সংকেত

লেখক: শতদল চক্রবর্তী

চোখের সামনে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেলো গাড়িটা। নিমেষে হারিয়ে গেল সংকেতের দৃষ্টিসীমা থেকে। কানে এখনও কথাটা বাজছে,  “আসি”।
সংকেতের মুঠো আলগা হয়ে সদ্য পাওয়া নোটবইটা পড়ে যায় মাটিতে। তার মাথায় আসে,  ‘এ কেমন কথা বলা?  আসি বলে চলে যাওয়া’। নোটবই কুড়িয়ে তার প্রথম পাতাতে এটাই লিখে রাখে সে।
আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে, তারপর বাড়ি ফিরে আসে। তখন খুবই মানসিকভাবে ক্লান্ত ছিল সে। তাই সোজা বিছানায়; শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে যায়, আসে না ঘুম। মাথায় সেই একটা কথাই বার বার আঘাত করতে থাকে “আসি”।
এর আগেও বহুবার অনেক কিছুই সংকেতকে ছেড়ে গেছে, সংকেতও অনেক কিছুই ছেড়ে এসেছে। কিন্তু এবারে সে কেমন অসহায়। “আসি” কথাটা তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন?  এ প্রশ্নের উত্তর সে পায় না। ভেবেই চলে তবুও পায় না।
 
আ্যলার্ম দেওয়া হয়নি রাত্রে, যখন ঘুম ভাঙে ঘড়িতে তখন সকাল ১১:৪০।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই তার। উঠে বসে সে, কাল কি গোটাটাই স্বপ্ন ছিল?  যাচাই করার জন্য নোটবইটা হাতে নেয় সে, এখনও তাতে ধুলো লেগে। খুলে দেখে প্রথম পাতায় সেই লাইনটাই লেখা – এ কেমন কথা বলা?  আসি বলে চলে যাওয়া।
সব মনে পড়ে যায় তার। কিছুক্ষণ ভাবে আরও, তারপর উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। অফিস যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না আজ। দোনামনা করে বেরিয়েই পড়ে স্নান সেরে।  আজ আর অফিসের গাড়ি নেবে না। কিছুটা হেঁটে যায়, তারপর বাসে চেপে পড়ে। দুপুরের দিকের বাস হওয়ায় ভিড় খুব একটা থাকে না। অফিসের কিছু আগে নেমে পড়ে। ফুটপাথের দোকান থেকে একটা গোল্ডফ্লেক নিয়ে ধরিয়ে ফেলে, একটান দিতেই কেমন বিস্বাদ লাগে আজ। ফেলে দেয়। কয়েক পা হেঁটে গেট পেরিয়ে অফিস ঢোকে। ইতিমধ্যে ফোন আসে সোজা মিটিং রুমে আসার। কাল সন্ধে থেকে কিছু খাওয়া হয়নি,  খিদেও পেয়েছে প্রচুর। তবুও সোজা মিটিং রুমেই ঢুকে পরে সংকেত। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলে আলোচনা। আজ সংকেত কোনো কথাই বলে নি। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক সে। কয়েকজন কলিগ জিজ্ঞেসও করে কী হয়েছে তার, ছটফটে-বাচাল ছেলেটা আজ এমন চুপচাপ হওয়াতে সন্দেহ হয় তাদের। সংকেত প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। গতানুগতিক উত্তর তার, “কিছু না,  শরীরটা অল্প খারাপ আর কী।”
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়,  বাইরে বেরিয়ে পড়ে চা খেতে, সাথে একটা ডিম টোস্ট। গত ২২ ঘন্টায় কিছুই খাওয়া হয়নি।
চা টোস্ট পর্ব চুকিয়ে ফিরে আসে, সিগারেট ধরানোর সাহস হয় না আর। কাজে মন দিতে পারে না সে। অনেক দিন পর তার আজ আবার মনে হয় এরকম ধরা বাঁধা জীবন তার জন্য নয়। পাল্টাতেই হবে তাকে। এভাবে চলতে পারে না। শরীর খারাপ এর দোহাই দিয়ে বেরিয়ে পরে অফিস থেকে। সোজা বাড়ি। বাড়ি ফিরে ভাবতে শুরু করে এরপর কী করবে সে, চাকরী ছেড়ে দেবে?  তারপর?
 
৭ মাস কেটে গেছে, সংকেত এখন পুরুলিয়াতে থাকে। একটা গ্রামে আদিবাসী ছেলেদের পড়ায়। তার বদলে কিছু খাওয়াপরা জুটে যায়। এখানকার আদিবাসীরা খুবই সহজ সরল মানসিকতার। তাই সহজেই বাইরের কাউকে আপন করে নেয় এরা। ২-৩ মাস পর একবার করে গ্রাম এর বাড়ি যায় সংকেত, মা-বাবার সাথে দেখা করতে। মা-বাবা আজও বুঝতে পারে না ছেলেটার হঠাৎ কী হল!
দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে যায়। কলকাতার কিছু বন্ধুদের সাহায্যে এখানে একটা স্কুল তৈরি করেছে সে। আবাসিক স্কুল। সংকেত এর ভাষায় “যৌথ খামার”।  ছোটো ছেলেদের নিয়ে দিব্যি দিন কাটে তার। খেলার মধ্যে দিয়ে তাদের পড়ায় সে। যাকে বলে “পড়া পড়া খেলা”। হঠাৎ হঠাৎ ছেলেদের নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পরে এদিক ওদিক।
ঠিক এমন ভাবেই তারা অযোধ্যার দিকে যায় একদিন, পাখি পাহাড়। হঠাৎ তার পিঠে কেউ একজন সজোড়ে ধাক্কা মারে, পিছনে ফিরতেই দেখে স্বাগতা।
“তুই এখানে? ” বলে সংকেত।
“আরে এটা তো টুরিস্ট স্পট, মানুষ তো ঘুরতে আসবেই। আমিও মানুষ, ঘুরতে এসেছি। কিন্তু তুই এখানে কেন? ঘুরতে? ” বলে স্বাগতা।
“নাহ, আমি গত দু’বছর এখানেই থাকি।”
“মানে?  তুই কলকাতায় আর থাকিস না?  চাকরি? “
“ছেড়ে দিয়েছি, এখানেই থাকি, স্কুল করেছি। ছেলেদের পড়াই, মন্দ কাটছে না দিনগুলো।”
“তাই বলে অতবড় চাকরি ছেড়ে এখানে পড়ে আছিস? হঠাৎ এ খেয়াল মাথায় চাপল কেন? “
“হঠাৎ?  হঠাৎ না তো,  ইচ্ছেটা অনেকদিন ধরেই ছিল। সুপ্ত,  একটা অনুঘটক এর দরকার ছিল। পেয়ে গেলাম আর বেড়িয়ে পড়লাম। আসলে এরা খুবই সহজ সরল জানিস তো। আমাকে না দেখতে পেলেই মনমরা হয়ে পড়ে। দু’দিন গ্রাম এর বাড়ি গিয়ে ফেরার পরেই এদের মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। আমিও অবলম্বন পেয়ে গেলাম আরও কিছু দিন বাঁচার। আর যেই ছেড়ে যাক আমায়, এরা ছেড়ে যাবে না। সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।” এই বলেই হাসতে শুরু করে সংকেত।
স্বাগতা খানিকটা অবাকই হয়। তাছাড়া হাসিটার মধ্যেও কিছু একটা চাপা হতাশা লুকিয়ে আছে বলে মনে হয় তার।
“যাই হোক, অনেকদিন পর দেখা হয়ে ভাল লাগলরে, ভালো করে স্কুল চালা, আর খুব ভাল থাকিস। আসি”- স্বাগতা বলল, বলেই হাঁটা দিল গাড়ির দিকে।
“আসি” কথাটা অনেকদিন পর শুনল সংকেত। বুকের ভিতরে আবার চাপা যন্ত্রণাটা জেগে উঠল। সেই আবার গাড়ির ধোঁয়া, গাড়ি চোখের সামনে থেকে নিমেষে উধাও হওয়া। সব আবার যেন রিপিট হচ্ছে চোখের সামনে। নাহ এবারে আর হাতে কারো দেওয়া নোটবই নেই।
কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে সে।
বাচ্চা ছেলেদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। ফিরে যায় আবার, স্কুলের হস্টেলে। দিন আসে দিন যায়।
এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চোখ পড়ে স্কুলটার দিকে। তারা চায় না স্কুলটা চলুক। এতে সরকারের অকর্মণ্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। যেটা সরকার করতে পারছে না সেটা কয়েকটা সাধারণ ছেলে মিলে কীভাবে করে চলেছে!
লোকাল পার্টি অফিসে ডাক পড়ে সংকেতের।
প্রথমে তাকে বলে তারা স্কুলটা সরকারের কন্ট্রোলে নিতে চায়। সংকেত রাজি হয় না। সে জানে এরকমটা হলে তার যৌথ খামার ভেঙে যাবে, যেতে বাধ্য।
প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এবারে ভয় দেখানো শুরু হয়। প্রথমে স্কুল ভেঙে দেওয়ার, পরে সংকেতকে খুনের হুমকি। সংকেত মানে না প্রস্তাব। বড় একরোখা সে। তাই হয়তো একাও।
এইভাবে আরও কয়েকমাস পেরিয়ে যায়। দেখতে দেখতে কয়েক বছরও। সংকেত এর যৌথ খামার এর কথা ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে, এমন কী কলকাতাতেও।
তার এই প্রয়াস, প্রতিকূলতা, সাফল্যর কথা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাকে কলকাতাতে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হয়। স্থান নন্দন চত্বর। কিন্তু সে প্রচার বিমুখ, তাই স্কুলের প্রচারের ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চায়; অথচ ওই একই অনুষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এক রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার আয়োজনও হয়। সংকেতের ও খুব ইচ্ছে এই অনুষ্ঠানটায় যোগ দেওয়ার। সেও কোনো রকম ধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় উদ্যোগী।
দর্শকাসনে থাকাকালীন হঠাৎ সে দেখতে পায় তন্নিষ্ঠাকে। সে এখানে কেন?  চোখের ভুল কি না বুঝতে পারে না সে খানিকক্ষণ। কিছু পরে ভালোভাবে লক্ষ করে বোঝে সত্যিই ওটা তন্যিষ্ঠা। কথা বলার চেষ্টাও করে না সংকেত।
উদ্বোধনী সংগীত আর ভাষণের পর সংকেত এর ডাক পড়ে মঞ্চে আসার জন্য।
সে তার অভিজ্ঞতার কথা সবার সাথে ভাগ করে নেয়। বাকিদের অনুপ্রাণিত করে। হাততালিতে ভরে যায় গোটা নন্দন চত্বর।
বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় একটা কান ফাটা আওয়াজ।
চমকে যায় সবাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সংকেত।
বুকের বাঁদিকে একটা গভীর ক্ষত। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে,  বাতাসে বারুদের গন্ধ। কেউ একজন গুলি চালিয়েছে, সোজা সংকেত এর বুকে, হৃৎপিন্ডে। লুটিয়ে পড়েছে সে মাটিতে, কাতরাচ্ছে। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
ভিড় ঠেলে কাছে আসে তন্নিষ্ঠা। সংকেত এর দৃষ্টি আবছা হয়ে আসে। আবছা দৃষ্টিতে সংকেত চিনতে পারে তন্নিষ্ঠাকে। তন্নিষ্ঠার দু’চোখ বেয়ে জল। সংকেত হাত তুলে তন্নিষ্ঠাকে কাছে ডাকে, কাছে ডেকে শেষ শব্দ উচ্চারণ করে সে, “আসি”।
মঞ্চের পিছনে থাকা সাউন্ড সিস্টেম এ তখন বেজে চলেছে নজরুলগীতি –
“জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা,
মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল।
মুখপানে যার কভু চাওনি ফিরে,
কেন তারি লাগি আঁখি অশ্রু সজল”


লেখকের কথা: শতদল চক্রবর্তী
শতদল চক্রবর্তীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মানকর গ্রামে। পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, বর্তমানে কর্মসূত্রে কলকাতায় বসবাস। গল্প ও কবিতা পড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের লেখা (article) পড়ার শখ। জ্যোতির্বিজ্ঞান, space-time ইত্যাদির দিকে ঝোঁক রয়েছে তাই এই ধরণের বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালবাসে। এছাড়া বাগানের ফুল শাকসব্জি ফলানোর ও ঝোঁক আছে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।