আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৫)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

এলাকার মানুষের অভিযোগ শনি এবং রবিবার হাটের দিনে এমনকি পায়ে হেঁটেও যাতায়াত করা দুঃসাধ্য। যারা হাটের আশেপাশে থাকেন, তাদের ছেলেমেয়েরা কেউই শনিবার স্কুলে যায় না (যানজটের কারণে যাওয়া সম্ভব হয় না)। কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হতে পারে (কোনও মনগড়া গল্প বলছি না)। কিন্তু কেন এই যানজট? এই যানজটের জন্য হাট মালিকদের দায় কতটা? আসুন একটু আলোচনা করে দেখা যাক।

মেটিয়াবুরুজের হাটগুলির মূল চালিকাশক্তি ছোট ওস্তাগররা। হাটগুলি বানানোর প্রাথমিক এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো এই ছোট ওস্তাগররা যাতে সর্ব ভারতীয় বাজারে তাদের মাল বিক্রি করবার সুবিধা পায়। কারখানা থেকে মাল হাটের স্টলে নিয়ে আসা এবং দিনের শেষে অবিক্রীত মাল আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই দুই ক্ষেত্রেই বয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে লোকাল ট্রান্সপোর্ট দরকার। ভ্যানে পার ট্রিপে ভাড়া লাগে মোটামুটি ১০০ টাকা। অথচ ওই ১০০ টাকার তেলে বাইকে চেপে অন্তত বার চারেক মেটিয়াবুরুজের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আসা যাওয়া যায়।

তাই ছোট ওস্তাগরদের মাল পরিবহনের একমাত্র বাহন বাইক বা স্কুটি। আগের পর্বে হাট ধরে মোট স্টলের সংখ্যা সম্বন্ধে আইডিয়া দিয়েছিলাম। মোটামুটি স্টল সংখ্যা ২০০০০। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ বহু স্টলে ৩-৫ জন বিক্রেতা শেয়ার করে বসে। ফলে সেসব ধরলে স্টল মালিকের সংখ্যা ৫০-৬০ হাজারের কম নয়। এদের অধিকাংশই ছোট ওস্তাগর, যাদের অনেকেই সপ্তাহে ১০-১২ ডজন মাল রেডি করে বিক্রি করে সংসার চালায়। এছাড়া ছোট ছোট হাটও রয়েছে বেশ কয়েকটি।

তাহলে ভেবে দেখুন সপ্তাহে দুই দিন যদি গড়ে হাজার ত্রিশেক বাইক/স্কুটি এক জায়গায় পার্কিং করা হয়, তাহলে সেই রাস্তার অবস্থা কি দাঁড়ায়! বোঝার ওপরে শাকের আঁটির মতো রয়েছে ট্যাক্সির লাইন। মেটিয়াবুরুজে ট্যাক্সি জন পরিবহণে নয়, মাল পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। ট্যাক্সির ডিকি উপচে পড়ে গাঁটরির চাপে। তার সাথে ‘ছোট হাতি’, ভ্যান রিকশা, টাটা ৪০৭, এক কথায় মাল পরিবহনের জন্য সম্ভাব্য সব বাহনের সমাবেশ হয় এখানে। আর ওভার লোডিংয়ের ফলে হামেশাই ঘটে অঘটন।

ট্যাক্সির একটা লাইন থাকার কথা। কথাতো বটে, কিন্তু মানে কে? ফলে ভোগান্তি অনন্ত। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ট্রাফিকের লাইন। তারই ফাঁক ফোকর দিয়ে মাথা গলিয়ে দেয় বেপরোয়া বাইক, অবাধ্য অটো চালক। আপনি বাইরে থেকে এলে আপনার মনে হতেই পারে এরই নাম বোধহয় নরক গুলজার।

শনিবার থেকে হাটের দিন শুরু। কিন্তু শুক্রবার দুপুর থেকেই মাল পরিবহনের তোড়জোড় দেখা যায়। ফলত গাজীপাড়া চত্ত্বর থেকে সে সমস্ত শিক্ষার্থীরা বড়তলা লাইব্রেরী স্কুলে আসবে,তারাও যানজটের জন্য স্কুলে আসতে চায় না। বিশেষ করে মেয়েরা এই ধরনের ঝামেলা এড়িয়ে গিয়ে স্কুলে না এসে ঘরে থাকাটাই বেশি পছন্দ করে। যেখানে অতীতে আলোচনা হয়েছে এই এলাকার ছেলে-মেয়েরা উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে, সেখানে এই হাটনির্ভর ব্যবসার জন্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ব্যাপারে এলাকার শিক্ষানুরাগী মানুষজনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ব্যবসা অবশ্যই দরকার,সাথে শিক্ষাও দরকার। তাই একটার জন্য যাতে অন্যটা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা মাথায় রাখা দরকার।

তার সাথে দরকার এলাকার মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন। বিপুল পরিমাণ যানজটের জন্য অতিরিক্ত গাড়ি,পার্কিং ব্যবস্থা ভালো না থাকার পাশাপাশি মানুষের ঔদ্ধত্যও সমানভাবে দায়ী। মূলত এই যানজটের কারণে প্রত্যক্ষভাবে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হাট সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা।

অন্যান্য এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা বাইক/স্কুটার নিয়ে ইচ্ছামত পার্কিং করার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসলে তবেই এই সমস্যার নিরসন সম্ভব। পাশাপাশি দরকার কড়া আইন। যে মানুষটা হাটের দিন নিজের পিতৃপুরুষের জায়গীর ভেবে তার বাইক/স্কুটার ইচ্ছামতো পার্কিং করে, কেউ বলতে গেলে তেড়ে আসে, সেই লোকটাই আবার পার্কস্ট্রিটে গিয়ে ঠিকই পার্কিং খুঁজে নিয়ে ঘন্টা হিসাবে গাড়ি রাখে। আইনের ফাঁক গলে এই কু অভ্যাস ত্যাগ করলে তবেই না আমরা সু নাগরিক হতে পারব।

সমাধান কোন পথে?

মেটিয়াবুরুজের লাইফ লাইন হচ্ছে এস এ ফারুকী রোড। এর সাথে রয়েছে মারি রোড এবং কারবালা রোড। অধিকাংশ হাটগুলিই এই রাস্তার ওপরে। হাটের দিনে (শনিবার এবং রবিবার) এই রাস্তাগুলি দিয়ে পায়ে হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর। যদি মেটিয়াবুরুজকে যানজট মুক্ত করতে হয়, তাহলে একদিকে যেমন হাট মালিকদের উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনই স্থানীয় ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, স্থানীয় মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বও কম নয়।

জব্বার হাট ও A.B.M হাটের পার্কিং স্পেস আছে কিন্তুু সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হয় না বা ব্যবহার করা জন্য হাট মালিকদের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। বাকি আর কোন হাট বা মার্কেটের পার্কিং স্পেস নেই, হাট মালিক ও মার্কেট মালিকদের উদ্যোগ নিতে হবে পার্কিং স্পেস তৈরি করবার। কারণ পার্কিং লট না বানালে মেটিয়াবুরুজে হাট বারে জ্যাম হবেই। এবং যদি কোনও বড়ো অগ্নিকান্ড বা দুর্ঘটনা ঘটে, কিংবা কারোকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে একটা ম্যাসাকার হওয়া আশ্চর্য নয়। হাট মালিকরা তার দায় এড়াতে পারেন না। সুতরাং এলাকার মানুষের স্বার্থে, মানুষের মঙ্গলের জন্য হাট মালিকদের এই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

হাট মালিকদের পক্ষ থেকে প্রতিটি হাটে অন্তত ৮-১০ জন ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা দরকার। এদের কাজ হবে হাটের সামনে যাতে বাইক পার্কিং না করা হয়, সেটা সুনিশ্চিত করা। এবং ভলান্টিয়াররা হাটের স্টল মালিকদের বাইক বা অন্য বাহন পার্কিং স্পেসে রাখবার কাজ সুনিশ্চিত করবে।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং ক্লাব গুলির দায়িত্ব: জনগণ কে সচেতন করা। সচেতন নাগরিকই পারবে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে। নিয়মিত প্রচার, মাইকিং করে মানুষের সাহায্য চাওয়া। মেটিয়াবুরুজ জ্যাম মুক্ত হলে আখেরে সাধারণ মানুষের লাভ। শুধু নেতাদের দোষ দিয়ে, গাল পেড়ে লাভ নেই। নিজেদের দায়িত্ব যদি আমরা নিজেরা পালন না করি, তাহলে কেউ আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।

পুলিশ প্রসাশনের দায়িত্ব: হাটের দিন গুলিতে ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক সিস্টেম চালু করা দরকার। এবং তার সাথে অবশ্যই বেআইনী পার্কিং বন্ধ করা দরকার। এই কাজে অঞ্চলের শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের একযোগে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় অঞ্চল কে জ্যাম মুক্ত, বে আইনী পার্কিং মুক্ত করে তুলতে হবে। প্রয়োজন হলে স্থানীয় বিধায়ক, কাউন্সিলারদের কাছে দরবার করতে হবে। তাঁদের এই সমস্যা সম্পর্কে বোঝাতে হবে, যাতে তাঁরাও এগিয়ে আসেন এই কাজে মদত দিতে। বে আইনী পার্কিং এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। লাগাতার ভাবে পুলিশ যদি বে আইনী পার্কিং করা গাড়ি তুলে নিয়ে যায়, এবং কোনও রাজনৈতিক চাপের কাছে নত না হয়, তাহলে আমার বিশ্বাস ১৫ দিনে ছবি বদলে যাবে।

ওস্তাগরদের দায়িত্ব: মাল আনা নেওয়ার কাজে বাইক/স্কুটি ব্যবহার করা দরকার। তবে সেটা হাটে নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিং করাটাও জরুরি।

আমাদের লক্ষ্য যানজট মুক্ত, পরিচ্ছন্ন মেটিয়াবুরুজ। আর এই কাজে হাট মালিক এবং ওস্তাগর, উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর যে কোনও সমস্যা সুষ্ঠু আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করা সম্ভব। আসুন আমরা সকলে মিলে এক নতুন মেটিয়াবুরুজ গড়ে তুলি। নয়তো আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।

চলবে


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৪)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৬) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।