বাহুবলীর নারীসমাজ

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

বাহুবলী ২  সিনেমাটি সময়কে ছাপিয়ে যাওয়া একটি সিনেমা। শুধু এই সিনেমাটি না, বাহুবলীর দুটি সিনেমাই তাই। দুটি সিনেমাতেই আমরা দেখতে পাই মানুষের চরিত্রের কিছু দিক, যা কিনা কোনও বিশেষ কালের নয়, বরং সর্বকালের। সেরম ভাবেই কিছু সময়কেও বাহুবলীর দুটো সিনেমায় কত সুন্দরভাবে ধরা হয়েছে, দেখানো হয়েছে আমাদের সমাজকে। দেখানো হয়েছে কিরম সমাজ আমরা আশা করতে পারি।
নারী নিয়ে আমরা যতই প্রগতিশীল হই না কেন, এখনও যে আমরা সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজেই বাস করছি সেটা কিন্তু অস্বীকার করতে পারব না। হতে পারে আপনি, আমি বা আপনার চারপাশের পরিবেশ হয়ত খুবই প্রগতিশীল নারীর ব্যাপারে, কিন্তু সমস্ত সমাজ না। এখনও কোনও তথাকথিত “লিবার‍্যাল” পরিবারে বিয়ের সময় মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকে বলে, “বিয়ের পর তুমি চাকরি করতেই পারো”, আরে সে করবে কি না করবে তার ব্যাপার, আপনি অনুমতি দেবার কে, আপনার ছেলে কি মেয়ের বাড়ির থেকে অনুমতি চায় যে সে চাকরি করবে কিনা! এই কথাতেই প্রমাণ হয়, আসলে “লিবার‍্যাল” একটা শব্দ মাত্র। আরও একটা কথা ভেবে দেখুন, আমাদের সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর যারা রেখে গেছে, তাদের কতজন মহিলা? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তো পুরুষদেরই দেখি। এই ব্যাপারে আমি বন্ধুদের সাথে যখন আলোচনা করতাম, অনেকেই বলেছিল মেয়েদের প্রতিভা সেই অর্থে নেই। প্রতিভা নেই  না সেই প্রতিভার বিকাশ কোনোদিন হতে দেওয়া হয় না আমাদের সমাজে, সেটা কিন্তু ভাববার বিষয়।
এইক্ষেত্রে আমাদের পথ দেখাচ্ছে বাহুবলী। বাহুবলীর সমাজটা কিন্তু আমাদের সমাজের মত পুরুষতান্ত্রিক না। সেখানে পুরুষের মতই নারীর সমান অধিকার। তাই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি একজন নারী শিবগামী রাজমাতার পদে থেকে রাজ্যশাসন করছে এবং তাকে পেরিয়ে কেউই কিছু করতে পারছে না, তার ওপর কথা বলতে পারছে না। এখানে কেউ বলতেই পারে সেটা তো তার ব্যক্তিত্বে। কিন্তু ভাবুন তো একবার, যদি রাজ্যশাসন করবার অধিকারই নারীকে না দেওয়া হয়, তাহলে তো শিবগামীর ব্যক্তিত্ব থেকে যেত অন্তঃপুরেই। বাহুবলীর পিতা বিক্রমদেবের মৃত্যুর পর থেকে রাজসিংহাসন ফাঁকাই ছিল, বিজ্জলদেব তো পেল না রাজত্ব। তখন রাজ্যের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল বিজ্জলদেবের স্ত্রী শিবগামী। কিন্তু একজন নারীকে রাজশাসন করতে দেখে রাজবিদ্রোহ করে মার্তণ্ড। আসলে মার্তণ্ড সেই সব পুরুষদের প্রতীক যারা নারীকে উঠতে দিতে চায় না, তারা ভাবে পুরুষই শ্রেষ্ঠ। এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এখনকার সমাজে এই মার্তণ্ডদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু বাহুবলীর সমাজে তা ছিল না। তাই তো কিছু লোক মার্তণ্ডের সাথে থাকলেও সবাই ছিল না। মার্তণ্ড যখন সেনাদের নির্দেশ দিল শিবগামীকে হত্যা করার জন্য, তখন কয়েকজন তার সাথে থাকলেও বাকিরা কিন্তু ছিল না। তাই সেনারা মার্তণ্ডের লোকদেরই হত্যা করল। তার কারণ তাদের মানসিকতা। তারা নারীর শাসন মানব না, নারী পুরুষের চেয়ে ছোট, এরম মানসিকতার লোক ছিল না। নারী হোক বা পুরুষ, তারা উপযুক্ত শাসককেই চেয়েছিল রাজ্যচালনা করুক। তাতেই দেশের উন্নতি, তাতেই দশের উন্নতি।
একইভাবে দেখুন শিবা আর অবন্তিকাকে। যখন এদের দুজনের কথাই বললাম, তখন একটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। অবন্তিকা তো দেবসেনার মুক্তির জন্য ওদের সর্দারের দেওয়া লক্ষ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিল। তারপর তার জীবনে এল শিবা। একদিন শিবা এসে ওকে বলল সে সে ওকে ভালবাসে। অবন্তিকা রণমূর্তি ধারণ করে শিবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিবা তখন সুকৌশলে তার প্রতিটা প্রহার এড়িয়ে যায় এবং তাকে ধীরে ধীরে বস্ত্রমুক্ত করে, কিন্তু বিবস্ত্র করে না। এখানে অনেককেই আমি গলা তুলতে দেখেছি যে এভাবে নারীর রূপ প্রদর্শন করানো হয়েছে যা খুবই বাজে। আমি বলব বিষয়টা তা নয়। ভাবুন তো আমাদের ঘরে যাদের মা শুধুই গৃহবধূ, তারা তাদের নিজেদের শখ ভুলে আমাদের জন্য পুরো জীবনটা উৎসর্গ করেছে। এরম প্রচুর নারী আছে আমাদের সমাজে, যারা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া লক্ষ্য নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। অবন্তিকাও তাদের মধ্যে একজন। সর্দারের চাপানো লক্ষ্য নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল সে। তখন এল শিবা, তার ভেতরের সৌন্দর্যটা তাকে দেখাল শিবা। এখানে তাই সিনেমার ওই সিকোয়েন্সটাকে আমি শরীর দেখানো বলব না, বলব ভেতরের সৌন্দর্য দেখানো। শিবা অবন্তিকাকে তার ভেতরের সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। একটা মেয়ের জীবনে এরম সঙ্গীরই তো প্রয়োজন। আবার দেখুন যদি আমি ধরে নিই দেবসেনার মুক্তি অবন্তিকার নিজেরই লক্ষ্য , সর্দারের চাপানো নয়। তাহলেও ভাবুন না জীবনের কোনও একটা লক্ষ্যে পৌঁছতে কখনও আমরা ভুলে যাই আমাদের ভেতরের মানুষটাকে। যদি শিবার মত সঙ্গী থাকে তার, তাহলে আর চিন্তা কি? আবার ভাবুন তো বিয়ের পর আমরা সাধারণত এটাই ধরে নিই, ও মেয়েমানুষ, ওকেই সব কাজ করতে হবে। মেয়ের বাড়ি থেকেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শিক্ষাই দেওয়া হয়। কিন্তু খুব কম পুরুষকে দেখেছি তার বউয়ের স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে। এক্ষেত্রে দেখুন শিবাকে। সে তখনও জানে না দেবসেনা কে! কিন্তু অবন্তিকাকে সে কথা দেয়, যদি দেবসেনার মুক্তিই তার লক্ষ্য হয়, তাহলে সেটা শিবারও লক্ষ্য। যদি আমাদের সমাজের সব ছেলেরাই ঠিক এরকম ভাবত!
অপরপক্ষে দেবসেনা হচ্ছে সেই স্বাধীন নারীর প্রতীক, যে কোনও অংশে ছেলেদের থেকে কম নয়। সে বুদ্ধিমতী, যুদ্ধবিশারদ সকল গুণসম্পন্না। দেখুন তার অভিভাবকও কিন্তু তাকে মানুষ করেছে সেভাবে। যদি তার অভিভাবকরা আমাদের মত ভাবত যে দেবসেনা মেয়ে তো, ওকে এসব শিখিয়ে কি হবে করত, তাহলে কি দেবসেনার মত বীরাঙ্গনা থাকত বাহুবলীর সমাজে? আমারা সমস্ত নজর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দিই আমাদের ছেলেদের ওপর। কারণ আমরা মনে করি তারাই নাকি আমাদের ভবিষ্যৎ, আর মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বদলে তাদের বিয়ের যৌতুকের টাকা জমাতে থাকি। কিন্তু একবার যদি আমরাও দেবসেনার অভিভাবকদের মত ভাবতে শুরু করি, তাহলে সমাজটা কতটা বদলে যাবে ভাবুন তো? বাহুবলীর পরিচয় না জেনে শুধু তার বীরত্ব দেখে তার মত বীরের সাথে তারা তাদের রাজকুমারীর বিয়ে দিতে চেয়েছেন, বাহুবলীর মত মহারাজের সাথে নয়। তাদের চিন্তাধারাটাই তো আমাদের এখনকার অভিভাবকদের চিন্তাধারা থেকে আলাদা। এদিকে সেবসেনাকে দেখুন, সে কতটা শিক্ষিতা, স্বাধীনচেতা, যুক্তিবাদী। আর তাইজন্য সে বড় রাজ্যের রাজপ্রস্তাব অবহেলায় ফেলে দিতে পারে। কারণ সে নিজে স্বাধীনচেতা। এখনকার অনেক মেয়েকে দেখেছি যে সফল পুরুষদের পেছনে ছুটতে তারা ভালবাসে এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজে এদের সংখ্যায়ও নেহাত কম নয়, বেশ ভালই। কিন্তু বাহুবলীর সমাজের দেবসেনাকে দেখুন। সে মনে মনে যখন বাহুবলীকে ভালবেসে ফেলেছে এবং সেই অবস্থায় শিবগামীর প্রেরিত দূত অত্যন্ত অহঙ্কারের সাথে তাকে বিবাহ প্রস্তাব দিয়েছে সে কিন্তু তা প্রত্যাখান করেছে। সে একবারের জন্যও ভাবেনি সে অত বড় রাজ্য, সে সেই রাজ্যের রাজবধূ হতে পারত। কারণ স্বামীর ক্ষমতা পয়সায় বৈভবে না, বরং তাকে কিভাবে দেখবে, তাকে রাখবে তার ওপর নির্ভর করে। বাহুবলী করেছেও তাই। তাকে কথা দিয়েছে তার অপমান কোনওদিন হতে দেবে না। এবং চিরটাকাল তাইই করে গেছে। যখন রাজসভায় সে দেবসেনাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে নিয়ে আসে এবং দেবসেনাকে গ্রেপ্তার করতে এগিয়ে আসে রক্ষীরা, তখন বাহুবলী বলে ওঠে, “দেবসেনাকে কেউ হাত লাগাতে আসলে মনে করবে বাহুবলীর তলোয়ারকে হাত লাগাচ্ছে”। এইসব দেখেই মনে হয় আজকের সমাজটা যদি বাহুবলীর সমাজের মত হত, তাহলে কত ভালো হত!


লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন