আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ১)

লেখক: মিত্রা হাজরা


আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয়
মনে আমার মনে।
সে আছে বলে, আমার আকাশ জুড়ে
ফোটে তারা রাতে
প্রাতে ফুল ফুটে রয়, বনে আমার বনে
—-রবি কবি।

নদী চলে আপন খেয়ালে, ভরা বর্ষার জলধারা বুকে ধারণ করে কূল ব্যাপী মত্ততায় দুকূল ছাপিয়ে বহে চলেছে। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে, তার রক্তিম আভা ঘোলা নদীর বুকে রঙের ফল্গুধারায় স্নান করছে যেন, গাছে গাছে সন্ধ্যার কালচে ছোপ লেগে গেছে। কলার ভেলায় ভেসে চলেছে একটা মানুষ। গাঙের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কত গ্রাম, কত জনপদ পার হয়ে ভেলা ভেসে আসছে। দুলতে দুলতে সেই ভেলা এসে ঠেকলো একটা গাছের গুঁড়ির শিকড়ে। নদীতীর ভাঙছে—মাটি আলগা হয়ে বড় একটা গাছ উলটে নদীর জলে ডুবছে ভাসছে। পাশেই গ্রাম্য ঘাট, পুরুষেরা এই ঘাটে বড় একটা আসে না কেউ, জায়গাটা মুসলমান অধ্যুষিত। কয়েকজন মুসলমান রমণী নদীতে জল ভরতে এসেছে, তাদের গ্রাম্য কথা, হাসি মস্করায় জায়গাটা আলোড়িত। ভেলার মানুষটি চেতন অবচেতনের স্তরে অসহ্য ব্যথা যন্ত্রণায় পিপাসায়— উঃ করে কাতর একটা আওয়াজ করে উঠলো ।কানে গেল রমণীদের , ভয়ে তিন চারজন জল ফেলে উঠে আলুথালু হয়ে দে দৌড়। একজন দাঁড়িয়ে গেল– আবার শুনলো—জল!

জলের কথায় রমণী আরো কাছে এসে দেখতে লাগলো—হায় আল্লা– ভেলার উপর এ তো কোনো মানুষ, আঁতকে বলল— আমরা মুসলমান বাবা, আমার হাতের পানি তো খেতে নেই, তুমি তো হিন্দু ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে। আর কোনো আওয়াজ পেল না, বুঝলো মানুষটির জ্ঞান নেই। এভাবে থাকলে তো এ মরে যাবে! কিন্তু সাথীরা ভয়ে পালিয়ে গেছে, একার দ্বারা একে ওঠানো সম্ভব নয়, রমণী একটু ভেবে দৌড়াতে দৌড়াতে এল একটা আখড়ায়, সিরাজ সাঁই এর আখড়ায়। বাবা শিগ্গির চলেন, ভেলায় একটা মানুষ ভেসে এসেছে। আপনি সাহায্য না করলে মানুষটা বাঁচবে না ।দুজনে নদীর ধারে এসে ধরাধরি করে মানুষটাকে ভেলা থেকে নামায়, দেহ ফুলে গেছে জলে থেকে, শরীরে গুটি বসন্ত ছেয়ে গেছে, তবে প্রাণ আছে। সাইজীকে জিজ্ঞাসা করে রমণী— বাবা এ বাঁচবে তো? সবই তাঁর ইচ্ছে বেটি, তিনি চাইলে বাঁচবে, কঠিন রোগ। মরা ভেবেই সম্ভবত একে ভাসিয়ে দিয়েছে। শুকনো কাপড় পরিয়ে হাত পায়ে শেঁক দিয়ে শরীর গরম করতে থাকলো, চন্দন বেটে সর্বাঙ্গে মাখানো, জরি বুটির রস খাওয়ানো, চলল দিন রাত সেবা। সাঁইজী বললেন— একটু দুধ লাগবে বেটি, ঘটি নিয়ে দুধ এনে গরম করে খাওয়ালো রমণী। কোনো সাড়া নেই মানুষটার,তবে বোঝা যাচ্ছে একটু আরাম হয়েছে মানুষ টার।

দিনের পরে রাত আসে, রাতের পরে দিন। সাঁইজী আর মুসলমান রমণীর শুশ্রূষায় একদিন চোখ মেলে চায় মানুষ টা। সাঁইজী জিজ্ঞাসা করেন—তোমার নাম কি? কোথায় তোমার গাঁ? মানুষটি সব ভুলে গেছে, শুধু মনে আছে, খুব জ্বর, শরীরে ব্যথা সঙ্গীরা তাকে কোথায় যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর দেখলো ভেসে চলেছে, আর কিছু মনে নেই। কিছুদিন পর মনে পড়ল– খুব সুন্দর এক মেয়ের মুখ, মিষ্টি হাসি— কে তা কে জানে! সে কি তার আপনার কেউ! সাঁইজীর আখড়ায় দোতারায় গান ধরেন সাঁইজী, মানুষটি গলা মেলায়, সারা মুখে বসন্তের দাগ, একটি চোখে ও দৃষ্টি নেই, তবুও মনে যেন সেই ভাবনা অহরহ– আমার নিজের মানুষ জন সব কোথায়? আর যে মিষ্টি মুখ টা মাঝে মাঝে ভেসে আসে মানসে সে কে? কি মায়াময় চোখ দুটো!
নিজের মনে গান বাঁধে —‘কার বা আমি, কে বা আমার/ আসল বস্তু ঠিক নাহি তার।’
সাঁইজী অবাক হন, মানুষটি গান বাঁধে তো বেশ, তবু যদি ওর আপনজন ফিরে পেত ভালো হতো, কিন্তু মানুষটি তো সব ভুলে গেছে! মালিকের কী ইচ্ছে কে জানে!

চলবে…

গ্রন্থ ঋণ —
লালন ভাষা অনুসন্ধান –আবদেল মান্নান
লালন সমগ্র–মোবারক হোসেন খান
লালন শাহ ফকির–মুহম্মদ আবদুল হাই।


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্কআমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ২) >>
শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।