লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী
রথের দিন রাত্রে আড্ডা যখন প্রায় শেষের মুখে, হাবু এল ঠেকে। হাতে পলিথিন ভর্তি বড় বড় পাঁপড় ভাজা।
কি রে, রথের মেলায় গিয়েছিলি!
ধুর! যাওয়া মানেই খরচা। এখন প্রতিটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
সুযোগের সদ্ব্যবহার মানে? সবাই মিলে একসাথে প্রশ্ন।
উত্তর দেওয়ার আগে পাঁপড়ের প্যাকেটা হাতে ধরিয়ে বলল, বের কর। সবাই মিলে রথের দিনে পাঁপড় ভাজা খাই। সন্ধ্যে থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।
একটা গোটা পাঁপড় খেয়ে ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল হাবু। তারপর পকেট থেকে বাবার প্রসাদ ভরা বিড়ি বের করতে করতে মুখ খুলল।
প্ল্যানটা অবশ্য শুঁটকি সুন্দরীর। সপ্তাহ খানেক আগে যখন মুদিখানার লিস্ট ধরিয়ে দিল, প্রথম দুটো আইটেম দেখেই ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। দেখি লেখা আছে, বড় পাঁপড় – ১০ প্যাকেট, তেল – ৫ কিলো।
দশ প্যাকেট পাঁপড় নিয়ে কি করবে! বিছানায় বিছোবে? আর পাঁচ কিলো তেল! আমার শ্রাদ্ধের রান্না করবে নাকি! তা মেনুটা কি ম্যাডাম?
ঠাট্টা না করে যা বলছি তাই করো। সব ব্যাপারে অত প্রশ্ন করবে না।
তোরা তো জানিস আমি মহিলাদের সাথে ঝগড়া করি না।
কেলো লুফে নিল কথাটা। ব্যঙ্গ কিরে বলল, সত্যিটা বলতে বাবুর লজ্জা লাগছে। বল না বউকে ভয় পাই।
হাবু একদম কুল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, সে তোরা যাই বল। শুঁটকি সুন্দরীর ওপর আমার অগাধ ভরসা। প্যাকপ্যাক না করে আসল কথাটা শোন।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে নির্দেশ এল। আজ দুপুরে ঘুমোবে না। চারটের মধ্যে সব গুছিয়ে বসতে হবে।
কি যে বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না।
তারপরে সব খুলে বলল। হরিসভার মোড়ে পাঁপড় ভাজার দোকান দেব। এক পিস পাঁচ টাকা।
পাঁচ টাকা দিয়ে লোকে কিনবে?
সন্ধ্যে হলেই বুঝতে পারবে।
কি বলব মাইরি। লোকে লাইন দিয়ে পাঁপড় কিনেছে। শুঁটকি ভেজেছে আর আমি প্যাক করে দিয়ে পয়সা নিয়েছি। আমি তো মেয়েটার ফ্যান হয়ে গেলাম।
সে তো কুড়ি বছর আগেই হয়েছিস। গলির মোড়ে কম হাওয়া তো দিসনি! এটা ঠিক মেয়েটার জন্য তোর জীবনটা শুধরে গেল। নাহলে কবেই ভেসে যেতিস। তবে ব্যবসার জিনিস নিয়ে এসে ঠিক করিসনি।
ছাড় তো। ধরে নে সবাই মিলে খাব বলে কিনে এনেছি। লাভ খারাপ হয়নি বুঝলি। এক সপ্তাহের বাজার খরচা উঠে গেছে।
তোদের এই লড়াইটাকে কুর্ণিশ জানাতে হয়। কিছুতেই ভেঙে পড়িস না তোরা।
ভাঙলে চলবে? ভেঙে গেলে তো দখল হয়ে যাব রে!
নেশার ঘোরে কি যে বলিস কিছুই বুঝি না।
বুঝতে হবে ভাই। এই যে রথযাত্রা। ভেবে দেখ কার দেবতা কে দখল করে নিল!
দখল করে নিল মানে?
হাবু যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। ধোঁয়া ছাড়ার স্টাইল দেখেই বোঝা গেল নেশা ধরেছে। আপন মনে বকে যেতে লাগল। কথা একটু জড়ানো।
ইতিহাস জানতে হবে বুইলি। এ খেলা যে অনেক পুরোনো। ভাঙো আর দখল করো।
মানে?
অর্থ আর রাজনৈতিক ক্ষমতা যা চায়, তাই গিলে খায়। রাজা বুদ্ধের ভক্ত। দিকে দিকে গড়ে উঠল বৌদ্ধ মঠ। আবার রাজা বিষ্ণুর হাত ধরতেই মঠ পাল্টে গেল মন্দিরে। লুঠ করতে করতে যাযাবররা এল। ভাঙল, লুঠল, ফিরে গেল। যার থাকতে ইচ্ছে করল দখল করে থেকে গেল। উপাসনা স্থল হাত বদল হল।
সে সব অনেক পুরোনো দিনের ঘটনা। এখন এসব হয় না।
মুখ বেঁকিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে হাবু বলল, তুই কোথা থেকে এসেছিস ভাই?
পৃথিবীর কথা ছেড়েই দিলাম। দেশের খবরও কি রাখিস না? ধর্ম পাল্টায়। ভাঙচুর করে উপাসনা স্থল দখল করা বদলায় না। আইন সভায় উন্মাদ নৃত্য হয়। ভাঙচুরের ফসল ওঠে। দখল করে বসে থাকে লুম্পেনের দল।
বাজে কথা ছাড়। আমরাই ওদের পাঠাই।
বিকট হাসি দিয়ে হাবু বলল, পাঠাই তো। একশ বার পাঠাই। পাঠাব না কেন? আমরা যে ফরমুলায় ঢুকে গেছি। আমাদের কোমর ভেঙে তারপর দানা ছিটিয়ে আমাদের যে দখল করে নিয়েছে।
তার মানে তুই বলতে চাইছিস ….
মুখে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল হাবু। রক থেকে নেমে বলল, হাজার হাজার বছর ধরে একই গল্প চলছে। ভাঙো আর দখল করো। চলি …
এক পা এগিয়ে থামল হাবু। পিছিয়ে এসে মুখ নামিয়ে বলল, তবে একটা ব্যতিক্রম আছে।
ব্যতিক্রম? এক সাথে বলে উঠলাম।
হ্যাঁ। মনের ক্ষেত্রে ব্যপারটা উল্টো। আগে দখল হয় তারপর ভাঙে।
হাবু চলে গেল। তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। সত্যিই জীবন ওকে হাতে ধরে শিক্ষিত করেছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে বললাম – সেলাম ভাই, এভাবেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিগুলো দেখিয়ে যাস।
লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।