লেখক: মিত্রা হাজরা
সিরাজ সাঁই এর সংস্পর্শে এসে লালন জেনেছেন মহাযোগের খবর। সে খবর যোগেশ্বরী কে ধরে জানতে হয়। যোগেশ্বরী—কি বিশাখা? (মতিবিবি)
হ্যাঁ বিশাখা এগিয়ে এসেছে। এযে বাউলের সাধনা, সাধনা করতে সঙ্গিনী লাগে। অথচ সাধন হয় একার! এ কেমন সাধনা?
‘বাউল তো চিরকালই একা, অনুমান বিশ্বাস করে না, বর্তমান চাই’।
গুরু বলছেন—রস রতির যোগ, সাধনায় পুরুষ আর প্রকৃতি মিশে আছে।
হাওয়া ধর, অগ্নি স্থির কর—
যাতে মরিয়া বাঁচিতে পারো
মরণের আগে মর, শমন যাক্ ফিরে।
কখনো নির্জন ঘরে, কখনো নদীর ধারে, কখনো জঙ্গলে লালনের সাধনা চলে।
অধর চাঁদ কে ধরবি যদি
দম কষে দম সাধন কর।
এই অধর চাঁদ কি? এ হলো বাউলের মুক্তির পথ, অমাবস্যায় চাঁদের আলো ধরা। এ সাধনা তন্ত্র সাধনার তত্ত্ব। এই ব্রহ্মাণ্ড দেহভান্ডে অবস্থিত, সাধন কালে সাধক মিলিত হয় প্রকৃতির(নারীর)সাথে।এ হলো সাধন পথের গুপ্ত সিঁড়ি ,অমাবস্যায় আলোর জোয়ার।
বাউল ধর্ম সাধনা একটি গুহ্য যোগক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনার সাথে সাদৃশ্য আছে। বাউল মানেই বাতুল বা উন্মাদ, স্বাভাবিক চেতনা শূন্য।
‘মানুষ ভজলে মানুষ হবি/মানুষ ছেড়ে ক্ষাপা রে তুই মূল হারাবি’। সহজ সরল শব্দের মধ্যে যে কত রহস্য লুকিয়ে থাকে তা লালনের গান অনুধাবন করলেই বোঝা যায়। লালনের গানের সুর মেঠো সুর, সেই সুর মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সেই সুরে আকৃষ্ট হয়েছিলেন রবি কবি। জমিদারী এস্টেটের কর্মী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে কবি পাঠিয়েছিলেন ছেঁউড়িয়া আশ্রমে নকল করে আনতে লালনের গান। পরবর্তী কালে তা থেকে কুড়িটি বেছে–১৩৩২–বঙ্গাব্দে প্রবাসীতে প্রকাশ করেন। এর পরেই সুধীজনের নজরে আসে বাউল গান। এই গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের বার্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। এ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক ও আছে। ছেঁউড়িয়া আশ্রম থেকে প্রচার হয় কবি লালনের আসল খাতা নাকি ফেরত দেননি আশ্রমে। তবে কবি তাঁর কিছু গানের সুর নিয়েছেন লালনের গান থেকে নিজেই বলেছেন।
কেমন দেখতে ছিলেন লালন সাঁই? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে লালন গেছেন দেখা করতে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দ্রুত কয়েকটা টান দিয়ে লালনের প্রতিকৃতি এঁকে ফেললেন। তারপর ডাকলেন–দেখুন তো, আপনার মুখখানি ঠিক হয়েছে তো? লালন দেখে একগাল হেসে বললেন— বাবুমশাই আমি কখনো আরশীতে নিজের মুখ দেখি নাই, কাজেই জানি না সে মুখ কেমন দেখতে! জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অবাক হয়ে বললেন— সেকি আরশীতে মুখ দেখেন না—আর গান বাঁধলেন আরশীনগরের! শিলাইদহে বোটের উপর সেই পেন্সিল স্কেচ রয়েছে যা লালনের একমাত্র পার্থিব অবয়ব। ছবির উপর লেখা–লালন ফকির।
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে মানবতাবাদী লালন মানুষকেই স্থান দিয়েছেন সবার উপরে।
“আমি অপার হয়ে বসে আছি—ওহে দয়াময়!
পারে লয়ে যাও আমায়”।-লালন।
গ্রন্থ ঋণ —
লালন ভাষা অনুসন্ধান –আবদেল মান্নান
লালন সমগ্র–মোবারক হোসেন খান
লালন শাহ ফকির–মুহম্মদ আবদুল হাই।
লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।