রবীন্দ্রনাথ: কালের সীমানা ছাড়িয়ে

লেখক : অর্দ্ধেন্দু গায়েন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন, তা নিয়ে গত একশো বছর বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আপামর বিশ্ববাসী তথা সমগ্র বাঙালির কাছে তিনি যে বিশেষভাবে আলোচিত, এ’কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। অন্য কোনও বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণ, এত আলোচনা এর আগে কখনো হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে কি না তা বলা বড় কঠিন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত আলোচনা করার একমাত্র প্রধান কারণ হ’ল তাঁর বিপুল সৃষ্টি সম্ভার। রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে এমন মানুষ খুবই বিরল, যারা রবীন্দ্রচিন্তা এবং তাঁর সৃষ্টির ধারায় নিজেদের স্নাত করেননি। সে হোক সাহিত্য, দর্শন কিংবা শিল্পকলা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির এক বিরাট অংশ ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করায় প্রচুর সংখ্যক বিদেশী মানুষেরাও তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। চর্মচক্ষে না দেখেও তাঁর সৃষ্টি, ভাবনার গভীরে ডুবে গিয়ে ভালবাসতে শুরু করেছেন তাঁকে। তাঁর সৃষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষকদের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার কোনদিকটা এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সেটাও একটা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ ৮০ বছরের জীবনের শেষ ২৯ বছর বিশ্ববাসীর কাছে ভীষণভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর জীবনের শেষের তিন দশক সারা জীবনের প্রচেষ্টার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাঁকে সাধারণ থেকে অসাধারণ, অর্থাৎ বিশ্বমানব হিসেবে গড়ে তুলেছিল তাঁর জীবনের শেষ ২৯ বছর। অনেকেই তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, আলোচনা করেছেন। অনেকে তাঁর বায়োগ্রাফিক নোট তৈরি করেছেন। তবে মনে রাখতে হবে, সবার আগে তিনি এমন একজন বাঙালি কবি, যাঁর জন্য বিদেশিরাও বাংলা ভাষাকে ভালবাসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয় মন্তব্য করেছিলেন—

“কোন বিদেশী যদি বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ দেখায়, তার কারণ ঐ রবীন্দ্রনাথ।”

১৯০০ সালে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “বাঙালি বিশ্বকবি” উপাধিতে ভূষিত করেন। সঙ্গত কারণেই এই মানুষটার প্রতি বাঙালি তথা বিদেশের আগ্রহ প্রবল থেকে প্রবলতর হবে, এটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ বলেছেন—

“আমার বাবা বেশীরভাগ সময় সাহিত্য গবেষণায় মগ্ন থাকতেন এবং দীর্ঘ সময় তিনি হয় লিখছেন না হয় পড়ছেন অথবা সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন।খাবার সময় বাদ দিলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। কিন্তু আমাদের সকল ভাই বোনের প্রতি তাঁর ছিল সাংঘাতিক রকম স্নেহ। যদিও তিনি কখনোই তাঁর আবেগ প্রকাশ করতেন না।”

ঠাকুর পরিবারের অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন। অনেকেই তাঁদের সখ্যতার কথা পাঠকসম্মুখে উপস্থাপন করেছেন আবেগ ভরে। ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীও লিখেছেন “আঙ্কল রবীন্দ্রনাথ” সম্পর্কে। তাঁর লেখনীর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আজ একশো বছর পরেও আমাদের ভাবায়, আনন্দ দেয়, আমাদের এক অন্যরকম ভাবনায় ভেসে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়।

শান্তিনিকেতন ছেড়ে শেষবারের মত কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী যেদিন কলকাতায় ফিরছেন, সেদিন সাথে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। পুকুরের পাশ ঘেঁষে ট্রেন চলছিল লম্বা সাপের মতো। শ্বেতপদ্ম বিকশিত হয়ে সে কী এক অপূর্ব শোভাবর্ধন করেছিল, কে জানে! ১৩ বছরের শিশু রথীন মা’কে ডেকে সেই প্রস্ফুটিত পদ্মফুল দেখানোর জন্য বিহ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু মা বুঝেছিলেন, সূর্য ডোবার আর বেশি দেরি নেই। ডাক্তারবাবুরা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ঠাকুরবাড়িতে সেদিন এক আশ্চর্য নীরবতা। রথীন্দ্রনাথ মা’কে দেখতে গেলেন, দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে মুখ ভিজে গেল নীরবে। খুব সকালবেলা ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় এক অসম্ভব রকমের ছায়া ঘিরে ধরেছে চারিদিকে। কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী বিদায় নিলেন ইহজগৎ থেকে। রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীর পায়ের এক জোড়া চপ্পল রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে বললেন “এটা রেখে দিও।” কোনও মৃত্যু, কোনও হতাশা, কোনও অবসাদ ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের জীবনের উপর ছায়া ফেলতে পারেনি। শুধু স্ত্রী নয়, একের পর এক নিজের বাবা, নিজের সন্তান, বন্ধুসম বৌদি— কারও মৃত্যুই তাঁর জীবনসাধনাকে বাধা প্রদান করে নি, করতে পারেনি। তিনি ব্যথাকে জয় করেছেন, শক্তি খুঁজেছেন এক দুর্ভেদ্য সত্যের অন্য প্রান্তের মধ্যে। স্ত্রীকে হারিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নিজেকে গভীরভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

“Vicissitudes of life, pain and affection is never upset the equanimity of my father’s mind. His inward peace was not disturbed by any calamity, however painful. some inner resources gave him the power to face and rise above misfortunes of the most painful nature.”

একবার তাঁর পায়ে একটি বিছে কামড়ে দিয়েছিল। দু’পা মেলে ধরে চুপচাপ বসেছিলেন, যন্ত্রণায় পা অসাড়। মনে হচ্ছিল বুঝি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ভিন্ন কোনও অঙ্গ। তাঁর যন্ত্রণার অনুভূতি ছিল তীব্র, কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ বলেছেন— “সারাজীবন ধরে তিনি যে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা আত্মস্থ করার শক্তি পেয়েছিলেন এটা তার একটা।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে কোনও কাজ করতেন না। নিয়মিত জায়গা পরিবর্তন করা ছিল তাঁর নিত্য অভ্যাস। শুধু তাই নয়, ঘরের আসবাবপত্র প্রত্যেক সময় প্রত্যেক রকমভাবে সাজানোও ছিল তাঁর এই অভ্যাসগুলোর মধ্যে একটা। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে। তাঁর নিত্যপরিবর্তনশীল এই মানসিকতা অনেক সময় অনেককে বিভিন্ন সমস্যার মুখে পতিত করেছে। একবার লন্ডনে থাকাকালীন নরওয়ে থেকে আমন্ত্রণ আসল সেখানে ভ্রমণের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, টিকিট কাটা হ’ল ‘থমাস কুক’ নামের ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে। টিকিট কেটে রথীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন সাউথ কেন্সিংটনের ফ্ল্যাটে। টিকিট, লাগেজ, পাসপোর্ট – সবকিছু তৈরি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ বেঁকে বসলেন। কোনরকম অজুহাত না দিয়ে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, তিনি নরওয়ে যাবেন না, যাবেন আগামীকাল প্যারিসে। যেমন কথা তেমন কাজ। সেই টিকিট ফিরিয়ে দিতে হ’ল। তিনি গেলেন প্যারিসে।

যারা তাঁর কাছাকাছি থাকতেন, তারা জানতেন তাঁর এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা। এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা তারা ধাতস্থ করে ফেলেছিলেন, তাই তাদের খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে হত না। তিনি যখন পূর্ববঙ্গে, বিশেষ করে শিলাইদহে আসতেন, তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসহ দারুণ সময় কাটাতেন। তাদের লেখাপড়া নিয়ে তাঁর ছিল নিদারুণ উদ্বেগ। প্রচলিত, গতানুগতিক লেখাপড়ার উপর তাঁর অসম্ভব বিতৃষ্ণা ছিল। তিনি নিজেও এই প্রচলিত লেখাপড়ার বাইরে ছিলেন। তাই তিনি কখনই চাননি তাঁর ছেলেমেয়েরা প্রচলিত লেখাপড়ার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিক। তাই তিনি নিজে সন্তানদের বাংলা পড়াতেন। কবিতা, গদ্য পড়ানোর সময় বুঝিয়ে দিতেন সেই কবিতা বা গদ্যের মর্মবাণী, অবশেষে মুখস্থ করাতেন। তিনি মুখস্থ বিদ্যার পক্ষে ছিলেন। মুখস্থ করলে যে সেটা হৃদয়ের গভীরে বাসা বেঁধে নেয়, সেটা কবি জানতেন। তাই রথীন্দ্রনাথ বলেছেন—

“He would take up a poem or a piece of prose and explain it in great detail, paraphrasing and analysing every sentence, repeating it several times, so that by the end of the lesson the whole thing would not only be vividly impressed on our minds but we would be able to recite it from memory.”

এরপর যখন শিক্ষকরা পড়াতে আসতেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শিখিয়ে দিতেন তাঁদের, যে কিভাবে তাঁর সন্তানদের পড়াতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর প্রতিভা আজ কারও কাছে অজানা নয়। ছোটবেলা থেকেই একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখাটা তিনি রপ্ত করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথ নিজে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে, কিভাবে তাঁর বাবা একই সঙ্গে গান, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, গদ্য রচনা এবং আরও অন্যান্য বিষয়গুলো দক্ষতার সঙ্গে লিখে যেতেন! শুধু তাই নয়, লেখার মাঝে কেউ দেখা করতে এলে তিনি কুন্ঠাহীনভাবে সময় দিতেন। কিন্তু অবাক করার বিষয়, বেশ কয়েক ঘন্টা বাদে ফিরে আসার পর আবারও তিনি এমনভাবে লেখার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়তেন, মনে হত মাঝের সময়টাতে তিনি হয়ত লেখার মধ্যেই ছিলেন। অর্থাৎ কোন সাময়িক বাধা তাঁকে মূল চিন্তা থেকে বিচ্যুত করতে পারত না। দিনের বেলাতে তাঁর ঘুমনোর অভ্যাস ছিল না। বিশ্রামের প্রয়োজন হত না তাঁর। গ্রীষ্মের পুড়ে যাওয়া দুপুরেও তিনি লিখে যেতেন বিরামহীন ভাবে। রাতে মাত্র চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমোতেন। অবসরে লিখতেন গান। গান লেখাটা ছিল তার অবসরকালীন বিনোদনের অংশ। অবশ্য ছবি আঁকার সময়টাও তিনি এমন করেই আনন্দের সঙ্গে অতিবাহিত করতেন।

ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। আবার ভাল সাঁতারুও ছিলেন তিনি। কুস্তিগিরের থেকে কুস্তি শিখেছেন। তাঁর আকর্ষণীয় চেহারা অনেককেই বিমোহিত করত। দেশের বাইরেও প্রত্যেকটি সাহিত্যপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি পরম মমতায় শুশ্রূষা করেন। অন্যের কষ্ট তিনি একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। মেয়ে রানু টিবি রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সে কি ব্যস্ততা। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার উপর কবির অগাধ আস্থা ছিল। নৈনিতালে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার কাঠমিস্ত্রির দুরারোগ্য ‘সেন্ট ভিটাস ডান্স’ রোগের উপশমের জন্য তিনি তাকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটা একটা নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। কয়েকদিন পর রোগী ফিরে এসে জানালেন তিনি সুস্থ। মুহূর্তের মধ্যে ডাক্তার হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এমন সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করলে সবাই তাঁকে ‘ডক্টর রবীন্দ্রনাথ’ লিখতে শুরু করলেন।

রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের আর একটি দিক হ’ল তাঁর দেশপ্রেম। অহেতুক সংকীর্ণতা তিনি অত্যন্ত সচেতনতার সহিত পরিহার করেছেন। এইজন্য তাঁর জাতীয়তাবোধের ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর বহু স্বপ্নের মধ্যে একটা হল দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। এজন্য শিক্ষা ও কৃষির উপর তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জীবনের একটা সময় তিনি রাজশাহী, নদীয়া, শান্তিনিকেতন ইত্যাদি জায়গায় গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আলু চাষ করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলেও নতুন এবং পূর্ণ উদ্যমে আবারও ধান আর ভুট্টা চাষে মনোনিবেশ করেছিলেন, এবং এর বীজ নিয়ে এসেছিলেন যথাক্রমে আমেরিকা ও মাদ্রাজ থেকে।

গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনার দূরত্ব ছিল অসীম। গান্ধীজীর অনেক কিছুই তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। আবার সামনাসামনি কোনদিন তাঁকে অপমানও করেননি। একবার জওহরলাল নেহেরু গান্ধীজীকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গিয়েছিলেন (১৯১২)। নেহেরু একটু বিব্রত ছিলেন যে, দু’জনের দেখা হ’লে যদি কোন অনাসৃষ্টি বাঁধে। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিন গান্ধীজীকে নজিরবিহীন সম্মান দেখালেন।

অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর যেমন ছিল ব্যক্তিত্ব,তেমনি অসামান্য দক্ষতা। গান গেয়ে অতি অল্প সময়ে তিনি অন্যকে মুগ্ধ করতেন। কেউ তাঁর প্রতি বিরূপ হলে কখনো প্রতিহিংসা দেখাননি এক মুহূর্তের জন্য। একবার লন্ডনে রাসেলের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতে রাসেল তাঁকে স্বাভাবিক সৌজন্যতা দেখান নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে কুন্ঠাহীন প্রশংসা করেন। এখানেই রাসেল এবং অন্যান্যদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার আকাশ-পাতাল পার্থক্য থেকে যায়। বিশ্বের খুব কম মানুষই ছিলেন যাঁরা তাঁর চিন্তাভাবনার মুগ্ধতা প্রকাশ করেননি। অসাধারণ এক সম্মোহনী শক্তি ছিল তাঁর। যেখানেই যেতেন সৃষ্টি হতো এক মোহময় পরিবেশ। বিদেশে অর্থাৎ লন্ডনে যেখানে স্বাভাবিকভাবে সমস্ত মানুষেরা কবিকে চিনবেন না কিন্তু সেখানকার একজন ভদ্রমহিলা সুসান ওয়েন রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন এবং পোস্ট করেছেন। সঠিক ঠিকানা না জানার কারণে চিঠির খামের উপরে শুধু লিখে দিয়েছিলেন “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ডাক বিভাগ এই মহৎ মানুষটিকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। চিঠিতে ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুগভীর, সীমাহীন শ্রদ্ধা ও অগণিত ভালবাসা।সবচেয়ে বড় কথা চিঠিতে সুসান যা লিখেছেন তা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক —

“প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যাবার সময় আমার পুত্র উইলফ্রেড ওয়েন আমার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় বলে গেল তোমার গীতাঞ্জলীর সেই অমর বাণী, “যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই,যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই”।
যুদ্ধ শেষে যখন তার মরদেহটা পাওয়া গেল তখন তার বুক পকেটে ছোট্ট একটা চিরকুট আবিষ্কার করলাম। সেই চিরকুটে লেখা ছিল ঐ কথাগুলো যেগুলো বলে সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর নিচেই লেখা ছিল তোমার নাম, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”।”


লেখক পরিচিতি : অর্দ্ধেন্দু গায়েন
জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনার যোগেশগঞ্জের মাধবকাটী গ্রামে।পেশায় সরকারী চাকুরী হলেও নেশা পড়াশোনা , ইচ্ছে হলেই লেখা-সে কবিতা, ছোটগল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ যা কিছু হতে পারে, অবসরে বাগান করা,ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা ইত্যাদি।তবে সব পরিচয়ের সমাপ্তি ঘটে সৃষ্টিতে --পাঠক যেভাবে চিনবেন আমি সেভাবেই থেকে যাবো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।