বাহুবলী: নেতৃত্বের চিরকালীন সংজ্ঞা

লেখক: অয়ন মৈত্র

বাহুবলী-২ সিনেমা শুরুর প্রথম দৃশ্যেই আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস ওভারে বলে দেওয়া হয় যে মাহিস্মতি সাম্রাজ্যের যিনি রাজবধূ তাকে প্রতি ২৬ বছর অন্তর যে রাক্ষস নিধন উৎসব আসে সেই দিন রাজধানী থেকে ত্রিশ ক্রোশ দূরের এক শিব মন্দিরে মাথায় অগ্নিকুন্ড নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হবে অটুট সংকল্পে,বিরতিহীন ভাবে,বাধা হীন ভাবে রাজ্যের কল্যাণের জন্য।
আমরা ছোট থেকেই এই জল হাওয়ায় বড় হয়েছি যেখানে দেখেছি শাসক সমস্ত সুযোগ, সুবিধা এবং আরামের এক মাত্র অধিকারী।আর তার এই স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের-মানে সাধারণ মানুষের।আমরা এটা করব আমাদের নিজেদের সমস্ত চাওয়া পাওয়া,ভাল লাগা-মন্দ লাগা কে বিসর্জন দিয়ে।ভোটের আগে তাই যখন দেখি কোন মন্ত্রী চাষির সাথে ক্ষেতে কাজ করছেন কিংবা মজুরের মাটির দাওয়ায় বসে কলাইয়ের থালায় পুঁই ডাটা কিংবা শুকনো চাপাটি খাচ্ছেন তখন মোটেও অবাক হইনা।সকল নেতাই যে একজন ভালো অভিনেতা ততদিনে সেটা আমরা বুঝে গেছি।কিন্তু আমাদের চেনা এই শিক্ষা সজোরে ধাক্কা খায় বাহুবলী ২ এর প্রথম দৃশ্যেই যখন রাজমাতা শিবগামী কে আমরা অগ্নি প্রস্থানে দেখি।
মাহিস্মতি সাম্রাজ্য কে কিছুদিন আগেই তার দুই ছেলে কালকেয় নামের এক ভীষন জাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে।মানুষের মনে এখন অগাধ আস্থা তার শাসন ব্যবস্থার ওপর।এই শাসন ব্যবস্থায় তারা যে ধনে-প্রাণে সুরক্ষিত এই বিশ্বাস তিনি তৈরী করতে পেরেছেন।শিবগামী কে এই বিশ্বাস তৈরী করতেই হত যে কোন মূল্যে।কারণ মাহিস্মতি রাজবংশের সকল বংশধর যুগে যুগে প্রজা হিতৈষনার যে নজির গড়ে তুলেছে একটু একটু করে সেই আস্থা তাকে তার রাজত্ব কালেও ধরে রাখতে হত।সুতরাং সেই বিশ্বাসের মর্যাদা স্বরূপ তাকে তো যা ঐতিহ্য তার বংশের, তাকে পালন করতেই হবে। যদি ঈশ্বর কে তুষ্ট করাই লক্ষ্য হয়, তাহলে সামান্য এক চাষী কিংবা মজুরের কৃচ্ছসাধন কি খুব প্রভাব ফেলতে পারে যতোটা পারে একজন শাসকের ত্যাগ!নেতৃত্বের গগনচুম্বী চূড়া থেকে নেমে লক্ষ লক্ষ সাধারণের, যাদের পরিচয় ‘একটা লোক’ -এর বেশী নয়, তাদের জন্য অপরিসীম কষ্ট সহ্য করাটা তো মুখের কথা নয়।সব শাসক,সব নেতৃত্বের এই নমনীয়তা থাকেনা।আমরা তাই যখন দেখি সেই নমনীয়তায় রাজপ্রাসাদের বিলাস ছেড়ে শিবগামী খালি পায়ে হেঁটে চলেছেন আগুন কুন্ড মাথায় নিয়ে অবাক না হয়ে পারিনা। শ্রদ্ধাবনত না হয়ে পারিনা।তিনি ইচ্ছে করলেই পারতেন এতদিনকার ঐতিহ্যকে এক আদেশে পাল্টে ফেলতে।আইনতো চিরকালই ক্ষমতার দাস।কিন্তু তিনি করেননি রাজপরিবারের কুলবধূ হিসেবে।তিনি রাজমাতা হিসেবে অহংকারী হতে পারেন, বীর দুই সন্তানের মা হিসেবে গর্বিনী হতে পারেন,কিন্তু রাজ্যের কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি আপোষহীন নেত্রী।আসলে প্ৰকৃত যিনি ক্ষত্রিয় তিনি এমনটাই হন। ভগবত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩১ সংখ্যক শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষত্রিয়ের প্রকৃত ধর্ম বোঝাতে গিয়ে বলছেন-
                                                             ।। “স্বধর্মম অপি চ আবেক্ষ্য বিকম্পিতুম অর্হসি ।
                                                                   ধর্মাত্ হি যুদ্ধাত্ শ্রেয়ঃ অন্যাত্ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।”
অর্থাৎ ক্ষত্রিয় রুপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করেও তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত্ নয়। কারন ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করা থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নাই। ধর্ম বলতে এখানে রাজধর্ম বলতে চাওয়া হয়েছে।রাজা হিসেবে, শাসক হিসেবে,ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়ার অধিষ্ঠাত্রী হিসেবে শিবগামী তাই যথার্থ ক্ষাত্র ধর্মই পালন করেছেন।আজ বিরল হলেও আদি ভারতবর্ষের এটাইতো পরম্পরা।
একটা বিশ্বাস, আমরা নিরাপদে আছি,আমাদের সম্পত্তি সুরক্ষিত আছে,এই মনে রেখে মাহিস্মতি রাষ্ট্রের অগণিত প্রজা রাতে ঘুমোতে গেছে যে তাদের রক্ষা করার জন্য রাজমাতা আছেন, এই ভরসাটাকে জাগিয়ে রাখতে পারাটাই তো প্রকৃত রাজ ধর্ম, যিনি এটা জনমনে জিইয়ে রাখতে পারেন তিনিই প্রকৃত ক্ষত্রিয়রাজা,সম্রাট,মন্ত্রী,ডাক্তার,শিক্ষক,গুরু এসব পদ তুচ্ছ হয়ে যায় একবার মানুষ যখন অন্ধবিশ্বাস করতে থাকে যে ঠিক আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন, আমার সমস্ত সমস্যা এক নিমেষে সেরে যাবে এই মানুষটার কাছে গেলে,তখন এই বিশ্বাসটা সযত্নে রক্ষা করাই মুখ্য হয়ে ওঠে।এখানে সব পদ মাহাত্ম্য গৌণ হয়ে যায়।
আর.কে.নারায়ণের ‘দি গাইড’ উপন্যাসে আমরা এই বিশ্বাসেরই প্রতিফলন দেখতে পাই যখন সাধু বেশি রাজুকে সমস্ত গ্রামবাসী অলৌকিক শক্তির আধার হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করে।খরা ক্লিষ্ট গ্রামবাসী তাই যুক্তি বোঝেনা,তারা একটা সহজ কথা বোঝে তাদের এই সাধুবাবাই একমাত্র পারে গ্রামের বুকে বৃষ্টি নামাতে।রাজু নিজেই বোঝেনা কখন গ্রামের সমস্ত মানুষের আশা ভরসার প্রদীপ হয়ে গেছে সে,যে প্রদীপ প্রবল ঝড়েও নেভেনা, যে প্রদীপের তেল শেষ হতে নেই।এ প্রদীপ অনির্বান।গ্রামবাসীর ইচ্ছে সাধুবাবা হাঁটু অবধি নদীর জলে দাঁড়িয়ে থাকুক উপবাস করে কয়েকঘন্টা।তার এই কৃচ্ছ সাধনই পারে বৃষ্টি নামাতে। সাধুবেশী রাজু উপবাস শুরু করে।বৃহৎ এর উদ্দেশ্যে এই ত্যাগ স্বীকার যখন বেশ কিছুদিন চলে,সারা পৃথিবী থেকে মিডিয়া যখন ভীড় জমায় তাকে ঘিরে,অবশেষে অবসন্ন এক বেলায় রাজু বুঝতে পারে বৃষ্টি নেমেছে।
আমরা এই অগাধ আস্থা দেখেছি শচীন যখন ব্যাট করতে নামতেন।আপামর ভারতবাসী আশা করতেন তার একটা সেঞ্চুরি পারে দাম্পত্য কলহে বিরতি টেনে দিতে,তার একটা কভার ড্রাইভ কিংবা স্ট্রেট ড্রাইভ বেকার ছেলের মনে চাকরি না পাওয়ার জ্বালা সেদিনের মত কয়েক আউন্স কমিয়ে দিতে পারে।ভারতবাসীর এই অমানবিক প্রত্যাশা কাঁধে নিয়ে যখন উনি ব্যর্থ হতেন,সমালোচনার তীর থেকে বাড়ির জানলায় পাথর সবই সহ্য করতে হয়েছে।আসলে এই একজনের ওপর আস্থা রেখে প্রবীণ বাজার করতে বেরোতেন,ক্লাস সিক্স স্কুলে বেরোত,মধ্যবয়সী ডিউটিতে বেরোতেন যে বাড়ি ফিরে শুনবেন ভারত জিতে গেছে।এই যার ওপর প্রত্যাশা তাকে তো বাবার মৃত্যুর পর দিনই দেশের হয়ে খেলতে এসে সেঞ্চুরি করে দেশকে জেতাতে হবে।তার তো আর পাঁচজনের মত মৃত্যু নিয়ে দুঃখবিষ্ট মানায় না।তাই এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন একবার,বয়স নয়,কতদিন খেলছি তাও নয়,প্রশ্নটা হল দেশ জোড়া এই ভালোবাসার প্রতি সৎ থাকতে পারলাম কিনা।
নেলসন ম্যান্ডেলা তাই তো বলে গেছেন প্ৰকৃত নেতা তিনিই যিনি সর্বদা প্রস্তুত থাকেন নিজের সবটা ত্যাগ করবেন বলে মানুষের জন্যে।
বাহুবলী-২ এর প্রথম দৃশ্য তাই সিনেমার সুর বেঁধে দেয় যে এই যদি মা হয়,তাহলে তার ছেলে যে মানুষের কল্যানেই উৎসর্গ করবে নিজেকে তা তো স্বাভাবিক।পরবর্তী কালে যদিও আমরা ভল্লাল দেবের মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখেছি,দেখেছি অহংকারমদমত্ত রাজমাতাকে,তবে তা একান্তই তার রাজরক্তের অহং এর কাছে নতি স্বীকার।রাজমাতাকে ছাপিয়ে পরে এই গুণেই বাহুবলী জন নায়ক হয়ে ওঠে।


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।