লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
আজ তিন্তিড়িকে এই পিঠখোলা পোশাকে খুব সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর আর আগে লাগেনি কখনও। অনেকটা মদ পেটে পড়ার পর রাকেশের অন্তত তাই মনে হচ্ছে। তিন্তিড়ি সাত্যর সাথে ডান্সফ্লোরে নাচতে ব্যস্ত। রাকেশের সাথে লাউঞ্জে বসে লিনি। হাতের ড্রিঙ্কটা শেষ করে লিনিও ডান্সফ্লোরে যাবার জন্য পা বাড়াল। রাকেশ একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল লিনিকে, “নিবি?”
“আর সিগারেট না। লেটস গো না!” রাকেশের হাত ধরে টানল লিনি।
“তুই জয়েন কর না। আমি আসছি।” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল রাকেশ ।
লিনি গেলে তাকেও দেখতে থাকল রাকেশ। তার চোখদুটো ডুবে আছে নেশায়। আর সেই চোখে লিনিকে পেছন থেকে লাগছে অসাধারণ। ড্রিঙ্কটা একঢোকে পুরোটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল সে। পা কি তার একটু টলছে? হবে হয়ত। এগিয়ে এসে তিন্তিড়ির কোমরে হাত রাখল সে। তিন্তিড়ি ঘুরে নাচতে নাচতেই আলিঙ্গন করল তাকে। মিউজিকটা সবে বদলাল। আর রাকেশ হঠাৎ করে তিন্তিড়িকে চমকে দিয়েই তাকে উঁচুতে তুলে নিল।
“তুই পুরো ড্রাঙ্ক। নামা আমায়, প্লিজ।” হাসিমেশানো চিৎকার করে উঠল সে। সাত্য একটু বিরক্ত। রাকেশকে ইশারায় তিন্তিড়িকে নামাতে বলল। এমন সময় এসে ঢুকল জোনাক, “সিগারেট দে।”
তিন্তিড়িকে নামিয়ে সিগারেটের খোঁজে পকেটে হাত ঢোকালো রাকেশ ।
এমন সময় হঠাৎ লিনির চিৎকারে পেছনে ফিরল সকলে। লিনি এতক্ষণ মিউজিকের তালে তালে নাচছিল রাকেশদের পাশেই। তার ভারী চেহারায় ঢেউ খেলে যেতে দেখে উত্তেজিত একজন মাতাল আচমকাই জড়িয়ে ধরে তাকে। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে সজোরে লোকটার মুখে ঘুষি চালায় জোনাক। এমনিতেই মদের নেশায় পুরোই টলছিল লোকটা, আচমকা ঘুষির আঘাতে সোজা মেঝেতে পড়ে গেল। লোকটার সঙ্গীরা এই দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল জোনাকের ওপর। আর তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সাত্য আর রাকেশ । মারামারি চালু হতেই ক্লাবের বাউন্সাররা এসে দুপক্ষকেই চলে যেতে বলল। দুপক্ষই পরস্পরের ওপর অনেক চেঁচামিচি করে আর অবশেষে “দেখে নেব” হুমকি দিয়ে বেরিয়ে এল। টলতে টলতে রাকেশরা তাদের গাড়ির কাছে এল।
রাকেশদের জীবনটাই এরকম। এরম মারামারি তাদের রোজকার ঘটনা। রাত্রিবেলা যখন শহর ঘুমিয়ে পড়ে, তখন জেগে ওঠে এদের রঙিন জীবন। মদ, নেশা, বেপরোয়া রাত এই নিয়েই এদের জীবন। লিনি, তিন্তিড়ি, সাত্য, রাকেশ আর জোনাক স্কুল থেকেই বন্ধু। তিন্তিড়ি আর সাত্য বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড। রাকেশের নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকলেও সে তিন্তিড়ির প্রতি একটু দুর্বল। লিনির বয়ফ্রেন্ড একজন বিজনেসম্যান এদের স্কুলের গ্রুপে সাধারণত থাকে না। এরা সকলেই হয় প্রভাবশালী বা প্রভাবশালীর কারও নিকট আত্মীয়। এদের মধ্যে জোনাকের গার্লফ্রেন্ড এদের থেকে একটু আলাদা, মানে সাধারণ মানুষ যেমন হয় আর কি! কিছুক্ষণ আগে ঘুমোতে যাবার আগেই জোনাকের সাথে তার কথা হচ্ছিল। এতক্ষণে সে হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছে। কিন্তু জোনাকরা এখন ঘুমোবে না, তাদের তো এখন সবে সন্ধে। হয়ত অন্য কোনও নাইটক্লাব এখন তাদের আগামী গন্তব্য।
গাড়ি এসে মাঝরাস্তায় দাঁড়াল।
“বিয়ার আছে?” গাড়ি থেকে বেরিয়ে সাত্যকে জিজ্ঞেস করল জোনাক। সবাই ততক্ষণে নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে।
তিন্তিড়ি দুটো বিয়ারের বোতল বের করে আনল। একটা জোনাকের হাতে তুলে দিল আর একটা সাত্যর হাতে। সাত্য আর জোনাক দাঁত দিয়ে ঢাকনাটা খুলে দুজনে “চিয়ার্স” করল বোতলদুটো ঠেকিয়ে। জোনাক একঢোক পান করেই মুখ থেকে ফেলে দিল বাকিটা, “ইসস! পুরো স্বাদ বিগড়ে গেছে !”
হেসে উঠল সাত্য, হেসে উঠল বাকিরাও। রাকেশ একটা সিগারেট ধরিয়েছে ততক্ষণে।
“তো কি এক্সপেক্ট করলি? এখনও চিলড থাকবে?” হাসতে হাসতে সাত্যর হাত থেকে বিয়ারের বোতলটা নিয়ে তিন্তিড়ি একটা চুমুক লাগালো তাতে। তারপর অনেকটা বিয়ার পান করল বোতল থেকে। সাত্য ওর হাত থেকে বোতলটা নিয়ে শেষ তরলটুকু পান করে নিল।
সাত্য এখন তিন্তিড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সাত্যের হাত থেকে বোতলটা নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে তিন্তিড়ি আঁকড়ে ধরল সাত্যকে, তারপর কামড়ে ধরল সাত্যের ঠোঁট। লিনি আর জোনাক “ও-ও” করে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। একটু দূরে রাকেশ বিরক্তির সাথে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল।
নিজের হাতে ধরা বোতলের বিয়ার শেষ করে বোতলটা জোনাক পা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল গাড়ির তলায়। রাকেশ ছাড়া বাকি সকলে উঠে বসল গাড়িতে। ড্রাইভারের সিটে সাত্য, তার পাশে তিন্তিড়ি। আর পেছনের সিটে লিনি আর জোনাক। রাকেশ পরপর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। শেষ সিগারেটের শেষ টুকরোটা ফেলে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে উঠে পড়ল। সাত্য গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ির চাকা মাড়িয়ে গেল সিগারেটের টুকরোটা। আর পথের ওপর ভাঙা বিয়ারের বোতলগুলো পড়ে রইল তাদের বেলেল্লাপনার সাক্ষী হয়ে।
গাড়ি ছুটে চলেছে তীব্র গতিতে। বেপরোয়া গাড়ি চালানোয় সাত্যর জুড়ি মেলা ভার। তার মধ্যেই একবার তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল তিন্তিড়ির ঠোঁট। লিনি আর জোনাক আবারও “ও-ও” করে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল। রাকেশ কিছু বলল না, শুধু পিছনের সিট থেকে তিন্তিড়ির পেটে আঙুলের খোঁচা দিয়ে একবার তাকে ডাকল। তিন্তিড়ি কানটা পেছনে বাড়াতেই ঠোঁটে করে কেটে নিল সে। সুড়সুড়িতে হেসে উঠল তিন্তিড়ি, “ডোন্ট ডু ইট, না!”
হেসে উঠল রাকেশও, তাকে কোমরের কাছে সুড়সুড়ি দিল এবার।
“রাকেশ করিস না!” মানা করল সাত্য। কিন্তু রাকেশের মনের ভেতরের কিছু ইচ্ছারা যেন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। তিন্তিড়ির শরীর তাকে যেন চুম্বকের মত টানছে।
“হোয়াট ইউ থিঙ্ক ইউ ডুইং?” বিশাল জোরে চেঁচিয়ে উঠল তিন্তিড়ি। তিন্তিড়ির দিকে তাকিয়ে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল সাত্যর, “হোয়াট দ্য…” গাড়িতে সজোরে ব্রেক কষল সে। আচমকা ব্রেক কষায় প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে থাকা গাড়ি এলোমেলো পথে ফুটপাতে উঠে এসে সজোরে ধাক্কা খেল। আজ সব সীমা পেরিয়ে গেছে রাকেশ । তিন্তিড়ির জামার ভেতর দিয়ে তার বুকে হাত রেখেছে সে। দরজা খুলে তাকে টেনে আনল সাত্য, “ব্লাডি বাস্টার্ড! তোকে অনেকক্ষণ বারণ করছি আমি”
নেমে এল তিন্তিড়িও। নেমেই একটা চড় কসাল রাকেশের গালে, তারপর তাকে ছেড়ে দিল সাত্যর হাতেই। রাকেশের পা টলছে। সাত্য হাতের মুঠি পাকিয়ে রাকেশের মুখে বসাতে যাবে, তাকে এসে ধরল জোনাক।
“আমায় ছাড় জোনাক!” জোনাককে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল সাত্য। কিন্তু জোনাক তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল।
হঠাৎ তিন্তিড়ির ভয়ার্ত চিৎকারে তার দিকে তাকিয়ে দেখল সবাই। গাড়ির সামনের দিকটা ধাক্কা লাগার ফলে অনেকটা তুবড়ে গেছে। সেই দিকেই চেয়ে আছে তিন্তিড়ি। মুখে তার আতঙ্কের ছাপ। সেদিকে তাকিয়ে বাকি বাকিদের মুখেও নেমে এল আতঙ্কের ছায়া। নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ মারামারি ভুলে গেল তারা। চারদিকে চেয়ে দেখল কেউ কোথাও আছে কিনা! কোনও গাড়ি বা লোক কেউ নেই চারপাশে। সকলে উঠে পড়ল গাড়িতে। এখুনি এখান থেকে পালাতে হবে তাদের। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল সাত্য। ফুটপাথ থেকে নেমে এল গাড়ি। তারপর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে সোজা ছুটে চলে গেল রাস্তা দিয়ে। ফুটপাতের ওপর পড়ে রইল গাড়ি দিয়ে মাড়িয়ে দেওয়া একটা লোকের লাশ।
ফুটপাথের ওপর একধারে এখানে শুয়ে ছিল লোকটা। প্রচণ্ড বেগে গাড়িটা তখন সোজা তার শরীরের উপর উঠে গেছিল, ফলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। সাত্যরা গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেলে লাশ থেকে উঠে বসল লোকটার আত্মা। আর আত্মারা তো অন্তর্যামী। তাই সে সবকিছুই জানতে পারল। জানতে পারল কীভাবে তার মৃত্যু হল, জানতে পারল এই সাত্যরা কীভাবে তার ওপর গাড়িটা চাপিয়ে দিয়েছে, জানতে পারল গাড়িতে কী হয়েছিল, তার আগেই বা কী হয়েছিল।
এসব কথা ভেবে তার একটা কবিতা লিখতে ইচ্ছে হল। বেঁচে থাকতে টুকটাক কবিতা বা ছড়া লিখত। কিন্তু থাকা খাওয়ার ঠিক ছিল না তার, আর কবিতা! তবে আজ তার মেজাজটা ফুরফুরে লাগছে। বেঁচে থেকেই বা কী করেছিল সে। দুঃখ আর যন্ত্রণা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। একপ্রকার জীবন্ত লাশই ছিল সে। মনের সুখে নিজের লাশের পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরাল সে। মনের সুখে একটা কবিতাও রচনা করে ফেলল। এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হল যমদূত।
যমদূত তাকে নিয়ে যাবার জন্য তাড়া দিল।
“দাঁড়ান না স্যার। অন্তত বিড়িটাতো খেতে দিন। ওদিকে তো ছেলেগুলো এক মুহূর্তে মেরে দিয়ে চলে গেল আর এদিকে আপনি এক্ষুনি এসে তাড়া দিচ্ছেন! একটুতো টাইম দিন স্যার।” লোকটার আত্মা বলল।
“টাইম তো নেইরে হাতে। তার ওপর তোর অ্যাক্সিডেন্ট কেস। তাড়াতাড়ি না নিয়ে গেলেই তো ঝামেলা পাকাবি।”
“আপনারা স্যার খালি আমাদেরই ঝামেলা করতে দেখেন। ঝামেলা তো করছিল ওই ছেলেমেয়েগুলো। আমি তো স্যার ঘুমোচ্ছিলাম।”
“উফ! বকাস না তো! জলদি চল!”
“ঠিক আছে।” বিড়িতে শেষটান দিয়ে লোকটার আত্মা বলল, “চলুন! কিন্তু যাবার আগে এই কবিতাটা একটু শুনুন। এইমাত্র লিখলাম। যারা আমায় মেরে দিয়ে চলে গেল, তাদের নিয়েই লিখলাম স্যার। শুনবেন?”
“না!” উত্তর দিল যমদূত, “আমার হাতে সময় নেই। “
“আচ্ছা!” একটু হতাশ হয়ে লোকটার আত্মা বলল, “তাহলে একটু সময় দিন। কবিতাটাকে এখানেই লিখে রেখে যাই। কেউ না কেউ তো পড়বে। বেঁচে থাকতে তো কেউ পড়ল না আমার কবিতা!”
পরের দিন সকালে যখন লাশটা আবিষ্কার হল, তখন চারপাশে সেভাবে কোনও ক্লু পাওয়া গেল না। অথবা বলা যেতে পারে সেভাবে খোঁজাও হল না। লাশটাতো ফুটপাতের ওপর শুয়ে থাকা একটা লোকের, ঘরপরিবার আছে কিনা ঠিক নেই, তার জন্য আবার খোঁজাখুঁজি কী! তাছাড়া ক্লু পেলেই বা কি করে নেবে কেউ? সাত্যদের কিছু করতে পারবে কেউ? প্রভাবশালী বা তাদের ছেলেপুলের বেলেল্লাপনার জন্য দু-একটা গরীবের লাশ পড়তেই পারে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এরম ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। তবে লাশের পাশ থেকে একটা চিরকুট পাওয়া গেল। চিরকুটটা খুলে পুলিশ ইন্সপেক্টর দেখল তাতে একটা কবিতা লেখা আছে। সেটা পুরোটাই এখানে তুলে ধরা হল –
“রাত্রিবেলা রাতের শহর জাগে
ডিস্কো, ক্লাব আর অবাধ্যতার আগে!
শরীরে জাগে অনেক বক্ররেখা,
সরলরেখাতে উত্তেজনা লাগে!
নিয়মমতো দিনরাত্রি আসে।
রাতের বেলায় ঘুমিয়ে পড়ে দেশ।
তবু কিছু গাড়ি ছোটে আলোর বেগে!
গাড়ির ভেতর আদিম পরিবেশ!
দ্রুতগতিতে বদলে যায় সম্পর্ক,
সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায় হাতে!
এক শরীরে অনেকগুলো শরীর!
মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে রাতে!
কামনাকে যখন কনুই মারে নেশা
গাড়ির গতি হারায় তখন সীমা।
পথের ধারে ঝুপড়িতে যারা থাকে
তাদের কারও থাকে না জীবনবীমা!”
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। লেখা তাঁর নেশা। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। দৃষ্টি, বালিঘড়ি এবং স্মরণে রবি এই কবিতার সংকলনগুলিতে রয়েছে তাঁর কবিতা। লেখার পাশাপাশি ঘুরতে এবং তথ্যচিত্র বা শর্ট ফিল্ম বানাতে খুবই ভালবাসেন। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।