আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৪)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

আগের পর্ব শেষ করেছিলাম বৃটিশ আমলের মেটিয়াবুরুজে। সেখানে তখন হাট ভিত্তিক ব্যবসা চালু হয়নি। বরং দোকানদারি কারবার চালু ছিল। সেখানে সাহেবী কোট, প্যান্টালুন যেমন তৈরি হতো, তেমনই গাউন, স্কার্ট ইত্যাদিও সমান ভাবে সেলাই করা হতো। গোরা সাহেবদের একমাত্র পছন্দের দর্জিদের সকলেরই বাস তখন মেটিয়াবুরুজে। দোকানদারি কারবার আজও কিছু রয়েছে। শুধু অর্ডার দেওয়ার লোক বদলে গেছে। আগে যেখানে কাস্টমাররা ছিল বৃটিশ আজ সেখানে বড়বাজারের মাড়োয়ারি গদিওয়ালা।

হাট ভিত্তিক রেডিমেড গারমেন্টসের ব্যবসা চালু হয় বৃটিশ আমলের অনেক পরে। মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস মূলত বিক্রি হতো হাওড়ার মঙ্গলা হাটে। ১৯৮৪ সালে সেখানে বিরাট অগ্নিকাণ্ডের পরে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। দিশাহারা পাইকারি ব্যবসাদারদের মেটিয়াবুরুজে স্থায়ী ঠিকানা দেওয়ার উদ্দেশ্যে জব্বার সাহেব গড়ে তোলেন জব্বার হাট। তার আগে অবশ্য অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে ছোট আকারে হাট বসতো কারবালার দিকে।

কারবালা অঞ্চল বিখ্যাত ছিলো “চিন্দি কাপড়ের” কাজের জন্য। থান থেকে কেটে নেওয়ার পরে যে ৬-৭ ইঞ্চি ফালি কাপড় উদ্বৃত্ত হতো, সেই ফালি কাপড় কেই বলে চিন্দি। কারবালার ওস্তাগররা সেই ফালি কাপড় দিয়েই বানাতেন অসাধারণ ডিজাইনের ফ্রক। সেই ফ্রকের এমনই সুনাম ছিল, সুদূর দিল্লি, মুম্বাই থেকে পাইকাররা এসে সেই ফ্রক কিনে নিয়ে যেতেন।

আজ যেখানে জব্বার হাট, সেখানে আগে ছিলো জাহাজের যন্ত্রাংশ তৈরি করবার কারখানা Bravo। মালিক একজন অবাঙালি মুসলিম। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের দুর্বলতার কারণে সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। মাথার ওপরে ব্যাংকের দেনা। শোধ করবার অন্য কোনও উপায় না থাকায় মালিক বাধ্য হলেন কারখানা বন্ধ করে দিতে।

এই পরিত্যক্ত কারখানার বিশাল জমিতে গড়ে তোলা হলো জব্বার হাট। জব্বার সাহেবের লক্ষ্য ছিলো বাঙালি মুসলিম ওস্তাগরদের ব্যবসার একটি স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া। হাট তৈরি করবার পাশাপাশি শুরু হলো প্রচার। হাট বানাবার উদ্দেশ্য কি, সেটা মাইকিং করে জানানো হতো মেটিয়াবুরুজ, আক্রা অঞ্চলের ছোট এবং মাঝারি ওস্তাগরদের। তার পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়াও শুরু হলো। উদ্দেশ্য সারা ভারতের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের সাথে যুক্ত পাইকারি ব্যবসাদারদের জব্বার হাট সম্পর্কে জানানো। আর এই কাজের দায়িত্বে কে ছিলেন জানেন? আমাকে লন্ডন থেকে যিনি ফোন করেছিলেন, সেই শ্রদ্ধেয় মহম্মদ জুলফিকার আলী। তিনিই জব্বার হাটের প্রথম ম্যানেজার। এই অসাধারণ মানুষটি সম্পর্কে আলাদা করে লেখার ইচ্ছে রইলো। অসাধারণ বর্ণময় একজন মানুষ। ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়ার পরেও ওঁর হৃদয়ে আজও মেটিয়াবুরুজ রয়ে গেছে।

মূল আলোচনায় ফিরে আসি। প্রথম লটে জব্বার হাটের স্টল বন্টনের সময়ে বিনিময় মূল্য হিসেবে ন্যায্য টাকাই (বা কিছু কমই) নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে স্থির করা হয় হাটে যেমন ওস্তাগরদের জন্য স্টল করা হবে, তেমনই থাকবে ফুড কোর্ট, পার্কিং প্লেস, ট্রান্সপোর্ট (মাল কেনার পরে এখান থেকেই যাতে ক্রেতা মাল পাঠিয়ে দিতে পারেন), বাইরে থেকে আসা ক্রেতাদের জন্য ডরমিটরি, উন্নত টয়লেট, ব্যাংক ইত্যাদি।

ধীরে ধীরে হাট জনপ্রিয় হতে থাকে এবং পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দাম। তদ্দিনে জুলফিকার সাহেব পাড়ি দিয়েছেন লন্ডন। জব্বার হাটে ডরমিটরি চালু করা হলেও তা সাকসেসফুল হয়নি। এদিকে লাভের অঙ্ক বাড়তে থাকায় আদর্শ হাট বানাবার পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হলো না। ফুড কোর্ট, পার্কিং প্লেস, উন্নত টয়লেট, ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি হিসেবেই রয়ে গেলো। তুলনামূলক ভাবে জব্বার হাটের টয়লেট খানিকটা ভদ্রস্থ হলেও বাকি হাটের অবস্থা অবর্ননীয়।
জব্বার হাটকে দিয়েই এই অঞ্চলে হাট ভিত্তিক ব্যবসার সূত্রপাত। এরপরে গড়ে উঠেছে একের পরে এক হাট। জলের মতো আসতে শুরু করেছে টাকা। দুঃখের হলেও এটা সত্যি, সেই টাকার বেশিরভাগের রঙই কালো। আর এই ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখতে গড়ে উঠেছে সিণ্ডিকেট। যার কাজ নতুন হাট নির্মাণ, স্টল বন্টনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।

হাট ভিত্তিক ব্যবসা জব্বার হাটকে দিয়ে শুরু হওয়ার পরে গড়ে উঠেছে আরও অনেক গুলি হাট। বর্তমানে বড়ো হাটের সংখ্যা ১০ (হাটের সংখ্যায় বা নামে যদি ভুল থাকে, সংশোধন করে নেওয়া যাবে) –
জব্বার হাট (স্টল সংখ্যা ৪০০০), A.B. M হাট (স্টল সংখ্যা ৮০০০), মোতি হাট (স্টল সংখ্যা ২০০০), এক্সপ্রেস হাট (স্টল সংখ্যা ১৫০০), সুপার হাট (স্টল সংখ্যা ১৫০০), রিমঝিম হাট (স্টল সংখ্যা ১০০০), জনতা হাট (স্টল সংখ্যা ১০০০), বাবা হাট (স্টল সংখ্যা ৫০০), কোয়ালিটি হাট (স্টল সংখ্যা ৩০০), মণ্ডল হাট (স্টল সংখ্যা ২০০)।

মোটামুটি স্টল সংখ্যা ২০০০০। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ বহু স্টলে ৩-৫ জন বিক্রেতা শেয়ার করে বসে। ফলে সেসব ধরলে স্টল মালিকের সংখ্যা ৫০-৬০ হাজারের কম নয়। এদের অধিকাংশই ছোট ওস্তাগর, যাদের অনেকেই সপ্তাহে ১০-১২ ডজন মাল রেডি করে বিক্রি করে সংসার চালায়। এছাড়া ছোট ছোট হাটও রয়েছে বেশ কয়েকটি।

যারা মনে করছেন মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস ব্যবসার সাথে শুধু মাত্র এই এলাকার মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই এই ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে আছে দুই চব্বিশ পরগণা, হাওড়া এবং হুগলির বহু পরিবার। মেটিয়াবুরুজের বহু ওস্তাগর কাটিংয়ের পরে বাকি কাজের জন্য আউট সোর্সিংয়ের ওপরে নির্ভরশীল। লক্ষ্য প্রোডাকশন কস্ট কম করা।

এখানেই শেষ নয়। হাটে মাল পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ভ্যান চালক, ট্যাক্সি চালক, খাবারের দোকানী, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, মেশিন রিপেয়ারিং ইঞ্জিনিয়ার, কাপড় গুদামের মালিক, অ্যাক্সেসারিজ (বোতাম, চেন ইত্যাদি) বিক্রেতা, GST Consultant… পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকা মানুষের সংখ্যাও আরও কয়েক লক্ষ।
হাট এবং স্টল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। হাট গুলির মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনের হাতে রয়েছে। এঁরা আর্থিক এবং রাজনৈতিক, দুই দিক থেকেই বিপুল ক্ষমতাশালী। ফলে এদের সাথে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা সাধারণ ছোট বা মাঝারি ওস্তাগরদের স্বপ্নের বাইরে।

ধরা যাক একটা নতুন হাট নির্মাণ হবে এবং তার স্টল বন্টন করা হবে। যেহেতু মাঝারি এবং ছোট ওস্তাগরদের পক্ষে শোরুম কিনে তাদের প্রোডাক্ট ডিসপ্লে এবং বেচাকেনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তাই তাদের এক এবং একমাত্র ভরসা হাটের স্টল কেনা/লিজে নেওয়া। নিয়ম অনুযায়ী হাটে ফুড কোর্ট, কার পার্কিং ইত্যাদি রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে সেটা করা হয় না। হাট মালিক পারলে টয়লেটের জায়গাতেও স্টল বসানোর পক্ষপাতী। তাই ভালো পজিশনে স্টল পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একটা স্টলের বেস প্রাইস পজিশন অনুযায়ী ১০-৫০ লাখ টাকা। আপনি যে দামের স্টলই কিনুন, রসিদ দেওয়া হবে ৫০ হাজার টাকার। বাকি পুরোটাই “কৃষ্ণ ধন”। আবার সেই স্টল যখন হাত বদলী হবে, পুনরায় হাট মালিককে ওই বেস প্রাইসের ২০% কমিশন দিতে হবে। ফলে ছোট / মাঝারি ওস্তাগরদের অবস্থা দাঁড়ায় শাঁখের করাতের মতো। কিনতে এবং বেচতে গেলেই দিতে হবে নগদ টাকা। নতুন কোনও হাট নির্মাণ হলে বড়ো বড়ো ওস্তাগরদের কাছে আগে খবর চলে যায়। আর তারা হাট নির্মাণ হওয়ার আগেই ভালো পজিশনে থাকা স্টল গুলি বুক করে ফেলে ৭৫% টাকা দিয়ে। বহু ওস্তাগরের হাতে ২৫-৩০ টা স্টলের মালিকানাও রয়েছে। এরপরে তারা তাদের হাতে থাকা স্টল চড়া দামে আবার লিজ/বিক্রি করে। পুরোটাই বোঝাপড়ার ওপরে। ফলে অভিযোগ জমা হয় না। দুর্নীতি চলতেই থাকে।

ব্যতিক্রম হিসেবে দুটো বিষয় রাখা দরকার। জব্বার হাট কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই এবং মোতি হাট কর্তৃপক্ষ রিসেন্টলি মালিকানা বদলে (নাম ফেরতাই) টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা আশা করতে পারি আগামী দিনে বাকি হাট মালিকরা এই দুই হাট মালিকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গরীব ছোট ওস্তাগরদের এক্সপ্লয়েট করা বন্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন।

এর পরের পর্বে থাকবে হাট ভিত্তিক ব্যবসা কিভাবে যানজট সৃষ্টি করছে এবং তার থেকে পরিত্রাণের উপায় কি। অবশ্যই সাথে আপনাদের চাই। কারণ যে হারে পাঠকের সংখ্যা কমছে, তাতে আদৌ এই লেখা আর চালানোর দরকার আছে কি না, ভাবতে হবে।

চলবে…


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৩)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৫) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।