অ-পার বাংলা

লেখক : গৌতম ঘোষ-দস্তিদার

ভ্রান্তিবিলাস নাকি নিছকই অপৃথকযত্ন সে এক লব্জ-সংস্কারবশ, জানি না – বলা ভাল – জানার চেষ্টাও করি না। এমন কিছু কথা তো নিত্যই থেকেই যায়, কানের ভিতর দিয়ে এসেও যারা ঠিক যেন মরমে পশে না। সেইসব কথাদের উচ্চারণ বাগ্-যন্ত্রের দেওয়াল টপকিয়ে হৃদয়ে গিয়ে বুঝি ‘বাগদান’ করে উঠতে পারে না। সেইসব শব্দমালাকে সাজিয়ে গুজিয়ে একটা যদি তালিকা প্রস্তুত করে নিতে পারতাম, ফর্দের একেবারে মাথায় বোধ হয় বসে থাকত – “এপার বাংলা ওপার বাংলা”! কথা দুটো শুনে শুনে ম্লান হই তবু মান হয় না। জীবাণুর সহবাসে হয়ত সয়ে গেছে সবই। বরং নতমুখ হই শুনে। গোটা অস্তিত্বের সুষুম্নাকাণ্ড দিয়ে বইতে থাকে সঙ্কোচের বিহ্বলতা। এ বুঝি সভ্যতারই আরেক সঙ্কট। তিরতির করে বইতে থাকা সন্দেহের নোনাজলের একটা কৃশকায় ধারা। আপাত সঙ্কীর্ণ হলেও স্থায়ী বসতবাড়ির অলীক স্বপ্নে সে স্রোতস্বিনী মশগুল হয়ে থাকে।

দেখতে দেখতে সে তো প্রায় সাড়ে চার দশক হতে চলল, কবে সেই ‘দ্বিধাগ্রস্ত’ পশ্চিম বার্লিনের চেক পয়েন্ট চার্লির সংগ্রহশালায় বিবসনা এক নারীকে শুয়ে থাকতে দেখে নয়ান-জুলিতে নেমে এসেছিল সেই জার্মানিরই এল্বে নদী। এল্বে হল সেই নদী জার্মানির শরীরে যে ভাগ বসিয়েছিল, পূর্ব পশ্চিমকে এপার ওপার করার পাগলপারা চেষ্টা করেছিল। পারেনি। চেক পয়েন্ট চার্লির সেই রমণীর শরীরেও তবু সে-বেলা দাগ কেটে গিয়েছিল দু-ভাগের দুর্ভাগ্য! মহাযুদ্ধের বিক্ষিপ্ত ঢেউ একদিন না একদিন ঠিক সরে যায়; কেন জানি না রক্তস্নাত অশ্রুসিক্ত ভারি ভেজা বাতাসের এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে থাকে তার শুকিয়ে না উঠতে চাওয়া ক্ষতগুলো।

সেই নারীর কাছ থেকে, সেই ছিন্নকায়া জন্মদাত্রীর কাছ থেকে বেদনাবিধুর যেদিন বিদায় নিয়েছিলাম সেদিন আকাশের পানে চেয়ে বলে উঠেছিলাম – পারলে এই সৌন্দর্যকে আত্মমিলিত হতে দিও, পুনর্জীবনের সঞ্জীবনী এনে দিও। দেখতে না দেখতে তার ঠিক দেড় বছরের মাথায় মাথায় নয়-এগারো মানে নয়ই নভেম্বর ১৯৮৯-এ মানুষ আবার বিজয়ের হাসি হাসিল করল। টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল বিশ্বযুদ্ধের রেখে যাওয়া বার্লিনের শেষ দেওয়ালগুলো – নরঘাতকের পদচারণ – মানবের বিপথগমন। আর তাতেই কি পার পেয়ে যাবে বলে ভেবেছিল তথাকথিত সভ্যের দল? যুদ্ধবাজের শেষ দেখে ছাড়ল মনুর পুত্র। পৌনে এগারো মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এসে গেল সেই তেশরা অক্টোবর ১৯৯০ – জার্মানি আবার শুধরে দিল ভূগোলের গোলযোগ। এতদিনের ‘দিকভ্রান্তি’ – পুব পশ্চিম যে যার চক্রব্যূহ ফেলে খালি হাত ফিরে গেল। কবে সেই হারিয়ে যাওয়া নিজেকে নিজেরই মধ্যে আবার ফিরে পাওয়ার উল্লাস এসে গ্রাস করে নিল প্রাচীন পাপের রেখে যাওয়া শেষ অনুশোচনাকে – বাষ্প হয়ে আকাশপথে পুনর্যাত্রা করল যাবতীয় হীনমন্যতার লবণহ্রদ সে এক!

আর এই আমরাই বা খামোখা হঠাৎ করে কেনই বা মেনে নেব জাতের নামে এহেন বজ্জাতিকে? বাংলা তো আদ্যন্ত অবশ্যই অ-পার; তার আবার এপার ওপার কোত্থেকে এলো আজও হৃদয়ঙ্গম করে উঠতে পারিনি! পণ্ডিতেরা বিবাদ তো বাঁধাবেনই লয়ে তারিখ সাল! ওটা ওঁদের কাজ, ওঁরা কাজ করেন।  কিন্তু আপামর আমার আপনার মতো সাধারণের তাতে কী বড় এলো গেল? আজন্ম তো এই নিজেরই চোখ-জোড়া জুড়ে দেখেছি প্রিয় স্বদেশের একত্ব – অভাগী বাংলার ভাগিত বাংলার এক এবং অদ্বিতীয় অস্তিত্বের ষোল আনা মুন্সিয়ানা তো সেই এক শামিয়ানার নিচে। সেই বাংলা কোনো ভূগোলের কোনো ইতিহাসের কোনো রাজনীতির তোয়াক্কা করে না। বাংলা সেখানে এই গ্রহের এমন একটা অবস্থান যার বুকের উপর এলোচুলে রোদ পোয়ায় জগতের সুন্দরতম ধ্বনিমুখর শব্দসুন্দর একটি ভাষা তার বাচকদের নিয়ে।

১৯৯৬ সালের গরমে। দশই মে, শুক্রবার। প্যারিসের উপকণ্ঠে এক রবীন্দ্রজয়ন্তীর পাড়াতুতো অনুষ্ঠান। ফরাসি দেশের জনপ্রিয়তম বাঙালি অসীম রায়ের ব্যবস্থাপন। বাংলার জন্য – কেবলই বাংলার জন্য সে একটা অদ্ভুত প্রেম ছিল কলকাতার বেকবাগানের আর প্যারিসের লে বাকোনে-র এই অসীম-কাকার ! ওঁর এই বাড়িতে বসেই “ছবির দেশে কবিতার দেশে”-র অনেকটা অংশ দেখেছিলেন আর লিখেছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অসীম-কাকার এই বাগানবাড়িটা আসলে ছিল প্যারিসের কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া। এমন বাংলা বই নেই যে ওখানে পাওয়া যায় না । সেই জলসাতেই সেদিন আলাপ নোয়েলের সঙ্গে। দেখা হতে প্রথমেই বলল, না না ফরাসি একদম না; বাংলা না বললে তো যেটুকু শিখতে পেরেছি, ভুলেই মেরে দেব। মুখে তো আমার কথা সরে না। হতবাক নই, হৃতবাক আমি। নোয়েল তদ্দিনে একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলেছে খাস বাংলায়। বাংলাদেশে নেয়ে-খেয়ে সে ফরাসি মেয়ে বাংলা ও বাঙালির জীবনকে লক্ষ্য করেছে বছরকে বছর আর সেই উপলক্ষে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর একাধিক সৃজনপ্রয়াস।

অসীম রায়ের বাড়িতেই আলাপ ওঁরই মত ফরাসি রাজধানীর আরেক বাসিন্দা ভাটপাড়ার লোকনাথ ভট্টাচার্যের (৯ অক্টোবর ১৯২৭ – ২৩ মার্চ ২০০১) সঙ্গে। “বাবুঘাটের কুমারী মাছ” সমেত তাঁর কম করেও খান বিশেক বই ফরাসিতে ভাষান্তরিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে নিজের মাতৃভাষায় আর্তর র‍্যাঁবো, অঁরি মিশো, হ্রনে দেকার্ৎ-এর অনুবাদ করেই চলেছেন। স্বাধীনোত্তর বাংলায় লোকনাথ ছিলেন সেই পুরনো গাঁয়ের যোগী যাঁকে আমরা এখনো খুব কমই চিনি। তাঁর ফরাসি অর্ধাঙ্গিনী ফ্রঁস ভট্টাচার্যই বা কম যান কীসে? লোকনাথের সমগ্র সৃজনকর্মকে ফরাসিতে অনুবাদ করেই ক্লান্ত হননি  ফ্রঁস, বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম উপন্যাসগুলোকেও তাঁর মাতৃভাষায় রূপ দিয়েছেন – বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, ‘কপালকুণ্ডলা’, রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’, ‘চারুলতা’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ – অগুনতি।

স্ত্রাসবু্র্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম মাদাম অঁদ্রে বুশমানের ক্লাসের দরজা খুলে ভিতরে যেতে পারলাম, সেদিনই দেখা হল সাইদ আহমেদের সঙ্গে। ১৯৮৭-র সেপ্টেম্বর। ওঁর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গেল। বৌদি এলিজাবেৎ তো দেখেই বলে, “ভাত খাবা নাকি?” ওঁদের গ্রাম আতেন (Hatten)-এর মতই সুন্দর ওঁরা নিজেরাও। দুটি সন্তান – জোয়েল আর লিদিয়া। বিয়ের আগে পর্যন্ত ঢাকার হাসপাতালে চাকরি করে এসেছে দুজনে। এখন কিছুদিনের জন্য ফরাসি দেশে থেকে ওঁরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু গবেষণাধর্মী কাজকর্ম করে আবার ঢাকায় ফিরে যাবেন। যতবার একা এমনকী সপরিবার স্ত্রাসবু্র্গ গেছি ওঁদের আতিথেয়তা নিতে সে একরকম বাধ্যই হয়েছি বলতে গেলে। 

১৯২১-এর বসন্তে এপ্রিলের উনতিরিশ তারিখ অব্দি রবীন্দ্রনাথ এই স্ত্রাসবু্র্গে ছিলেন। এখানেই কবিকে ও তাঁর বিশ্বভারতীকে প্রথম প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন স্ত্রাসবু্র্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিল্ভ্যাঁ ল্যভি। বিশ্বকবির পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ভারতবর্ষের গোটা আত্মাটা জমা আছে ওঁর হৃদয়ে। কমই বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই বাঙালি যাঁর কাছে পৃথিবীটা একটা দেশ – মানুষের একটাই ঠিকানা।

দুঃখের কথা – প্রাণান্তকর দুঃখের কথা – এহেন বিশ্বকবিকে নিয়েও এপার-ওপার তর্জা আছে। তিনি শিলাইদহের না কি জোড়াসাঁকোর না কি বোলপুরের – এ নিয়ে তো লক্ষ লড়াই। লড়াই করে কে না চায় বাঁচতে? কিন্তু সে কি আদপেই বাঁচা না কি মৃত্যুরই ডাকনাম যেন? আখেরে কী ফায়দা তাতে? কথাকার রবীন্দ্রনাথ কোথাকার নন? তিনি তো বিশ্বকবি নন কেবলমাত্র, তিনি বিশ্বপথিক – দেশে দেশে তাঁর ঘর – একান্তই যদি হেথা নয় তো অন্য কোথা অন্য কোনোখানে!

আর আমাদের এই প্রত্যেকের – তা সে এপারেরই হই কি ওপারেরই – প্রত্যেকের প্রাণই তো আস্ত একেকটা রবীন্দ্রনাথের টুকরো দিয়ে তৈরি – নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা যেন। কার না হৃদয়ে রবীন্দ্র-জীবনানন্দ-নজরুল-সুকান্ত খেলা করে? কেউ কেউ সে খেলায় মুগ্ধ হয়ে থাকি, কেউ দেখেও না দেখার ভান করি, কেউ বা আবার খুব দেরি করে হলেও মুখ তুলে চাই একবারটি – “ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে, সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে”!     

লেখক পরিচিতি : গৌতম ঘোষ-দস্তিদার
প্রাক্তনী - প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, স্ত্রাসবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতবর্ষে ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে তিন দশক জুড়ে বাংলা ইংরেজি ও ফরাসি পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে শখের সাংবাদিকতা। অধুনা অবসরে সৃজনশীল লেখা, সম্পাদনা ও অনুবাদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।