লেখক : অভিজিৎ সুর
সকাল থেকেই খামোখা টিপটাপ বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, কখনও একটু জোর, কখনও একটু আলতো ছুঁয়ে যাওয়ার মত। হঠাৎ উটকো হাওয়ায় একদিন তোমার চুল এসে পড়েছিল আমার মুখে, আর তোমার গরম নিঃশ্বাস ছুঁয়েছিল আমার ঠোঁট; সেই মুহূর্ত-যন্ত্রণায় হয়তো মানুষ স্বপ্ন চিনে নেয় আর চোখ বেয়ে গভীর, গভীরতর অন্তরের মধ্যে আরও এক ধরণের বৃষ্টি খেলা করে।
‘অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে,
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন্ বাতাসে’
প্রাচীন অশ্বত্থের পাতা থেকে বিন্দু বিন্দু জল এই মাটিতে পড়ার শব্দে সচকিত হয়ে আড়মোড়া ভাঙে নিঃসঙ্গ সময়। খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া এসে স্পর্শ করে, হয়ত তখনই মন খারাপ হয়। আমি জানালা দিয়ে তাকালে মেঘ দেখি, উৎকৃষ্ট এক চরাচরময় নরম অন্ধকার বকের ডানায় আটকে রাখে স্থিরচিত্র। বাড়ির উঠোনে কোণে এক ছোট্ট হয়ে যাওয়া সিমেন্টের ফাঁক দিয়ে জংলা গাছের বাচ্চা বৃষ্টি মাপে আপন মনে।
‘যে ফুল গেছে সকল ফেলে, গন্ধ তাহার কোথায় পেলে,
যার আশা আজ শূন্য হল কী সুর জাগাও তাহার আশে’
কার্নিশে বসা একটা পায়রা ভিজছে অনেকক্ষণ ধরে, মাঝে মাঝে ডানা ঝাপটায়, জল ঝেড়ে ফেলে, তবুও কিছু মায়া জমে থাকে। ও প্রতীক্ষা করে আছে ওর সঙ্গীর জন্য, হয়ত আসবে, হয়ত আসবে না; সকাল বয়ে যাবে দুপুরে। তখন হয়ত কোথাও আদর মেখে শুয়ে থাকবে যুবক-যুবতী, মেঘ তাদের ধার দেবে আচ্ছাদন। সেই বাচ্চা ছেলেগুলোকে আর দেখি না, যারা বৃষ্টির জমা জলে ছপছপ করে পা ফেলে কৈশোর উদযাপন করত। সেই মেয়েগুলোকে আর দেখি না, যারা বৃষ্টি ভিজে ছবি আঁকত বাতাসে। তাদের চুল আর শরীর বেয়ে গড়িয়ে নামা জল তাচ্ছিল্য করত পার্থিব দৈন্যতাকে।
‘সকল গৃহ হারালো যার, তোমার তানে তারি বাসা,
যার বিরহের নাই অবসান, তার মিলনের আনে ভাষা’
আবার জানালা দিয়ে আসে ভেজা বাতাস, আমার ঠোঁট ছুঁয়ে এলোমেলো করে দেয় আমাকেই, কি জানি হয়ত আমার সম্পূর্ণ শরীরটাই ওর চাই। আমি ধীরে ধীরে সিঁড়িতে পা রেখে রেখে ছাদে গিয়ে দাঁড়াই, অনেক প্রাচীন প্রবাহ এইসব অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় এক একটা অহেতুক রূপকথা বুনে চলে। কেন এবং কে জানে, আমি ঠিক জানি না, মগজের কোণে কিছু ছায়া অবসন্নভাবে বিচরণ করে আজও। ওই দিগন্তে যে নদী বইছে তার শরীরেও আজ মেঘের ছায়া। কোথাও কোন গান বাজছে না, আমার মনেও আজ কোন কবিতা নেই। কোথাও কোন গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, হয়ত বৃষ্টির জলের কারণে ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না ঠিক। রাস্তার কুকুরগুলোকেও আজ দেখছি না, ওরা জানে কোথায় মাথা গোঁজা যায়। আমার কি কিছু ভাবার আছে? যদিও বা থাকে, তবে তা এতই অস্পষ্ট যে তাদের দাবি-দাওয়ার চাহিদারা ম্লান। ঘর আর মন দুটোই শূন্য থাকে, তাই স্বরলিপির বেরঙিন খাতায় আবহমান সময়কে সরে যেতে দেখছি, বিষণ্ণতা চোখে রেখে।
‘শুকালো যেই নয়নবারি, তোমার সুরে কাঁদন তারি,
ভোলা দিনের বাহন তুমি স্বপন ভাসাও দূর আকাশে‘
ছাদ থেকে নেমে আসতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আর এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া, পূবের, এসে লাগে আর তোমার গায়ের গন্ধ পাই আজ, এখন, অনেক অনেক দিন পর।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান ব্যবহার করা হ’ল)
লেখক পরিচিতি : অভিজিৎ সুর
বয়েস ৪৯। বাড়ি চুঁচুড়া, লিখতে ভালোবাসি। একাই থাকি।