হাবুকথা : হার – জিত

লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী

চাওয়া-পাওয়া, লাভ-ক্ষতির হিসেব নিয়ে যখন তর্ক জমে ওঠে, হাবু নির্বিকার চিত্তে বসে থাকে। কখনও আবার বিড়িতে টান দিয়ে বলে, এসব নিয়ে তোরা লড়ে মর। আমার কোনও চাপ নেই। আমি ভাই হেরোর দলে। পাশ থেকে কেউ ব্যঙ্গ করে বলে, ‘দার্শনিকের মত ডায়লগ দিস না তো’ ! ব্যস হাবুর ব্যাখ্যা চালু।

দেখ ভাই, এটা একেবারে চন্দ্র – সূর্যের মত সত্যি। আমি বরাবরের হেরো। পড়াশুনোয় জিরো পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট নিয়ে কোনও মতে ইনস্টলমেন্টে হায়ার সেকেন্ডারী পেরোলাম। কয়েকদিন কলেজ গিয়েই বুঝলাম ফালতু সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কামানোর চেষ্টা করাই ভাল। কিন্তু কাজকম্ম সেরকম কিছুই জুটল না। এখন কোনও রকমে কেতরে কেতরে টায়ার পাংচার হওয়া গাড়ির মত সংসারের চাকা টেনে নিয়ে চলেছি। তবে তোদের মত ভবিষ্যতের কথা ভেবে গলা শুকাই না। যেটুকু কামাই তাই দিয়েই খেয়ে পড়ে বউ – বাচ্চা নিয়ে বেশ আছি।

এ কথা সত্যি হাবু বেশ ফূর্তিতেই থাকে। রাজনীতি থেকে খেলা – কোথায় কি হচ্ছে তার সব খবর রাখলেও তা নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয় না। কে মন্ত্রী হল আর কে জেলে গেল সে ব্যাপারে ওর কোনও মাথাব্যথা নেই। রাজনৈতিক পালাবদলেও ওর কিছু এসে যায় না। তবে একটা ব্যাপার বড় মজার। পাড়ার কাউন্সিলর যে দলেরই হোক, হাবু তার ন্যাওটা হয়ে যায়। নেতার বাড়ির সকালের দরবারে হাবুর উপস্থিতি বাধা থাকে। এমনও দেখা গেছে ভোটের আগে হাবু লালকমলবাবুর হয়ে পাড়ার দেওয়াল লিখছে আর ভোটের পর জয়ী প্রার্থী নীলকমলের বিজয় মিছিলে হাঁটছে। রকের বন্ধুরা ব্যঙ্গ করে বলে হাওয়া মোরগ।

জৈষ্ঠ্যের গরমে আমাদের উত্তপ্ত আড্ডা জমে উঠেছে পঞ্চায়েত ভোট আর কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। ছাপ্পা ভোট সর্বকালের রেকর্ড ছাড়াল কিনা, মোটা দাগের জালিয়াতিকে শিল্পে উন্নত করার জন্য কিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত এসব নিয়ে জোর তর্ক চলছে। তার মধ্যেই আবার বোঝার চেষ্টা দ্রাবিড়ভূমে জনপ্রতিনিধিরা বন্দি ঘোড়া হয়ে মোটা দামের ছোলা খেলেন নাকি অন্তরাত্মার হাহাকারে গণতন্ত্রের গলায় মালা পরালেন! এতসব গুরু গম্ভীর আলোচনার মাঝে হাবু কিন্তু নীরব স্রোতা। তর্কের ঢেউ একটু থিতিয়ে এলে গম্ভীরভাবে বলল, ভোটে কি হয় জানিস?

জ্ঞানদা মুখ খুলেছেন। আমরা নড়েচড়ে বসলাম। ভুতো মুখ বেঁকিয়ে বলল – বলুন প্রভু, কি হয়?

সুখটান দিয়ে বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে হাবুর উত্তর – ভোটে কেউ জেতে , কেউ হারে।

সবাই মিলে হাবুর উদ্দেশ্যে হুংকার ছাড়ল, ইয়ার্কি মারছিস?

হাবু একদম কুল। শান্ত স্বরে বলে, পুরোটা বলতে দে।
ভোটে কেউ হারে, কেউ জেতে। আর একদল বারেবারে হারে। কিন্তু সঞ্চয় করে জেতার শক্তি।

কি হেঁয়ালি করছিস? খুলে বল।

তোদের ব্যাখ্যা করে বোঝানো আমার কম্ম নয়। তার থেকে একটা গল্প শোন।

আবার গল্প! আমাদের দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যাওয়ার আগেই হাবু খিঁচিয়ে উঠল। গুণী মানুষদের কথা বলব। মন দিয়ে শোন, শেখার আছে। গুছিয়ে বসে হাবু শুরু করল তার গল্প।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা …

সেই সময় তুই কোথায় ছিলি রে? আমাদের প্রশ্নে হাবু শুরু করেই থেমে গেল। উত্তেজিত হয়ে বলল, আমার জন্মের আগের ঘটনা … তাই তো? হ্যাঁ, তখন আমার জন্ম হয়নি ঠিকই। তবে গল্পটা কোন এক পত্রিকায় পড়া। এবার থামালে আমি কিন্তু বাড়ি চলে যাব।

কোলকাতা ফুটবলের তখনকার এক সুপারস্টার ছিলেন শ্যাম থাপা। কোনও এক অনুষ্ঠানে মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা হল শ্যাম থাপার। শ্যামের গম্ভীর মুখ দেখেই মহানায়ক বুঝে গেলেন চৌখস স্ট্রাইকারের মুড ভাল নেই। কথায় কথায় জানতে পারলেন সেদিনের ম্যাচ হেরে যাওয়ার জন্যই শ্যাম থাপা মুষড়ে পড়েছেন।

বিখ্যাত ভুবন ভোলানো হাসি হেসে উত্তমকুমার বললেন, আমারও তো কত ছবি ফ্লপ হয়েছে! তা নিয়ে ভাবলে তো আর অভিনয়ই করতে পারতাম না। তারপর তারকা ফুটবলারের পিঠে হাত রেখে বললেন – হারতে শেখো শ্যাম। হারতে না জানলে জেতা যায় না।

একটু থেমে হাবু বলল, কি বুঝলি?

সত্যিই শেখার বিষয়। এমনি এমনি মানুষটা মহানায়ক হননি। কত স্বাভাবিকভাবে হারকে মেনে নিয়ে জয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতেন। আর এখন! শুধু জয়ের নেশায় আমরা প্রতিদিন হেরে চলেছি। বারেবারে জিতেও কত মানুষ হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে।

একটা ছোট্ট ঘটনা বলে হাবু কত সহজে বিষয়টা বুঝিয়ে দিল। শুধু হাবুর একটা কথা বোঝা গেল না। ওর দিকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই, তুই যে বললি একদল বারেবারে হারে। তারা কারা?

আমার মত মানুষরা। উদাস গলায় হাবুর উত্তর। তারপরেই আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হেসে বলে উঠল, তবে প্রতিটা হার থেকে চিনে নেওয়ার চেষ্টা করি জেতার রাস্তাটা।

বিড়িতে টান দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল হাবু। ধোঁয়ার রিংগুলো ওর প্রত্যয় হয়ে ছুটে চলল আকাশের দিকে। আর হাবু গান গাইতে গাইতে হাঁটা লাগাল বাড়ির উদ্দেশ্যে – একদিন সূর্যের ভোর …


লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

3 Comments

  1. Swapan Nag

    হাবু তো এতদিনে ভালোই জানাশুনো হয়ে গেছে। ওর চরিত্রের বৈচিত্র্য এখনো অচেনা বলেই আরো কী কী গুন বা প্রতিভা এখনও প্রকাশ্যে আসতে বাকি আছে, তা জানার জন্যেও আগামী লেখাগুলোর দিকে চোখ রাখতেই হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।