পতনের সূচনা!

ইংরাজিতে মূল রচনা: টি. বিজয়েন্দ্র
অনুবাদ: সম্বিত শুক্লা


সারসংক্ষেপঃ শেষ পর্যন্ত নোভেল করোনা ভাইরাস, COVID19 শিল্প বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির পতনের সূত্রপাত করেছে। এই নিবন্ধের প্রথম অংশে, আমরা এই পতন এবং গত দেড় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন সবুজ উদ্যোগগুলি যে সমাধানগুলির প্রস্তাব দিয়েছে সেগুলির রূপরেখা তুলে ধরেছি। তবে COVID19 একটি অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। COVID19 চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সবচেয়ে ভাল পদ্ধতিটি হ’ল আগামী ছয় মাস বা তার বেশি সময় ধরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সামাজিক দূরত্বকে বজায় রেখে কিভাবে আমরা বিশ্ব অর্থনীতির পতন সংক্রান্ত এই ‘সমাধানগুলি’ বাস্তবায়ন করব? আমরা কি এই ছয় মাস অপেক্ষা করব এই পরিস্থিতি থেকে সামলে উঠতে? দ্বিতীয় পরিচ্ছদে আমরা এই বিষয়টি ভেবে দেখব।

প্রথম পরিচ্ছদঃ পতন

১। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতি ধীরে চলছে। বলা হচ্ছে এটি পুঁজিবাদের ইতিহাসে দীর্ঘতম মন্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই গত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রায় প্রত্যেক দশ বছরে এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রত্যাশা করেছিল। গত বছর থেকেই গোটা বিশ্বজুড়ে একটা বড় মন্দা শুরু হয়েছে। অনেকেই একটি ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট’ ( এটি একটি রূপক, এর দ্বারা এমন একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে বোঝায় যার সুদীর্ঘ প্রভাব থাকে) ঘটার আশা করেছিল এবং মাত্র দু’মাস আগে লোকেরা অস্ট্রেলিয়ার দাবানল বা পঙ্গপালের আক্রমণকে ভেবেছিল এমনই একটি ঘটনা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে,  COVID19 হল সেই ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট’।

২। এই ঘটনাটিকে শতকে একবার ঘটে এরকম ঘটনা হিসেবে ধরা হচ্ছে এবং ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সাথে তুলনা করা হচ্ছে যে ঘটনায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। শুধু ভারতেই ১.৮ কোটি মারা গিয়েছিল ফলত  ১৯১১ থেকে ১৯২১ সালের আদমশুমারির মধ্যে জনসংখ্যা বাড়েনি। ভারতে এরকমই কিছু ঘটনা ঘটেছিল যেমন ১৯৪৩ সালের বাংলায় দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ সালের দাঙ্গা যেখানে মৃতের সংখ্যা প্রায় লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

৩। তবে এবারের ঘটনা উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলির থেকে আলাদা। মৃত্যুর সংখ্যা কী হবে তা আমরা জানি না, এবং ভারতে সঠিক প্রতিবেদনের অভাবে আমরা সম্ভবত কখনই জানতে পারব না। তবে এই সংকট একটি যুগের সমাপ্তি ঘটনা – শিল্পসভ্যতা বা পুঁজিবাদের সমাপ্তি।

৪। এর কারণ হ’ল, এই সংকট অন্যান্য সংকট সঙ্গে নিয়ে আসছে এবং সব মিলিয়ে যেকোন একটি সংকটের  চেয়ে বড়। সংকটগুলি হ’ল: ১. বিশ্ব উষ্ণায়ন ২. সম্পদ হ্রাস ৩. বাস্তুতন্ত্রের অবক্ষয় ৪. অসাম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।

৫। এই মহাসংকট এর ফল হল ১. বর্তমান অর্থনীতির পতন ২. বিশ্বায়নের সমাপ্তি ৩. অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলির সংকোচন যেমন আকাশপথে ভ্রমণ, গাড়ি শিল্প, পর্যটন, পেট্রো-কেমিক্যাল শিল্প, লৌহ-ইস্পাত, কয়লা ইত্যাদি ইত্যাদি।

৬। বিকল্প ব্যবস্থায় থাকবে: ১. সমতা ২. সম্পদ-বিশেষত শক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনা ৩. স্থানীয় স্বনির্ভর অর্থনীতি ৪. বর্তমান অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ৫. নীতিনিষ্ঠ, সহযোগিতাপূর্ণ ও কম প্রতিযোগিতামূলক মূল্যবোধ নির্ভর ব্যবস্থা

৭। রাজনৈতিক পর্যায়ে এটি বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক রাজ্যগুলির সমষ্টি হবে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান ভারত বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে ৬৫টি রাজ্যের একটি সমষ্টি হতে পারে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত হবে বাস্তুতান্ত্রিক সীমানা এবং এমন একটি সীমানা যার দুপাশে কোনও উত্তেজনা নেই।

৮। স্থানীয়রা কীভাবে সংগঠিত হবে তা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করবে। এই বিষয়টি অন্য একটি পুস্তিকায় বিশদে লিখেছি।

৯। মূলত প্রায় ১০টি বিষয়ের উপর স্থানীয় অর্থনীতি পুনর্গঠিত হবে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা ট্রানজিশন টাউন মুভমেন্ট শহরগুলিকে নেওয়া যায়।

১০। এই ১০টি বিষয় হল: ১. বায়ু ২. জল ৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ৪. খাদ্য উত্পাদন ৫. শক্তি ৬. স্বাস্থ্য ৭. শিক্ষা ৮. আবাসন ৯. কমন্স এবং হেরিটেজ ১০. কর্মসংস্থান এবং উদ্যোগ।

বিশদে জানতে ‘Kabira khada bazar mein: A call for local action in the wake of local emergency’ পুস্তিকাটি পড়ুন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছদঃ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অর্থনীতির পুনর্নির্মাণ

১। স্পষ্টত এটি একটি জটিল সমস্যা বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের কাছে ছয় মাস অপেক্ষা করার বিকল্প রয়েছে – ঝড়টি বইতে দিন এবং তারপরে আমরা পুনর্নির্মাণ শুরু করি। তবে আমরা জানি না যে এই ছয় মাসে কী ঘটবে এবং আমরা এতটা দেরি করতে পারি কিনা। সুতরাং আমাদের এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে  যে কীভাবে COVID19 -এর মুখোমুখি হয়ে অর্থনীতি পুনর্নির্মাণ করা যায় এবং অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করার অনুশাসন মেনেই।

২। এর একটি সম্ভাব্য উত্তর হ’ল এই মহামারীটির উত্থান এবং পতন ভাল করে বোঝা। আমরা দেখেছি যে এটি চীনে শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এবং সারা বিশ্ব জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।  চীনে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বিশ্বের অনেক জায়গায় এর বিস্তার কম এবং তারা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। আধুনিক অর্থে বিশ্বের এই অংশগুলি ‘অনুন্নত’, অর্থাৎ এইসব অঞ্চলে পুঁজিবাদী সমাজের অনুপ্রবেশ খুব কম। সুতরাং নতুন উদ্যোগটি দু’ক্ষেত্রেই এক সঙ্গে শুরু করা উচিত: যে অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করেছে এবং যে অঞ্চলগুলি গুরুতরভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

৩। দু’ক্ষেত্রেই সুবিধা রয়েছে সেটা আমরা বুঝতে পারছি। যেসব অঞ্চলে পুনরুদ্ধার ঘটেছে – সেগুলি খুব উন্নত এবং সেখানে রয়েছে উচ্চস্তরের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশ সচেতনতা। ১৯৯১ সালে কিউবা যখন এই ধরণের সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিল অনেকটা সেরকম পরিস্থিতি। আমরা কি আশা করতে পারি যে এই অঞ্চলগুলি – চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি কিউবার মতো প্রতিক্রিয়া জানাবে?

৪। পিছিয়ে পড়া বা অনুন্নত অঞ্চলগুলির অনেকগুলি আদিবাসী বা দেশীয়দের এলাকা। তারা নিজেরা কোনও সমস্যার মুখোমুখি হয় না। আমরা যে ধরণের জিনিস পছন্দ করি তাদের কাছে সুন্দর ঐতিহ্য হিসেবেই আছে। তাদের ক্ষেত্রে এত পুনর্নির্মাণের দরকার নেই। মূল সমস্যাটি হ’ল পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশ এবং বাজারী অর্থনীতির প্রভাব বা শহুরে জীবনের চকচকে প্রভাব অর্থাৎ পোশাক, ছায়াছবি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, স্মার্ট ফোন, মোটরসাইকেল ইত্যাদির থেকে মুক্ত করা। এখনও পর্যন্ত এটি গুরুতর সমস্যা তবে অর্থনীতির পতনের সাথে সাথে এই সমস্যার মুখোমুখি হওয়া তুলনামূলকভাবে সোজা হবে।

৫। ভারতে করোনা ৩০ জানুয়ারি কেরালায় শুরু হয়েছিল এবং কেরালা সম্ভবত আগে পুনরুদ্ধার করবে। ট্রানজিশন কেরালার কথা অনেকদিন থেকেই হচ্ছে। এই জাতীয় গোষ্ঠীগুলির এখুনি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে সক্রিয় হওয়া উচিত। এছাড়াও কেরালায়, বিশেষত উত্তর কেরালায় আদিবাসী অঞ্চল রয়েছে এবং সেখান থেকেও প্রথমে কাজ শুরু করা যেতে পারে।

৬। এই মুহূর্তে মহামারী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে আমরা কী করব?  প্রথম কাজটি হ’ল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ত্রাণ সংগঠিত করা। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন বিভিন্ন সমাধানের উদ্ভব হচ্ছে। মূলত সমস্ত লোকের কাছে খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি চালিয়ে যাওয়া প্রাথমিক কাজ। এর মাঝেই বৈদ্যুতিন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে স্থানীয় সবুজ গোষ্ঠীগুলির উচিত কিভাবে পুনরুদ্ধার এবং পুনর্নির্মাণ করা হবে তার পরিকল্পনা শুরু করা। অনেক এনজিওর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভাল অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে কিছু ভাল উদ্যোগ আসবে – সেটা আশা করা যায়।

বি.দ্র. – লেখাটি ২১ মার্চ, ২০২০ তারিখে লিখিত। কিছুদিনের মধ্যেই ‘কোলাপ্স’ ভারতেও হয়ত আসতে চলেছে। করণ থাপারের নেওয়া জয়তী ঘোষের সাক্ষাৎকার ‘দ্য ওয়্যার’ ( The Wire) দেখুন, যদিও সেটা লক ডাউনের আগে নেওয়া। গত কয়েকদিন যথেষ্ট উদ্বেগজনক খবর আসছে, সে জন্য লেখাটির ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কে বলতে পারে হয়ত কিছুদিন পর ইন্টারনেট এক্সেস থাকবে কিনা! (৩০ মার্চ, ২০২০)


লেখক পরিচিতি: সম্বিত শুক্লা
সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্বিত শুক্লা গল্প, কবিতা ইত্যাদি লেখেন ‘ইচ্ছেমৃত্যু’ ছদ্মনামে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি লেখা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যেখানে গল্প, কবিতার রূপকের বাইরে বেরিয়ে যুক্তি ও তথ্যের দায় বেশি। জীবিকার পাশাপাশি সববাংলায় এর কাজেই দিনের বেশিটা সময় অতিবাহিত হয় বাকিটা কাটে বইপত্র ও লেখালিখি নিয়ে।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।