লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য
গত পর্বের লিঙ্ক এখানে
পর্ব ১০ এ আলোচনা শুরু করেছিলাম রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের আজ এবং কাল নিয়ে। মনে রাখা দরকার যে কোনও শিল্প টিঁকে থাকে সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট করবার মধ্য দিয়ে। এবং সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে। দেখুন TATA কোম্পানি, যারা ট্রাক বানায়, যারা লোহার রড বানায়, তারা নুনও বেচে। অর্থাৎ ব্যবসার কোনও ক্ষেত্রকেই ছাড় দেওয়া নয়। সব ক্ষেত্রেই নিজের লিডারশিপ প্রতিষ্ঠা করা। Aditya Birla সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি মলেরও মালিক। অন্যদিকে মেটিয়াবুরুজের দিকে তাকান। যিনি বাবাস্যুট বানান, তিনি এমনকি জিন্স বানিয়ে দেখতেও রাজি নন। অথচ ডাইভারসিফিকেশন যে কোনও ব্যবসার বেড়ে ওঠবার প্রাথমিক শর্ত।
মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগর পরিবারগুলির দিকে তাকান। দেখতে পাবেন রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। অথচ মাড়োয়ারি পরিবারে একজন সদস্যও বসে থাকেন না। প্রত্যেকের হয় নিজস্ব ব্যবসা আছে। অথবা পারিবারিক ব্যবসায় তার সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে। শুরুর দিকে লিখেছিলাম মেটিয়াবুরুজের “অর্ধেক আকাশ”, তার নারী শক্তি আজও অন্ধকারে ঢাকা। আমাকে গালি দিতেই পারেন। কিন্তু তাতে বাস্তব বদলাবে না।
একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। প্রদীপ আগরওয়ালের নাম হয়তো আপনারা শোনেন নি। কিন্তু AMRI হাসপাতাল অথবা Starmark এর নাম নিশ্চিত শুনেছেন। প্রদীপ আগরওয়াল এবং তার পরিবার আরও বেশ কিছু ব্যবসার সাথে সেই কোম্পানি গুলিরও মালিক। তার একমাত্র ছেলেকে আমি পড়াতাম। অত্যন্ত মেধাবী ক্লাস এইটের ছাত্র। ওইটুকু ছেলে আমাকে কিভাবে শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করতে হয়, ডিটেইলস বুঝিয়ে দিয়েছিল। অবসর সময়ে মায়ের D-Mat Account থেকে নিয়মিত ইনভেস্ট করা ওর ফেভারিট নেশা ছিল। এভাবেই ব্যবসা পুরুষানুক্রমিক ভাবে প্রসারিত হয়। আগরওয়াল পরিবারে প্রদীপ বাবুর স্ত্রী এবং বৃদ্ধা মা Starmark এর ব্যবসা দেখতেন। তুলনা করে দেখুন মেটিয়াবুরুজের সাথে। উত্তর আপনি নিজেই পেয়ে যাবেন।
মেটিয়াবুরুজে শিক্ষার বিস্তার কেন রুদ্ধ? অনেকেই যুক্তি খাড়া করেন পারিবারিক ব্যবসায়ে খুব কম বয়সে যোগ দিতে হয় বলেই আর পড়াশোনায় বেশিদূর এগোনো যায়না। এটা একেবারেই কুযুক্তি। ওপরে যে আগরওয়াল পরিবারের উদাহরণ দিলাম, এমন উদাহরণ মাড়োয়ারি পরিবারে অজস্র রয়েছে।
মেটিয়াবুরুজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছেলে হোক বা মেয়ে, কম বয়সে তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া। কম বয়সে বিয়ে, তাই কম বয়সে বাচ্চার জন্ম দেওয়া। আবার সেই বাচ্চার ২০-২২ বছরেই বিয়ে। অর্থাৎ এ এক দুষ্ট চক্র, যা একটা কমিউনিটির যাবতীয় উন্নতির সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত করছে। মাড়োয়ারি পরিবার গুলিতেও দুই তিন পুরুষ আগে কম বয়সে, বিশেষত মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন থাকলেও আজ খুব চেষ্টা করেও এমন একটি মাড়োয়ারি পরিবার খুঁজে পাবেন না, যেখানে কম বয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিভাবে তারা পারলেন? ওই কমিউনিটি বন্ডিং এর কারণে। কারণ কমিউনিটি থেকে একঘরে করে দেওয়ার ভয়। তাই আজ মাড়োয়ারি পরিবারে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার সংখ্যায় ভাঁটার টান।
তাহলে মেটিয়াবুরুজ কেন পারবে না? পারিবারিক ব্যবসা তে যোগ দেওয়ার পরেও পড়াশোনা চালানো যায়। আর সেই পড়াশোনা যদি একান্ত ভাবে ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকে, তাহলে তাতে সাগ্রহে এলাকার ছেলে-মেয়েরা (আমি ছেলে এবং মেয়ে, দু’দলের কথাই বলছি কিন্তু) পড়তে এগিয়ে আসবেই। কি হতে পারে সেই পড়াশোনার সিলেবাস? অবশ্যই প্রথমে আসবে Fashion Designing। আধুনিক রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে ফ্যাশন ডিজাইনার। তারাই আধুনিক গারমেন্টস শিল্পের মুখ্য ভূমিকায়। দ্বিতীয় যে বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা করা দরকার, সেটা হচ্ছে Online Marketing। আর তার সাথে আসবে Brand Building এবং পেটেন্ট। অর্থাৎ প্রতিটি ব্র্যাণ্ড যদি পেটেন্ট নেওয়া থাকে, তাহলে কেউ কারোর নকল করতে পারবে না। মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের নিজস্ব পরিচিতি হবে বিশ্বের বাজারে। সাথে দরকার Management Training Institute।
বাংলার কৃষি ব্যবস্থা আজ লোকসানে চলা একটি ক্ষেত্র। যেখানে লাভের মুখ দেখতে আল্লা, ভগবান ভরসা। এর অন্যতম কারণের একটি “ছদ্ম বেকারত্ব (Disguised Unemployment)”। একটা উদাহরণ দেই। আপনার পাঁচ বিঘে জমি। আপনার পরিবারে ৭ জন সদস্য। সকলেই হাত লাগায় চাষের কোনও না কোন কাজে। কেন? যুক্তি হিসেবে বলা হয় নিজের জমিতে চাষের কাজ করলে ঘরের টাকা ঘরেই থাকবে। এবং চাষের কাজ শিখবে। কিন্তু যেটা এড়িয়ে যাওয়া হয়, সেটা ওভারহেড কস্টিং। যে কাজ চারজন লেবার করতে পারে, সেই কাজে সাতজন লাগলে হিউম্যান রিসোর্স অপচয় হয়। এবং “ঘরের টাকা ঘরেই থাকবে” এর চক্করে ওভারহেড কস্টিংয়ে ভুল হয়। ফলে লাভের অঙ্কেও সেই ভুলই থেকে যায়।
একই ট্রেন্ড মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস ব্যবসাতেও রয়েছে। অতিরিক্ত এখানে যুক্ত হয়েছে নারীদের বাদ দেওয়ার প্রবণতা। মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পে একই ভাবে “ছদ্ম বেকারত্ব” বহুল পরিমাণে রয়েছে। অন্যদিকে মাড়োয়ারি পরিবারের ব্যবসাতেও পরিবারের সদস্যরা যুক্ত। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট কাজ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে লভ্যাংশের ভাগ। ফলে ওভারহেড কস্টিং বার করতে কোনও সমস্যা হয়না। তাই প্রফিট বুকিংও পারফেক্ট হয়। গত পর্বে একজন পাঠক একটি অসাধারণ উক্তি করেছেন। তাঁর মতামত কোট করবার লোভ সামলানো গেলো না। “ওস্তাগার হবার চিন্তা ভাবনা ছেড়ে, Entrepreneur হবার জন্য কি কি করা উচিত, সেগুলো শিখতে হবে। তবেই মাড়োয়ারি কমিউনিটির সাথে পাল্লা দিতে পারবে।” Entrepreneur হয়ে ওঠাই লক্ষ্য হওয়া উচিত।
যখন এলাকার ছাত্রছাত্রীদের স্কুল শিক্ষার শেষে রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পের সাথে যুক্ত কোনও একটা প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্সে যুক্ত করে দেওয়া হবে, তখন দ্বিমুখী লাভ দেখা যাবে। প্রথমত রেডিমেড গারমেন্টস শিল্পে বেসিক ভাবনায় পরিবর্তন (হাটে বসে বস্তা ভরে পাইকারি মাল বেচাতেই মোক্ষ লাভ) আসবে। তার সাথে ছেলে-মেয়েদের অল্প বয়সে প্রেম/বিয়ের প্রবণতা কমবে ধীরে ধীরে।
লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।