লেখক : অভিজিৎ সুর
রম্ভাসুর তপস্যায় বসেছে। অনেক কাল তপস্যার পর শেষমেষ মহাদেব প্রকট হলেন। বললেন, “বর চাও।”
রম্ভাসুর বলল, “আজ্ঞে প্রভু, আমি যতবার জন্মাব, ততবার আপনাকে আমার ছেলে হয়ে জন্মাতে হবে।”
মহাদেব রেগে গেলেন, “মামদোবাজি, ইয়ার্কি পেয়েছ? আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, ঘর সংসার নেই, জন্ম জন্ম তোমার ছেলে হয়ে জন্মাব? হবে না।”
রম্ভাসুর বলল, “আজ্ঞে স্যার, মানে প্রভু, এত বছর ধরে তপস্যা করে গেলাম একটা কিছু রিওয়ার্ড পাব না?”
মহাদেব একটু নরম হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তিনবার তোমার ছেলে হয়ে জন্মাব, তারপর আর না।”
রম্ভাসুর আর কি করে, তাতেই সন্তুষ্ট কিংবা অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল।
এদিকে মহাদেব পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। অসুর হয়ে তো জন্মাবেন, তারপর যে কেলোটা হবে, সেটা সামলাবে কে? তিনি টুক টুক করে গিয়ে দাঁড়ালেন পার্বতীর দরজায়। পার্বতী তখন ঘরে ঝুল ঝাড়ছিলেন আর গজ গজ করছিলেন, “এই এক হতচ্ছাড়া মাকড়সা বানিয়ে রেখেছে, যেখানে পারছে ঝুল করে যাচ্ছে। ঐ চারমুখোটাকে একবার হাতের কাছে পেলে হয়।”
মহাদেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। খানিক বাদেই পার্বতীর নজর পড়ল তাঁর দিকে। পার্বতী বললেন, “মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ছড়িয়ে এসেছ, ব্যাপারটা কী?”
মহাদেব আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে রম্ভাসুরকে একটা বর দিয়ে ফেলেছি।”
“কেতাত্থ করেছ। তা বরটা কি, স্বর্গের সিংহাসন?”
“না না, তা নয়, রম্ভাসুরকে বলেছি যে আমি তিনবার তার ছেলে হয়ে জন্মাব।”
পার্বতীর চোখ কপালে উঠল। একটু সামলে নিয়ে বললেন, “সকালে ক’টা টান দিয়েছিলে, ঠিক করে বলো তো?”
মহাদেব এবার একটু কাঁচুমাঁচু মুখ করে বললেন, “সেটা ঠিক মনে পড়ছে না।”
“মনে পড়বে কোত্থেকে, ঘর সংসার চুলোয় গেল, বউ-বাচ্চা চুলোয় গেল, উনি এখন অসুরের ছেলে হয়ে জন্মাবেন।”
মহাদেব বললেন, “ইয়ে মানে রাগ করো না। বর যখন দিয়ে ফেলেছি, আর তো ফেরানো যায় না। তা ব্যবস্থা তো একটা কিছু তোমাকেই করতে হবে।”
“কেন আমায় করতে হবে কেন? আর লোক নেই কোথাও?”
“না দেখো, আমি অসুর হয়ে জন্মালে তার কি শক্তি হবে, তা তো বুঝতেই পারছ। তাকে পরাস্ত করা তো যার তার কর্ম নয়। সে ক্ষমতা একমাত্র তোমারই আছে।”
“বাহ, আহ্লাদে গলে যাই। উনি একটার পর একটা কাণ্ড ঘটাবেন, আর আমাকে সেগুলো সামলাতে হবে। তা বলি, ঘর সংসারটা সামলাবে কে? আমার পিতৃদেব?”
মহাদেব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পার্বতীকে তিনি ভালই চেনেন, এখন চুপ থাকাটাই বেটার অপশন। কিছু পরে পার্বতী বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু আমি যখন প্রবল শক্তি নিয়ে ধরাধামে অবতীর্ণ হব, তখন আমায় ধারণ করবে কে? ধারণ করতে না পারলে তো আমি স্ট্রেট পাতালে চলে যাব।”
মহাদেব মাথা চুলকে ভাবলেন, তারপর বললেন, “এক যদি বিষ্ণু রাজি হয়…”
পার্বতী বললেন, “তো যাও, গিয়ে তাকে রাজি করাও।”
অগত্যা মহাদেব চললেন বিষ্ণুলোকে। পার্বতী বললেন, “ছেলে দুটোকেও সঙ্গে নিয়ে যাও। সারাদিন স্মার্টফোনে গেম খেলে খেলে বড্ড ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে।”
মহাদেব বিষ্ণুলোকে গিয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন। বিষ্ণু শুনে বললেন, “এমন এক একটা কাণ্ড করে বসো না মাইরি, এই এতগুলো অবতারের ঠেলা সামলে একটু রিল্যাক্স করছি, এখন আবার নতুন ঠেলায় ফেললে।”
মহাদেব বললেন, “এবারের মত করে দাও ভাই, না হ’লে আমার ওনাকে তো চেনোই।”
বিষ্ণু খানিক ভেবেটেবে বললেন, “ঠিক আছে আমি সিংহ হয়ে যাব, পার্বতীকে বলো আমাকে যেন তার বাহন করে নেয়।”
মহাদেবের মুখে হাসি ফুটল, কিন্তু লক্ষ্মী গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিষ্ণু বললেন, “কি ব্যাপার প্রিয়ে, তোমার মুখে অসময়ে অমাবস্যা কেন?”
লক্ষ্মী চোখ পাকিয়ে বললেন, “সিংহ হবে হও, কিন্তু খবরদার বলছি, কোন সিংহীর দিকে ভুল করেও তাকাবে না। মর্ত্যে গেলেই তো দেখেছি তোমার ক্যারেক্টার মোটেই ঠিক থাকে না।”
বিষ্ণুর চার হাত জোড় করে বললেন, “সিংহী কি বলছো গিন্নী, আমি কোন হায়নার দিকেও তাকাব না।”
মহাদেব ফিরে যাচ্ছেন, এমন সময় লক্ষ্মী বিষ্ণুকে বললেন, “না, তোমায় বিশ্বাস নেই। আমিও সঙ্গে যাব, দেখি সরস্বতীকেও যদি রাজি করাতে পারি।”
সঙ্গে সঙ্গে কার্তিক-গণেশ বলে উঠল, “আমরাও যাব, আমরাও যাব।”
মহাদেব চটে গিয়ে বললেন, “এটা কি যাত্রাপালা হচ্ছে? সবাই মিলে যাত্রা দেখতে যাচ্ছি? কোথায় একটা মিশন অসুর হতে চলছে, সেখানে সবাই মিলে গুলতানি।”
লক্ষী বললেন, “কোন চিন্তা নেই। ওদের দেখাশোনার ভার আমার।”
মহাদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বিষ্ণু থামিয়ে বললেন, “মেনে নাও ব্রাদার, এখানে কর্তার, থুড়ি কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম।”
এরপর যা হবার তা হল। প্রথম জন্মে মহিষাসুরকে দেবী পার্বতী বধ করলেন উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় জন্মে বধ করলেন ভদ্রকালী রূপে, আর তৃতীয় জন্মে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে। এরপর সকলে আবার স্বর্গে ফিরে এলেন। বিষ্ণু সিংহ ছেড়ে আবার স্বমূর্তি ধারণ করলেন। তারপর মহাদেবকে বললেন, “ব্রাদার আর হুটহাট দুমদাম কাউকে বর দিয়ে বসো না। এই মহাশক্তির বোঝা পিঠের উপর বহন করে শিরদাঁড়া টাটিয়ে গেছে, স্পণ্ডিলাইটিস না হলে বাঁচি। আমি এখন লম্বা বিশ্রামে যাব। গিন্নি পিঠে একটু মালিশ করে দেবে, আমি কিন্তু কারও দিকে তাকাইনি।”
লক্ষ্মী বললেন, “ঠিক বলছ?”
বিষ্ণু বললেন, “কেন, তুমি তো সঙ্গে ছিলে, দেখনি?”
“আমার কেমন যেন মনে হ’ল, তুমি একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলে।”
“আহা সে তো একটু হাঁটুর দিকে চোখ চলে গিয়েছিল, মুখের দিকে তো তাকাইনি।”
“ওইখানেই তো আসল ব্যাপার,” লক্ষ্মী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “মেয়েটা পড়েছিল একটা জিন্স তার হাঁটুর কাছটা কাটা। বিষ্ণুলোকে ফিরে চলো, তারপর তোমার শিরদাঁড়া, হাঁটু – সব ভাল করে মালিশ করে দিচ্ছি।”
বিষ্ণু অসহায় দৃষ্টিতে মহাদেবের দিকে তাকালেন। মহাদেব বললেন, “এ ব্যাপারে আমি চরম অসহায় ব্রাদার, প্লিজ এক্সকিউজ মি।”
বিষ্ণু মুখ চুণ করে লক্ষীর সঙ্গে চলে গেলেন।
পার্বতী মহাদেবকে বললেন, “অসুর সেজে তো অনেক লীলাখেলা করলে। এবার ছেলে দু’টোকে নিয়ে পড়াতে বসো। গণশাটা অংকে কাঁচা আর কার্তিকটা ভূগোলে।”
মহাদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় যমরাজের দূত এসে হাজির। মহাদেবকে প্রণাম করে বলল, “একটা প্রবলেম হয়েছে স্যার, মানে প্রভু।”
“কি প্রবলেম?”
“নরকে আর জায়গার সংকুলান হচ্ছে না, সব জায়গা পুরোপুরি ভর্তি। গেটের বাইরে কয়েক কোটি দাঁড়িয়ে আছে। তাই যমরাজ আপনাকে বলতে বললেন, আপনি যদি বিশ্বকর্মাকে বলেন দ্বিতীয় একটা নরক বানিয়ে দিতে।”
“হবে না,” পার্বতী হুংকার দিলেন, “যা কিছু হবে, তারই বরাত সব বিশ্বকর্মাকে দেয়া হচ্ছে, আর ওই করে করে ওই ব্যাটা ফুলে ফেঁপে উঠছে। এরকম একচ্ছত্র মনোপলি কোনভাবেই বরদাস্ত করা যাবে না।”
মহাদেব বললেন, “তা না হয় বুঝলাম, তাহলে এখন উপায়? এতগুলো লোককে রাখা হবে কোথায়? যম একা সামলাবে কি করে?”
পার্বতী কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “স্বর্গটাকেই নরক বানিয়ে ফেলো।”
মহাদেব আঁতকে উঠলেন, “কি বলছ গিন্নি, স্বর্গকে নরক বানাব?”
পার্বতী বললেন, “তাতে অসুবিধেটা কোথায়? ওটা তো এমনিই ফাঁকা পড়ে আছে। ওখানে তো কেউ আর স্থান পায় না। দেখছ না মর্ত্যধামে ধড়াধড় পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে ফেলে নতুন নতুন হাইরাইজ হচ্ছে। ওই রকমই ইন্দ্রের সভার জন্য একটুখানি জায়গা ছেড়ে রেখে বাকিটা নরক বানিয়ে ফেলো।”
যমরাজের দূত মাথা চুলকোতে চুলকোতে বিদায় নিল। পার্বতী বললেন, “নাও ছেলে দু’টোকে নিয়ে পড়াতে বসো। যুদ্ধ করে করে গা-হাতে ব্যথা হয়ে গেছে, জয়া বিজয়াকে বলি একটু গরম তেল মালিশ করে দিতে।”
মহাদেব বললেন, “যুদ্ধ তুমি একাই করেছ, আমি কি ঘাস ছিঁড়ছিলুম? তারপর রক্তবীজ বধের পর কালি রূপ থামাতে গিয়ে তোমার পা বুকে ধারণ করতে হ’ল, তাতে আমার রিপ বোন ফ্র্যাকচার হয়ে যাওয়ার দাখিল। নন্দী-ভৃঙ্গীকে নিয়ে দুটো টান দিয়ে আমি একটু চাঙ্গা হয়ে নিই। তারপর না হয়…”
না মানে, মহাদেব এগুলিই বলবেন ভাবছিলেন, কিন্তু শেষমেষ বলতে পারলেন না।
লেখক পরিচিতি : অভিজিৎ সুর
বয়েস ৪৯। বাড়ি চুঁচুড়া। একাই থাকি।