লেখক: রিয়া ভট্টাচার্য
“এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার” সুকান্ত ভট্টাচার্যের কোটেশনখানি এডিট করে তার সাথে কিছু নিজস্ব বক্তব্য যোগ করতে ব্যস্ত ছিল ঈশানী, শখের ফেসবুক লেখিকা, স্পষ্টভাষী ও আবেগী বলে জগৎনিন্দিত।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিশু নিগ্রহ নাড়িয়ে দিয়েছে তাকে। নারীকুল যে শৈশবেও সুরক্ষিতা নয় এই ব্যাপারটা নাড়িয়ে দিয়েছে তাকে, স্বয়ং শিক্ষক, জন্মদাতা যদি শোষণকারী হয় তবে সুরক্ষা ঠিক কোথায়?
— ‘তোর জ্ঞানদান শেষ হয়েছে তো একবার এদিকে তাকালে ভালো হয়’ তিক্ত স্বরে বলে পাশের প্লাস্টিক চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন সুমিতা দেবী, ছোট্ট অনাথ আশ্রম আশিয়ানার মহিলা ওয়ার্ডেন স্থূলকায়া আদুরে চেহারা, ধনী স্বামীর সোহাগিনী স্ত্রী। আশ্রমের কাজটা তাঁর একপ্রকার সময় কাটানোর মাধ্যম, সাথে নিঃসন্তান জীবনে এক টুকরো পুষ্পিত কানন। ঈশানীকে ফোন হাতে দেখলেই ভুরু কুঁচকে যায় তাঁর, অন্যসময় স্নেহে ভরিয়ে রাখেন।
— ‘কিরে কানে ঢোকেনি? কে আছে ওই ফোনে? আজ এটাকে জলে দেব আমি দেখ তুই’। গরগর করতে করতে বললেন তিনি।
— ‘উফফ হয়েছে টা কি? অবসরে ফোন নিয়ে বসেছি, কাজের সময় নয়, ফাঁকিবাজি করি না আমি’। বিরক্ত হয়ে জবাব দিল ঈশানী।
— ‘আমার সামনে ফোন ঘাঁটবি না তুই, ভালো লাগে না আমার। কথা বল, আলোচনা কর’।
— ‘কি নিয়ে আলোচনা করবে সেটা তো বলো! আর আমি লিখছি, চ্যাট করছি না’।
— ‘ওই কর শুধু, জ্ঞান বিতরণ করেই বাঙালি শেষ, যদি নিজের জীবনে প্রয়োগ করত একটু! নিশ্চয় নারীবাদী লেখা লিখছিস, সব পুরুষ খারাপ, ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো হোক এই রকম, তাইতো?’
— ‘তুমি পাগল হলে? কে বলল আমি নারীবাদী? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি, আমি ভুলিনি আমার জন্মদাতা, দাদা-ভাই এমনকি ভালোবাসার মানুষটাও পুরুষ, তাই খামোখা কিছু নোংরা মানুষের জন্য সমগ্র পুরুষজাতিকে দোষারোপ করি না আমি’।
আচমকাই চেয়ার ছেড়ে উঠে ঈশানীকে চেপে ধরলেন সুমিতা দেবী, হিসহিসিয়ে উঠলেন, ‘শুধু পুরুষ অত্যাচার করে তাই না? যদি আমি বলি মহিলাদের ওপর অত্যাচার মহিলাও করে থাকে অস্বীকার করতে পারবি? একজন ধর্ষিতাকে প্রতি মুহূর্তে মানসিকভাবে ধর্ষণ করে মা-কাকীমারাই, বাক্যবাণের দ্বারা। কারো বিয়ে ভাঙলে যারা আঙুল তোলে, কানাকানি করে গসিপ করে কিন্তু মহিলারাই, অস্বীকার করতে পারবি?’ একটানা কথা বলে জোরে শ্বাস নেন তিনি, মুখ লাল হয়ে আছে তাঁর।
— ‘হয়েছেটা কি তোমার? আজ আসার পর থেকে দেখছি কোনো বিষয়ে খুব রেগে আছো, ঠিক আছো তো? ঘরে কিছু হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে ঈশানী।
— ‘জানতে চাস কি হয়েছে? চল আমার সাথে, একটা জিনিস দেখাব, কাল রাতেই এসেছে, দেখে ঠিক কতখানি থাকতে পারিস আমিও দেখব। নিজেকে অনুভূতিশূন্য বলিস তাইনা? আজ আমিও দেখতে চাই তোর দৌড় কতদূর, চল!’ ঈশানীকে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সুমিতা দেবী, পেছনে তখন টেবিলে রাখা ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে বাজছে, ‘মাম্মু কলিং’…
* * *
মফস্বল শহরের জনকোলাহল থেকে একটু দূরে যেখানে পিচঢালা রাস্তাটা এসে মিশেছে মোরাম রাস্তার অন্তরে, সেখানেই এক বিঘা জমির ওপর ছাতিম, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া গাছে ঘেরা একতলা অনাথ আশ্রম ‘আশিয়ানা’। সরকারি ভরতুকিপ্রাপ্ত এই আশ্রমটি মাদার টেরিজার মিশনারিস অব চ্যারিটির স্নেহধন্য, এখানের বেশিরভাগ আবাসিক শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী, চিকিৎসা-পড়াশুনো-কাউন্সেলিং থেরাপি সবই এক ছাদের তলায়, সবমিলিয়ে কুড়িজন আবাসিক ও ছয়জন কর্মীর স্থায়ী আস্তানা এটি। এছাড়াও আছে ঈশানীর মত কিছু নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, যাদের কাজ আবাসিকদের পড়ানো, গল্প শোনানো, কখনো ছোটোখাটো বিষয়ে কাউন্সেলিং ইত্যাদি।
পড়ন্ত বিকেলে গাছের পাতায় অস্তগামী সূর্য, লালচে সোনালী রোদ চুঁইয়ে নামছে পাতা বেয়ে, শূন্যস্থান দখল করছে নিরুত্তাপ কালচে ছায়ারা। একটু পরেই পাখিরা হুটোপুটি করে ফিরবে কুলায়, তাদের কিচিরমিচিরে ভরে উঠবে আশ্রম প্রাঙ্গন, চত্বরের গাছে গাছে তাদের শান্তির নীড়।
ঈশানীকে টানতে টানতে করিডোরের শেষপ্রান্তের একটি ঘরে ঢুকলেন সুমিতা দেবী, আধো আলো-অন্ধকারে স্থবির বসে এক কঙ্কালসার অবয়ব, দেখেই বোঝা যায় অপুষ্টির শিকার রুগ্ন চেহারাটি, বয়স কত বোঝার উপায় নেই শুকনো দড়ি পাকানো মুখমণ্ডল দেখে।
হতভম্ব ঈশানীর দিকে চেয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে আলোটা জ্বালিয়ে দেন সুমিতা দেবী। আচমকাই তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে ওঠে অবয়ব, লুকানোর স্থান খুঁজতে থাকে জান্তব দ্রুততায়।
— ‘আলো সহ্য হয় না ওর, দেখলেই পাগলামি করে, লুকিয়ে পড়তে চায় আড়ালে, তবু তোকে দেখানোর জন্য জ্বাললাম আমি’। বেদনাহত স্বরে বললেন সুমিতা দেবী।
— ‘কি হয়েছে ওর?’ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল ঈশানী।
— ‘নিজেই জেনে নে ওর মুখে, আমি বলতে পারব না কিছু, ঘেন্না লাগে, অপরাধী লাগে নিজেকে বড্ড! মাত্র পনের বছর বয়সে এতকিছু! …বুঝেশুঝে কথা বলিস…’ দরজাটা আলতো করে টেনে বেরিয়ে গেলেন সুমিতা দেবী।
বিকালের ম্লান আলো জানলার খড়খড়ি ভেদ করে এসে পড়ছে ঘরের ভেতর, সৃষ্টি করছে রহস্যময় আবছায়া, পায়ে পায়ে ঈশানী এগিয়ে চলল বিছানার দিকে, যেখানে বসে তার দিকে জুলজুল চোখে চেয়ে আছে অবয়ব।
* * *
— ‘তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়?’ বিছানার একপাশে বসে আলতো স্বরে প্রশ্ন করে ঈশানী।
— ‘মুর নামঠো বুধন মাণ্ডি আছেক, হুইইই কুশমাণ্ডী গেরামে ঘর ছিলোক বটেক’।
— ‘কুশমাণ্ডি তো অনেকদূর, এদিকে এলে কিকরে? আর বাড়িতে কে কে আছেন তোমার?’
— ‘বাপঠো মইরে যেতে মাঠো রতন কিস্কুর সাথে পঁলাইলেক, মুর কেহ লাই, পেটের ধান্দায় আইসলাম হেথায়, উ তুদের লেতা ঘোষবাবু, উর ঘরে কাম কইরতাম, শালা পুইলিশে ধঁরাই দিলোক’। চার অক্ষরের একটি কাঁচা বাঙালি বিশেষণ ব্যবহার করে বলল বুধন।
— ‘এইসব গালাগালি শিখলি কোথায়?’
— ‘উ জো ঘোষবাবুর ঘরে থাইকতাম উ বলত আমায়, উর বৌও। আবার যেখানে পুইলিশে রাখিছিলোক উখানে বড় বড় লোকগুলো রাতের বেলা বুইলতো। করার সময় ইসব নাকি বুইলতে হয়, অরা মজা পায়’। ছোপ ধরা দাঁত বের করে হেসে বলে বুধন।
— ‘কি করার সময়?’ ভ্যাবলার মত প্রশ্ন করে ঈশানী, ‘আর তোর এই অবস্থা কেন? খেতে দিত না ওখানে?’
— ‘উ যেটা করে তোরা খুব মজা পাস, খেইলতে চাস মাইনষ লিয়ে। খেলার পর খাইতে ভালা লাগে নাই, পয়সা দিয়ে আঠা কিনে শুঁকতম, বমি হতোক লাই’।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে ঈশানী, ‘সংশোধনাগারে তোমাকে অন্যান্যরা!…পুলিশে জানাও নি কেন?’
— ‘তু বড্ড কম বুঝিস বটেক, উয়ারা পরথম লয়। উ যো ঘোষবাবুর বৌঠো ছিলোক, উ মুকে রোজ রাতে… দাঁড়া দেখাই তুকে’। গায়ের জামাটা খুলে দাঁড়ায় বুধন, শিউরে উঠে ঈশানী। বুকের দুপাশে কামড়ের দাগ, কোনো হিংস্র জন্তু যেন দাঁত বসিয়েছে কোমল পদ্মপর্ণে, পিঠে-কোমরে ফালাফালা আঁচড়ের দাগ প্রমাণ দিচ্ছে মহুয়াবনে মত্ত হস্তিনীর তাণ্ডবলীলার।
— ‘উ ব্যথা দিতে ভালোবাইসত বটেক, অনেক দাগ লাই আর। উ তোদের বড়লোকরা যে বিড়ি খাস কিনে, উ ঠো ধরায়ে চেপে ধইরতো পেটের নীচে, মোম গইলে ফেইলতো পেছনে, চইলতে পাত্তাম না, বড় বেদনা হতোক। তবে ঘোষবাবু আর উ লোকগুলো খারাপ লয়, শুধু কইরতো, পরথমে রক্ত বেরোতো, পরে আর বেরোয় লাই’।
— ‘পুলিশে জানাওনি? ওদের শাস্তি হওয়া উচিত’।
— ‘তুই পাগল হলি মেমসাহেব? উয়ারাও তো খেতে চাইবেক মুকে, টাকাপয়সা লাইক মোর, শুধু শরীলডা আছে। পেট চালাতি হবেক তো, থাকমু কুথায়? আচ্ছা তুই আসবিক? মুই মজা দিতি পারিক খুব, যা বইলবি কইরবো, তুরা তো ব্যথা দিতে পচ্ছন্দ করিস কেনে, তাই দিস। আঠা শুঁকিনা অনেকদিন, আয় লা, পয়সা দিবিক কুছু’।
উঠে দাঁড়ায় ঈশানী, নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলে দরজার দিকে। পালাতে হবে তাকে, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার… মানুষ এত নিষ্ঠুর!
* * *
করিডর দিয়ে ছুটতে ছুটতে উঠোনে নামে ঈশানী, দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে হুহু করে, গলায় আঙুল দিয়ে উগরে দেয় বমি একদলা ঘেন্নাসহ একঝলক তাজা রক্ত।
— ‘জীবনকে যতটা সহজ ভাবিস ততটা সহজ নয় রে মেয়ে, বড্ড কঠিন জীবনযাপন। ঘেন্না করিস না… মাত্র পনেরো বছর বয়স… বড্ড কঠিনীভূত… সবাইকে এক ভাবে… থেরাপি চলছে ঠিক হয়ে যাবে’। স্বগতোক্তির মত বলে চলেন সুমিতা দেবী, অন্ধকার মেখে হাঁটতে থাকে ঈশানী, দূরে কোথাও কোনো কড়িকাঠের ফাঁকে ডেকে ওঠে টিকটিকি, ‘ঠিক…ঠিক…ঠিক’। মনে পড়ে মুখপুস্তিকার পাতায় লেখা দুলাইন – ‘শহরের বুকে ভালো থাকা শুধু মুখোশিত অভিনয়/ ল্যাম্পপোস্টের নীচে শুধু নারী নয় পুরুষও বিক্রি হয়।।’