লেখক : দেবাশিস চৌধুরী
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। আমার তখন সাত বছর বয়স। বাংলাদেশ গঠনকে কেন্দ্র করে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ তখন সবে লেগেছে। সারা ভারত মহাদ্বীপ জুড়ে উত্তেজনা। বয়স্কদের আলোচনায় তখন একমাত্র বিষয় বস্তু ছিল এটি।
তখন যুদ্ধের খবর জানার অবলম্বন ছিল শুধু সংবাদপত্র এবং রেডিও। দিল্লী ছাড়া ভারতের আর কোন শহরে তখনও টেলিভিশন আসেনি। প্রায় ঘরেই থাকত ইলেকট্রিক রেডিও। তারও আবার এরিয়েল ছিল। মশারির মতন লম্বা ধরণের, ঘরের সিলিঙে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি লটকানো। ব্যাটারি চালিত ট্রানজিস্টার রেডিও তখন সবে এসেছে।
সেই সময় রেডিওতে রাত ৯-৫০এর খবর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা দিনের খবরটা জানা যেত। সংবাদ পাঠক পরিষ্কার উচ্চারণে, খুব দ্রুত, মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে সংবাদটি পরিবেশন করতেন। যুদ্ধের খবরাখবর জানার জন্য বাড়ির কর্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন রেডিওর উপর। গাঁক-গাঁক করে সব বাড়িতেই চলত ফুল ভল্যুমে রেডিও। সেই সময় কারো কথা বলা তো দূর এতটুকু শব্দ করাও মানা ছিল। অন্যথা খবর শেষ হবার পর কর্তারা বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতেন।
আমাদের তখন যৌথ পরিবার। প্রায় কুড়ি জন সদস্য। আমার বাবার ছোট কাকা, যাঁকে আমি “ছোড়দাদু” বলতাম, তিনি তখনও জীবিত। ওনার ঘরে ছিল ঢাউস একটা ব্রিটিশ আমলের রেডিও। যেন ছোটখাটো একটা সিন্দুক। বেশ যত্নে রাখতেন যন্ত্রটিকে। রেগুলার কাপড় দিয়ে পুঁছতেন। রেডিওটার নব ছিল বড় হরলিক্সের বোতলের ঢাকনার সাইজের। ভিতরে স্টেশন ধরবার জন্য বড় একটা কাঁটা, যেটার সাইজ আলুর বস্তা সেলাই করার গুণছুঁচের মত।
যুদ্ধের গোড়ার দিকে কর্তারা খবর শোনার জন্য ৯-৪০ থেকেই রেডিও চালিয়ে দিতেন। খবর শুরু হত ৯-৫০ মিনিটে। পাছে একটি লাইনও যাতে ফসকে না যায় তাই এই সাবধানতা অবলম্বন। কিন্তু দোতলাতে নিজের ঘরে ছোড়দাদু রেডিও অন করতেন ৯-৩০ মিনিটে। কাঁটা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটত, “আকাশবাণী কলকাতার” স্টেশন আর ধরতে পারতেন না। ক্যাঁ-কুঁ-কোঁ-কাঁ করে বিচিত্র শব্দ বের হতে থাকত রেডিও থেকে।
হাতের গতি কমিয়ে, নিজের কানটা রেডিওর বডিতে ঠেসে ছোড়দাদু স্টেশন ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কপাল কুঁচকে, জিভটা সামান্য বের করে চলতে লাগল তাঁর মরণপণ প্রচেষ্টা। কিন্তু সেই ক্যাঁ-কুঁ-কোঁ-কাঁ ছাড়া অন্য কোন শব্দ বের হল না। ওদিকে ৯-৫০এর খবর শুরু হয়ে গেছে “আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল …”।
গাঁক গাঁক করে সর্বত্র বাজছিল রেডিও। ছোড়দাদু তখন মরিয়া। যেন তেন প্রকারেণ খবর শুনতেই হবে। বিরক্ত হয়ে মোচড় মারতে লাগলেন রেডিওর নবটাকে। তার তখন “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” অবস্থা। অবশেষে যখন কলকাতা স্টেশন ধরতে পারলেন, তখন রেডিওর ডেতর থেকে ডেসে এল “খবর পড়া আজকের মতন শেষ হল”।
ব্যস, আর যায় কোথায়। সারা বাড়ি জুড়ে শুরু হল ছোড়দাদুর তান্ডব নৃত্য। ‘লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলব হতচ্ছাড়া রেডিওটা। কালই একটা ট্রানজিস্টার কিনে আনব।’ প্রত্যেক দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। খবর শেষ হবার পর সেই তান্ডব নৃত্য।
একতলায় রান্নাঘরেতে উপস্থিত আমার তিন ঠাকুমা, মা, কাকিমারা চাপা গলায় হেসে গড়াগড়ি খেতেন। জোরে হাসবার যো ছিল না, নইলে তান্ডব নৃত্যটা ছোড়দাদু রান্নাঘরে এসেই নাচতেন।
তা ছোড়দাদু একদিন পুরো খবরটা শুনতে পেলেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার দুদিন পর। আহ্লাদে তখন আটখানা তিনি। দোতলার দালান থেকে নিজের স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন, ‘আভা, আভা।’ ছোটমা সাড়া দিতেই তিনি সগর্বে জানালেন, ‘যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। খবরে বলল।’
সেই শুনে মহিলারা তো হেসেই খুন। আমার মেজকাকিমা শুধু বললেন, ‘বাঁচা গেল। স্টেশন ধরেছে তাহলে।’
লেখক পরিচিতি : দেবাশিস চৌধুরী
দীর্ঘকাল কর্মসূত্রে আমি লখনৌতে প্রবাসী। গল্প লেখাটা আমার একটা প্রিয় সখ। আমার গল্প পড়ে সবার মনোরঞ্জন হোক, এটাই আমার কামনা।
যৌথ পরিবারের একটুকরো ছবি যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল, সঙ্গে রেডিওর সেই পুরোনো স্মৃতি। সিরিজ চলতে থাকুক, আরও ঘটনার কথা লিখুন।
ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই লিখব।