাথায় রেখেই) চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট হওয়ার দৌড়ে নাম লেখাতে। কমার্স, চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্সি, ম্যানেজমেন্ট, কোম্পানি লইয়ার, এক কথায় এনিথিং টু এভরিথিং রিলেটেড টু বিজনেস, মাড়োয়ারিদের পড়াশোনার ট্রেন্ড কেবলমাত্র সেই সব ফিল্ডেই। মাড়োয়ারি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য পেশাজীবি কোটিতে গুটিক মাত্র।
অন্যদিকে বাঙালি মুসলিমদের, বিশেষত মেটিয়াবুরুজের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে এই সচেতনতার বড়োই অভাব। অথচ ভারতবর্ষের বৃহত্তম রেডিমেড গারমেন্টস হাবে এই সচেতনতা অত্যন্ত প্রয়োজন। গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন সময়ের সাপেক্ষে গারমেন্টস শিল্পের বিকাশ সর্ব ভারতীয় প্রেক্ষাপটে যে দিকে এগোচ্ছে, মেটিয়াবুরুজের গারমেন্টস শিল্প চলছে তার উল্টো দিকে।
কেন এই কথা বলছি? একটু তলিয়ে দেখা যাক। আপনার পাড়ার মুদি দোকানে গিয়ে যদি একটু চোখ কান খোলা রাখেন, আমার কথা বুঝতে পারবেন। যে সব অপেক্ষাকৃত গরীব মানুষ ডিটারজেন্ট পাউডার কিনতে দোকানে আসেন, তারা এসে দোকানদারের কাছে “১০০ গ্রাম সার্ফ” দিতে বলেন। এখানে Surf এই ব্র্যাণ্ড ডিটারজেন্ট পাউডারের সমার্থক। Surf এর ব্র্যাণ্ড নেম তার মাথায় এভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে অন্য ডিটারজেন্ট পাউডারের অস্তিত্ব তার কাছে নেই। ডিটারজেন্ট মানেই তার কাছে Surf।
এখানেই ব্র্যাণ্ডনেম এর সার্থকতা। যদি রেডিমেড গারমেন্টসের ব্র্যাণ্ডগুলি নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে দেখবেন ভারতবর্ষে তথা সারা পৃথিবীতে যে সব রেডিমেড গারমেন্টস ব্র্যাণ্ড বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের সকলেরই নিজস্ব সিগনেচার স্টাইল রয়েছে। কাপড়, রঙ, স্টিচিং, বোতাম, কাটিং, সব ক্ষেত্রেই প্রতিটি ব্র্যাণ্ড একে অন্যের থেকে আলাদা।
কিন্তু মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্প কি এমন কোনও ব্র্যাণ্ড তৈরি করতে পেরেছে? উত্তর আপনারাই দেবেন। আজও মানসিক ভাবে মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্প নবাব ওয়াজিদ আলী শাহের জমানাতেই বাস করছে। মনে রাখতে হবে শুধু আধুনিক মেশিন আনলেই ব্যবসা আধুনিক হয় না। নতুন প্রযুক্তি উৎপাদন বাড়াতে পারলেও বাজারের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন আধুনিক মানসিকতা। ব্যবসায় আধুনিক চিন্তাভাবনার বিকাশ।
আজ এই পর্যন্ত। এই পর্ব আরও কিছুটা দীর্ঘ হবে। পাঠকের সংখ্যা কমছে। তবুও যদি কিছু মানুষের ভাবনার দরজায় কড়া নাড়া যায়, তাতেই এই লেখার দাম পাওয়া যাবে।
চলবে…
লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।