আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৬)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

শোষণের আর এক নাম : রুক্কা
শুধু মাত্র হাট মালিকই নয়, মেটিয়াবুরুজের ছোট এবং মাঝারি ওস্তাগরদের শোষণ চালানোয় বড়বাজার এবং মেটিয়াবুরুজের গদি মালিকেরাও পেছিয়ে নেই। তবে এই শোষণের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে শোষিত এবং শোষক, উভয়েই একে শোষণ বলে মনে করে না।
আজব মনে হচ্ছে, তাই তো? একটু তলিয়ে দেখা যাক বিষয়টা। তাহলে হয়তো পরিস্কার হতে পারে। প্রথম যে টার্ম নিয়ে আলোচনা করতে চাই তাকে মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগর ভাইয়েরা কেউ বলেন ‘রোক্কা’, কেউ বলেন ‘রুক্কা’। তা সে রোক্কা কিংবা রুক্কা, যাই হোক না কেন, জিনিসটা কি?
এক কথায় রুক্কা অথবা রোক্কা এক ধরনের Promissory Note। প্রমিসারি নোট কাকে বলে? আরে আপনার পকেটে যে টাকা রয়েছে, সাধারণ সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটাকেই বলে প্রমিসারি নোট। প্রমিসারি কথাটার সাথে প্রমিস বা প্রতিজ্ঞা জড়িয়ে রয়েছে। একটু বিস্তারে বলা যাক। Reserve Bank of India Act 1934 এর Section 22 অনুযায়ী এক টাকার নোট ছাড়া বাকি সব নোট ছাপানোর অধিকারী একমাত্র রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। আর এক টাকার নোট ছাপানোর অধিকারী ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রক। তাই এক টাকার নোটে ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের সেক্রেটারি এবং অন্যান্য নোটে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের সই থাকে।
তা সেই প্রমিস বা প্রতিজ্ঞাটা কি? ধরা যাক আপনার কাছে একটা একশ টাকার নোট রয়েছে। প্রতিজ্ঞাটা হচ্ছে সরকার ঘোষণা করছে “যার কাছে এই নোটটি রয়েছে, তার মূল্য একশ টাকা”। অর্থাৎ ওই কাগজের টুকরোর বিনিময়ে আপনি একশ টাকার জিনিসপত্র কিনতে পারবেন এবং সরকারের পক্ষে ফিনান্স সেক্রেটারি অথবা রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর সেই গ্যারান্টি দিচ্ছেন।
এছাড়াও অনেক ধরনের প্রমিসারি নোট রয়েছে। বিল, হুন্ডি এমনই সব প্রমিসারি নোট। এবং সবগুলিরই আইনী ভিত্তি রয়েছে। অন্যদিকে প্রচুর বে আইনী নোটও বাজারে চালু রয়েছে। হাওয়ালা তার মধ্যে অন্যতম। এই বে আইনী প্রমিসারি নোটের কোনও আইনী গ্যারান্টি নেই। আপনার টাকা যদি চিট হয়, কোনও আদালতে আপনি অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না। রুক্কা বা রোক্কাও এক ধরনের প্রমিসারি নোট, যার কোনও আইনী ভিত্তি নেই।
ধান ভাঙতে শিবের গীত কেন? আসলে এটা বোঝানোর জন্য যে রুক্কা বা রোক্কার কোনও আইনী ভিত্তি নেই। কাল যদি কোনও গদি মালিক টাকা দিতে অস্বীকার করে, বিশ্বাস করুন কোনও আইন-আদালতের দরজায় মাথা কুটেও লাভ নেই।
যাঁরা রেডিমেড গারমেন্টস ব্যবসার সাথে যুক্ত নন, তাঁদের জন্য রুক্কা/রোক্কা নিয়ে একটু বলা দরকার। ছোট, মাঝারি কিংবা বড়ো, সব ওস্তাগর একদিকে হাটে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে মাল বিক্রি করে। আবার মেটিয়াবুরুজ/বড়বাজারের গদিতেও মাল দেয়। হাটে যে মাল বিক্রি হয়, তার বড়ো অংশই নগদে বিক্রি হয়।আর খানিকটা ধারে। কিন্তু গদিতে যে মাল দেওয়া হয়, তার বড়ো অংশই দেওয়া হয় রুক্কা/রোক্কার বিনিময়ে। ধরা যাক একজন ওস্তাগর সপ্তাহে ৫০ ডজন ফ্রক কাটেন। তাঁর টার্গেট থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুঁজি ফিরিয়ে এনে আবার মাল বানানো। তবেই পুঁজি রোল করানো সম্ভব। সে তার উদ্বৃত্ত মাল নিয়ে গদিতে বেচে। গদি মালিকেরা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না। তারা সামান্য নগদ আর বাকি মাল রোক্কার বিনিময়ে নিয়ে নেয়। রোক্কায় লেখা থাকে “xxxxx ডজন ফ্রক, আর থাকে পেমেন্ট কবে দেওয়া হবে সেই ডেট। আর থাকে একটা সই”। ব্যাস, গল্প শেষ। পোষালে মাল দাও, আর নয়তো ফোটো।
বকেয়া পেমেন্ট কবে দেওয়া হবে? মোটামুটি ১৫ দিন থেকে ৩ মাস পরে। এখন কয়েক টা প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়।
প্রথমত : রুক্কার কোনও আইনী স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় এই অবৈধ আর্থিক লেনদেন চলতে পারে? কারণ এর ফলে সরকারি কোষাগার সরাসরি বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে।
দ্বিতীয়ত : যেহেতু রুক্কার কোনও আইনী বৈধতা নেই, ফলে রুক্কা কোনও ভাবে হারিয়ে গেলে থানায় ডায়েরি ইত্যাদি করা সম্ভব নয়। কোনও গদি মালিক টাকা দিতে দেরি করলে বা টাকা না দিলে, তার বিরুদ্ধে কোনও আইনী ব্যবস্থা নেওয়াও যাবে না।
রুক্কার ফলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছোট এবং মাঝারি ওস্তাগররাই। কারণ গদি মালিকদের সাহসে কুলাবে না বড়ো ওস্তাগরদের টাকা চিট করবার। ফলে বড়ো ওস্তাগরদের রুক্কা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। অন্যদিকে ছোট এবং মাঝারি ওস্তাগররা যে এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেই ধারণাও সম্ভবত তাদের নেই। তাই গদি মালিকেরা নিশ্চিন্তে একটা অবৈধ এবং বে আইনী কারবার দিব্বি জমিয়ে চালিয়ে যেতে পারছে।
ছোট এবং মাঝারি ওস্তাগররা একবার বিষয়টা ভেবে দেখবেন। নয়তো এই বে আইনী ব্যবসা চলতেই থাকবে।


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৫)আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৭) >>

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।