লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য
শোষণের আর এক নাম : ব্যাজ
কেউ বলে বিয়াজ, কেউ ব্যাজ। আবার কেউ কেউ বলে ব্যাচ। আক্ষরিক অর্থে বিয়াজ বা ব্যাজ শব্দের অর্থ “সুদ”। কিন্তু মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগরী পরিভাষায় ব্যাজ এর অর্থ ছাড় বা ডিসকাউন্ট। তবে এ বড়ো আজব কুদরতি! এই ডিসকাউন্ট বিক্রেতা ঠিক করে না। ঠিক করে ক্রেতা। এবং ক্রেতা দ্বারা নির্ধারিত এই ছাড় দেওয়া বাধ্যতামূলক।
একটু ঝেড়ে কাশি বরং। তাহলে মেটিয়াবুরুজের বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বুঝতে সুবিধা হবে। মেটিয়াবুরুজে হাট ভিত্তিক ব্যবসার শুরুর দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খরিদ্দারদের হাটে নিয়ে আসার মূল দায়িত্ব পালন করতেন গদি মালিকেরা। ভুলেও ভাববেন না যে গদি মালিকেরা মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগরদের যাতে সুবিধা হয়, তার জন্য খরিদ্দার নিয়ে আসতেন। খরিদ্দার নিয়ে আসা এবং খরিদ্দার যত টাকার মাল কিনবে, সেই দামের একটা অংশ গদি মালিকেরা কেটে নিতেন। এটাকে এক প্রকার দালালী বলেও মনে করতে পারেন।
প্রথম দিকে খরিদ্দার এবং ওস্তাগর, এদের মধ্যে সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিলো না। ফলে মাল বিক্রি করবার জন্য গদি মালিকেরাই ছিল একমাত্র মাধ্যম। অভিজ্ঞতা মানুষকে শিক্ষিত করে তোলে। ওস্তাগর ভাইদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। যেহেতু খরিদ্দারদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল গদি মালিকেরা, তাই খরিদ্দাররাও গদি মালিকদের ওপরে নির্ভর করতে বাধ্য ছিলেন।
ওস্তাগররা কাস্টমারদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তোলবার জন্য মালের বক্সের ভেতরে মালের সাথেই নিজেদের কার্ড দিতে থাকলেন। ফলে কাস্টমারদের পক্ষে সরাসরি ওস্তাগরদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে উঠলো। এর ফলে গদি মালিকদের একচেটিয়া মাতব্বরি খানিকটা হলেও ধাক্কা খেল। বিশেষত দক্ষিণের রাজ্য গুলি থেকে কাস্টমাররা সরাসরি মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগর ভাইদের কাছে এসে কেনাকাটা সারতে লাগলেন। গদি মালিকদের কমিশন ব্যবস্থা খানিকটা হলেও বন্ধ হলো। পুরোপুরি বন্ধ কিন্তু হলো না।
মেটিয়াবুরুজের ওস্তাগর ভাইদের সকলেই জানেন যে ব্যাজ দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, তবুও তারা দিয়ে চলেছেন৷ কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আপনাকে অনেক গভীরে যেতে হবে।
মেটিয়াবুরুজে যদি সার্ভে করে দেখা হয়, দেখা যাবে একটা বড়ো অংশের মানুষের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য বড়ো ওস্তাগর হওয়া। এদিকে এখানকার উৎপাদিত সমস্ত গারমেন্টসই আসলে কোনও পপুলার ডিজাইনের কপি পেস্ট। ফলে যেই একটা নতুন ডিজাইন কেউ কপি করে বাজারে ছাড়লেন, অমনি তার দেখাদেখি সকলেই কপি পেস্ট করতে শুরু করে দিলেন। অর্থনীতির প্রাথমিক শর্ত চাহিদা এবং যোগানের ভারসাম্য বজায় রাখা। এবং এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যদি নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন করা যায়, তবে প্রোডাক্টের চাহিদা বজায় থাকে। সহজ করে ভেবে দেখুন সোনা কিংবা হীরে কম পাওয়া যায় বলেই তার এতো দাম এবং কদর।
কিন্তু এখানকার রেডিমেড গারমেন্টস প্রোডাকশন অর্থনীতির প্রাথমিক শর্তটাকেই মান্যতা (নিয়ন্ত্রিত প্রোডাকশন) দেয়না। ফলে কোনও ডিজাইন প্রথম যিনি কপি পেস্ট করলেন, তিনি যদি তাঁর প্রোডাক্ট ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় জনের ক্ষেত্রে সেই মালের দাম দাঁড়ায় ৯০-৯৫ টাকা। এরপরে যত বেশি কপি পেস্ট হতে থাকে, পাল্লা দিয়ে মালের ডিম্যান্ড এবং দামও কমতে থাকে। অবশেষে গদি মালিকেরাই শেষ ভরসা। কারণ তদ্দিনে নতুন ডিজাইন বাজারে এসে গেছে। আর গদি ওয়ালাদের কাছে এটাই মওকা। তারা ওস্তাগরের থেকে মাল খরিদ করবার সময়ে মর্জি মাফিক ব্যাজ লাগায়। এই ছাড়ের অংক ৫%-২৫%, যা খুশি হতে পারে। এবং ওস্তাগরের কাছে গদি মালিকদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
সব থেকে করুণ অবস্থা হয় তখন, যখন গদি মালিকেরাও মাল কিনতে অস্বীকার করে। তখন ওস্তাগরের শেষ ভরসা “লাট ওয়ালা”। লাট ওয়ালা প্র্যাক্টিকালি প্রায় পানির দামেই মাল নিয়ে যায়। যে প্রোডাক্টের দাম ছিল ১০০ টাকা, সেই মালই তখন বেচতে হয় ১৫-২০ টাকায়।
তাহলে ব্যাজ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কি কোনও পথ নেই?
অবশ্যই রয়েছে। তবে চটজলদি সমাধান কিছু নেই। প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদি ভাবনা চিন্তার। এবং সেই ভাবনাকে প্র্যাক্টিকালি কাজে লাগানো।
প্রথমত, এটা বোঝা জরুরি যে ব্যাজ বন্ধের অন্যতম পথ নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন। চাহিদার থেকে যদি জোগান কম থাকে, তাহলেই আপনি আপনার পণ্যের সেরা দাম পাবেন। আর অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের খেসারত হিসেবে গদি ওয়ালাকে ব্যাজ দিতে হবে।
লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।