লেখক : অন্তরা ঘোষ
দূরের দুধসাদা মেঘের আলোয়ানে ঢাকা আবছা কালো পাহাড়টা যেন আজ হাতছানি দিয়ে ডাকছে শালবনিকে। যেন কিছু বলতে চায় এই পূর্ণিমার রাতে । জোছনার আলো পাহাড়টাকে একজন সুঠাম সুদর্শন পুরুষের রূপ দিয়েছে যেন ! মিষ্টি আলোর দ্যুতিতে তার রূপ যেন আজ শতগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। শালবনি মুগ্ধ হয়ে দেখছে। দেখেই চলেছে। সেই সৌম্যকান্তি উপলপুরুষ যেন দুহাত বাড়িয়ে আহ্বান করছে শালবনিকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে শালবনি । কী আশ্চর্য ! শালবনি যতই এগোয় সেই শুভ্রকান্তি সুদর্শন উপলপুরুষ ততই পিছিয়ে যায় ! কাছে যেতে পারছেনা কেন শালবনি ! পায়ে পায়ে পাহাড়ি রাস্তার খাদের কিনারায় চলে এসেছে সে। পা পিছলে পড়ে যেতে যেতে আর্তনাদ করে ওঠে শালবনি ! “আমার হাতটা ধরোও ও ও ও ! আমি বাঁচতে চা ই ই ই ই ই ই” ..
” এই দিদি কী হয়েছে রে তোর, এমন গোঙাচ্ছিস কেন ? .. কোন ভয়ের স্বপ্ন দেখলি নাকি “? শালবনির বোন মহুল ঠেলা দিয়ে ডাকে তার দিদিকে। মহুলের ডাকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে শালবনি। বুঝতে পারে এতক্ষন একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ছিল সে । জানালা দিয়ে সকালের কাঁচামিঠে রোদ শালবনির মুখে এসে পড়ে । নতুন প্রভাতের আগমনী বার্তা। আড়মোড়া ভেঙে উঠে জানলার কাছে গিয়ে পর্দাটা আরও কিছুটা টেনে সরিয়ে দেয় শলবনি। দৃষ্টি চলে যায় সামনের বাগান ছাড়িয়ে অনেক দূরে । রাতের স্বপ্নে দেখা সেই উপল পুরুষকে খুঁজতে থাকে শালবনি।
গতকাল বিকেলে বাবা মায়ের কাছে এসেছে শালবনি। দেবতনু দুদিনের জন্য হায়দ্রাবাদ গেছে এডুকেশনাল ট্যুরে। যাবার আগে শালবনিকে ওর বাপের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে মানসিক কষ্ট ও মনখারাপ বাসা বেঁধেছে শালবনির মনে। গত ৬ মাস থেকে হাসব্যান্ড দেবতনুর সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। দুজনের মাঝে এখন কেমন যেন একটা অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে। মাত্র দুবছর হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। শান্তিনিকতনে পড়তে গিয়ে দুজনের আলাপ, মন দেয়া নেওয়া । পাঁচ বছর প্রেম ও শেষপর্যন্ত বিয়ে । দেবতনু এখন কলেজের অধ্যাপক। বিয়ের পরের একবছর সুখের সমুদ্রে ভেসেছিল দুজনে। দেবতনুর অভ্যাস ছিল প্রতিদিন কলেজের নানা রকম কথা স্ত্রীকে বলা। তখনই ওর কলেজের এক ছাত্রী অদিতির কথা মাঝে মাঝেই শুনত দেবতনুর মুখে। মেয়েটি নাকি দেবতনুর খুব ফ্যান। শালবনি মজা করে বলতো , “দেখো আবার প্রেমে পড়ে যেও না “। দেবতনু বলতো, “ওমন টানা টানা মায়াবী চোখ.. প্রেমে পড়া অসম্ভব নয় কিন্তু বনি। “.. ওমনি শালবনি রাগে গুম গুম করে দেবতনুর পিঠে কিল মারত। এমন রসিকতা প্রায়শই চলত দুজনের মধ্যে অদিতিকে নিয়ে।
৬ মাস আগে শালবনী লক্ষ্য করল দেবতনুর ব্যবহারে, আচরণে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসেছে। কেমন যেন গম্ভীর থাকে। সেই আগের মত আর কলেজের গল্প করেনা। প্রানোচ্ছল ব্যাপারটাও কেমন যেন উধাও ! একান্ত নিরালায় কাছে আসার চেষ্টা করলে আগের মত আর কাছে টেনে নেয় না দেবতনু ,বরং নানা অছিলায় দূরে সরে যায়। শালবনি ভাবে হয়তো সারাদিনের ক্লান্তি.. তাই এমন আচরণ। ইদানিং ফোন নিয়ে যেন একটু বেশিই সচেতন দেবতনু । কেমন যেন একটু দূরত্বে থাকার প্রবণতা। ফোন এলে বাইরের ব্যালকনিতে গিয়ে দীর্ঘ ফোনালাপ। প্রথম প্রথম শালবনি ভাবত হয়ত কলেজের কাজের চাপ। কিন্তু একটা ছোট্ট মেসেজ শালবনির সব ভাবনা গুলোকে উলোট পালোট করে দিল।
সেদিন কলেজ থেকে এসে দেবতনু ওয়াশরুমে গেছিল ফ্রেশ হতে। ফোন নিরাপদ জায়গায় রাখতে বোধ হয় ভুলে গেছিল দেবতনু । টিং টিং করে মেসেজ রিংটোন বেজে উঠল।ফোনের লকের পিনকোড তো অনেকদিনই আগেই চেঞ্জ করে দিয়েছিল দেবতনু যা শালবনি জানতোই না। শালবনি জানতেও চায়নি কেন চেঞ্জ করল তার পিনকোড । অকারণ কৌতুহল দেখানো চিরকালই শালবনির স্বভাববিরুদ্ধ। ফোনটা শালবনির সামনেই টেবিলে পড়েছিল। নোটিফিকেশনে দেখল অদিতির ছোট্ট মেসেজ ” মিস ইউ দেবতনু।” দেবতনুর এই অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করা, দূরে দূরে থাকা সবটা যেন জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল শালবনির কাছে।
একটা প্রশ্নও করলো না সে দেবতনুকে। সেদিন থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল শালবনি । শুধু রোজকার দু চারটে কথা ছাড়া দুজনের মধ্যে প্রায় কোন কথাই হতো না। আজকাল প্রায়ই কলেজের পরে দেবতনু অনেক রাত করে ঘরে ফেরে। টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া থাকে।ঘুমের ভান করে চোখ বুজে পড়ে থাকে শালবনি। বুঝতে পারে পাশের ঘরে একটা সিগারেট ধরিয়ে আমেজ করে সোফায় বসে অদিতির সাথে ফোনে কথা বলছে দেবতনু। প্রতিদিনই বুকের ভিতর কেমন একটা রক্তক্ষরণ হয়, সহ্য করে সবটা, চলতে থাকে কম্প্রোমাইজ ও মেনে নেবার খেলা। গভীর রাতে বিছানায় এসে অন্য পাশে ঘুরে শুয়ে পড়ে দেবতনু।এক ছাদের নিচে এক বিছানায় দুই নরনারী.. অথচ তাদের মধ্যে দূরত্ব শত যোজন।
ছোটবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের শালবনি বাবা মাকে একটা কথাও জানতে দেয়নি তাদের ব্যাপারে । বরং ওদের সামনে সুখী থাকার অভিনয়ই করে গেছে । আজ কি মনে হতে অনেকদিন পর ফেসবুক একাউন্টটা খুলল শালবনি। কি ভেবে দেবতনুর টাইম লাইনে গিয়ে ফ্রেন্ড লিষ্টে অদিতি রায় নামটা সার্চ করল। অদিতির টাইম লাইনে গিয়ে প্রোফাইল পিকচারে দেখলো হাসি হাসি মুখের বেশ মিষ্টি দেখতে ২২/২৩ বছরের এক তরুণীকে। চোখ দুটো টানা টানা মোহময়ী। হঠাতই শালবনির মনে পড়ে গেল দুটো লাইন , ” প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,.. তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ” .দেবতনু সেন তাহলে এই চোখ দেখেই ডুব দিয়েছে অতল জলে !
See more about Aditi Roy ‘তে ক্লিক করে অদিতির মেইল আইডিটা দেখতে পেল শালবনি। কী ভেবে মেইল আইডি’টা কপি করলো শালবনি ।
কোনোদিন অদিতির সাথে দেখা করার রুচি বা প্রবৃত্তি হয়নি শালবনির । আজ কি ভেবে নিজের মেইলটা খুলে সেন্ডার অপশনে অদিতির মেইল আইডিটা পেস্ট করলো। এবার মেইল টাইপ করতে শুরু করলো অদিতির উদ্দেশে … ” “ডিয়ার.. ঠিক কি বলে ডাকবো তোমাকে বুঝতে পারছি না… আগেকার দিন হলে হয়তো বলতাম ” চোখের বালি” কেননা তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটা বিনোদিনী আর আশালতার মতই। ধরে নাও আমি আশালতা। তুমি হয়তো ভাবছো তোমাকে আমি কী করে চিনলাম ! গত ছয় মাস ধরে তোমার প্রেমিক মানে আমার স্বামীর চোখ দিয়েই চিনেছি.. তোমার অনেক প্রশংসাও শুনেছি তার মুখে। তুমি তো ওকে খুব ভালোবাসো তাই না ? আচ্ছা তুমি কি এটা জানো যে আমি ওর জীবনের প্রথম প্রেম। শান্তিনিকতনে গেছো ? যদি কখনো যাও তাহলে আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্কের অনেক টুকরো টুকরো ছবি খুঁজে পাবে গৌড় প্রাঙ্গণ, ঘন্টাঘর, আম্রকুঞ্জ, ডিয়ার পার্ক, পূর্বপল্লির মাঠে বা শ্রীসদনের সামনে। তখন কি তুমি ছিলে ওর মনের কোনও কোনায় ? কত দুপুর সাইকেলে দুজনে গেছি খোয়াইয়ের পাড়ে… কত আদর কত সোহাগের সাক্ষী খোয়াই, সোনাঝুরি গাছ, পূর্ণিমার চাঁদ… তুমি কি ছিলে আমাদের দুজনের একান্ত নিবিড় ভাবে কাটানো ওই সময়গুলোর কোথাও ? পারবে কি নির্মূল ভাবে মুছে ফেলতে আমাদের ছয় বছরের ভালোবাসাকে ? আমাদের দুজনের একসাথে গড়ে তোলা ভালোবাসার ঘরে সর্বত্র ছড়িয়ে আছি আমি . , ওর কবিতায় , পছন্দের গানে, দুজনের পছন্দের পারফিউমে , ওকে বুনে দেওয়া আকাশী রঙের সোয়েটারে, জন্মদিনে আমার ওকে দেওয়া ঘড়ি আর ওয়ালেটে..এমনকি ওর শার্টের বোতামেও… বোতাম ছিঁড়ে গেলে আমাকেই লাগাতে হতো। জ্বর হলে ও কিন্তু আমার হাতের গরম গরম চিকেন সুপ পছন্দ করত.. অন্য কেন কেউ বানিয়ে দিলে খেতো না । পারবে তো ঠিক সেইরকম সুপ বানাতে ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে?মাঝ রাত্তিরে অবধি অফিসের কাজ করলে ঘনঘন আমার হাতের কফি চাই ওর।তুমি কিন্তু ঘুমিয়ে পরো না.. বানিয়ে দিও কেমন।
সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে আমার অস্তিত্ব.. সহ্য করতে পারবে তো তুমি ? ….যেমন করে আমাদের দুজনের মধ্যে তুমি এসে গেছো… আমার শরীরে আমার মনে । যখন দেবতনু তোমায় খোঁজে আমার মধ্যে ,,,,. অপমানের জ্বালায় আমার ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়… তোমাদের দুজনের মধ্যেও আমি থেকে যাবো চিরকাল… পারবে তো এই কষ্ট সহ্য করতে ? তখন বোলোনা যেন যে আমি তোমায় সাবধান করিনি। একটা শেষ প্রশ্ন তোমার কাছে… আজ আমার জায়গায় তুমি থাকলে কি করতে ? মেনে নিতে পারতে তো আমায় ? উত্তরটা দিও কিন্তু ।
” আশালতা “
মেইলটা সেন্ড করে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো শালবনি। এখন মধ্যরাত্রি। গোটা পৃথিবী ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু শালবনির চোখে ঘুম নেই। ঘুমেরা যেন বনধ্ ডেকেছে শালবনির চোখে ! খুব মিস করছে আজ দেবতনুকে ! আজও বড্ড ভালোবাসে যে.. সেই আগের মতোই.. তাই এত কিছুর পরেও সম্পর্কটা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অনেকদিন পর আজ শালবনির চোখে জল.. বালিশ ভিজছে। কবিগুরুর লেখা কটা লাইন শালবনি মনে পড়ে গেল — “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূরত্ব কোনটি জানো? নাহ, জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত উত্তরটা সঠিক নয়, সবচেয়ে বড় দূরত্ব হল যখন আমি তোমার সামনে থাকি, কিন্তু তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।”
লেখক পরিচিতি : অন্তরা ঘোষ
অন্তরা ঘোষ, রায়পুর ,ছত্রিশগড়