লেখক: স্বাগতা আচার্য্য
ঠিক যখন অপরিচিত কিংবা ভাল জামা জুতো পরে কোনো ভদ্রলোক বাড়িতে আসতেন, আমার কাজ ছিল মায়ের পেছনে পেছনে জামার ফিতে চিবোতে চিবোতে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারা। আর নিদেনপক্ষে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া। কখনো-সখনো মা চোখ রাঙালে ধরনী দ্বিধা হও – এরকম মুখ করে নামটুকু বলা…অবশ্য নিজেই বুঝতাম না কী বলেছি! মাকে আবার বলে দিতে হত। কোন ক্লাস জিজ্ঞেস করলে আরও বিপদ! যদি পড়া ধরে! পালাতে পারলে শান্তি! তবে কুটুম্ব হলে বাজচক্ষু ঠিকই খাড়া থাকতো কী এনেছে ! মার ভয়ে তাঁর সামনে মহার্ঘ্য প্যাকেট খুলতাম না ঠিকই তবে রান্নাঘরে ঠিক দু’ভাইবোনের গাল ফুলে উঠতো, কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ত শৈশবের অমৃতরস!
স্টিলের প্লেটে মা যখনই চা দিয়ে আসতে বলত, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যেত ঠান্ডা স্রোত! না ফেলে কীভাবে ব্যালেন্স করে নিয়ে যাব, কীভাবে দেব, এসব ভাবতে ভাবতে ঠিকই চলকে চা পড়ত হাতে! গরম ভাবটা হাত ঠিক সহ্য করে ঠাণ্ডা পাঠিয়ে দিত শিরদাঁড়ায়! স্টেজে উঠলেও ঠিক একই ঠাণ্ডা স্রোত টের পেতাম! কোনোরকমে মুখস্থ করা ছড়া আউড়ে শেষ লাইনের সাথে নমস্কার জুড়ে কাঠের পাটাতনের ওপর দুদ্দাড় দৌড়ে নেমে ধড়ে প্রাণ পেতাম…মা খুন্তির আওয়াজ থামিয়ে শুনতো, বাবা শুনতো কোনো কাজের ফাঁকে। দু’চারটে হাততালি সামনের চটের আসন থেকে শোনা গেলেই সগ্গসুখ! কালেভদ্রে কোনো প্রবীণের মুখে বাহবা পেলে প্রচুর লজ্জায় কালো তেলচুপে গাল আরও কালো হয়ে উঠতো। বাড়িতে সদর্প পদার্পন – আর মা, ঠাকুমা, কাকুর কাছে বারবার বলা- ‘দেখেছ, একটুও আটকে যাইনি!’
কারোর প্রশংসার চেয়ে গড়গড়িয়ে বলতে পারাটা ঢের বেশি খুশির ছিল! এখনও সবার সামনে স্পষ্ট উচ্চারণ করে কথা বলতে পারি না। এক যোগাসনে শুনেছিলাম I am the best বলতে হয় নিজেকে জড়িয়ে! তাহলেই ভাল থাকা যায়! সেটাই পারলাম না কখনও। বন্ধ ঘরেও নয়! খুব লজ্জা ভর করে! সেই নজরুলবাণী – ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়’, শুধু শুনে গেলাম। নিজেকে মালা দিতে ক’জন পারে? এক গলা ফিসফিসানি, আর মুখস্থ মুখেই গড়িয়ে চলছে অভ্যস্তযাপন।
ছবি: প্রণবশ্রী হাজরা
লেখকের কথা: স্বাগতা আচার্য্য
নেশায় -আবোলতাবোল পাঠিকা। পেশায় -সেবিকা। নিবাস -পূর্ব মেদিনীপুর।
লেখকের ভাষায় – “যা ভাবি লেখা আসে তার সিকি; হইচই মার্কা মনন। এলোমেলো বুনন। গুণ খুব একটা নেই। কেউ লেখা চাইলে ধড়ফড় করে কেমন। ভুল ক্রুটি নিজগুনে ক্ষমা করে দেবেন। জানাবেন অকপটে। পরের বার শুধরে দেবার আশায় আছি।”