বাহুবলী-দেবসেনা এবং আদর্শ দাম্পত্য জীবন

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

বাহুবলী দুটো সিনেমাই  ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। যত দেখি তত দেখতে পাই এর নতুন নতুন দিক। এর আগে বাহুবলীতে মহাভারতের ছায়া এবং বাহুবলীর নারীসমাজ নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ বাহুবলীর মধ্যে কিভাবে দেখানো হয়েছে আদর্শ দাম্পত্য জীবন, তা বলব ।
অমরেন্দ্র বাহুবলী অর্থাৎ যার নামে এই সিনেমাদুটোর নাম, যার জীবনচরিত নিয়েই দুটো সিনেমার গল্প, আদর্শ রাজার পাশেও  একজন আদর্শ স্বামী। একইভাবে তার স্ত্রী দেবসেনাও একজন আদর্শ স্ত্রী। তাদের প্রেমকাহিনী তো আমরা দেখলাম বাহুবলী ২ সিনেমাটায়। এবং একটু ভেবে দেখলেই আমরা দেখতে পাব, একজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি বাহুবলী আর দেবসেনার মত বোঝাপড়া থাকে, তাহলে তাদের যেমন কেউ আলাদা করতে পারে না, ঠিক তেমনই তারা গড়ে তোলে আদর্শ দাম্পত্য জীবন।
প্রথমে আসি বাহুবলী এবং দেবসেনার সাক্ষাৎপর্বে। প্রথম দেখাতেই বাহুবলী প্রেমে পড়ে যায় তার। দেবসেনাও কিন্তু শুরু থেকেই আকৃষ্ট ছিল তার প্রতি, কিন্তু ঠিক প্রথম দেখাতেই নয়।একটা ছেলে আর একটি মেয়ের মনস্তত্ত্ব একটু ঘাঁটলেই আমরা দেখব যে একটা ছেলে যেভাবে একটি মেয়েকে প্রথমবার দেখেই প্রেমে পড়তে পারে, একটা মেয়ে কিন্তু সেটা পারে না। সেটা মেয়েদের স্বভাবের সাথে যায়ও না। সে প্রেমে পড়ে ছেলেটার ব্যক্তিত্বে, ছেলেটার সারল্যে। বাহুবলী মেয়েদের এই মনটাকে বোঝে। তাই তো সে রাজপরিচয় ত্যাগ করে দেবসেনার রাজত্বে একজন সাধারণ মানুষের মত থাকতে শুরু করে সরলভাবে। দেবসেনাও ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে তার ব্যক্তিত্বে, মুগ্ধ হয়ে  তার সারল্যে। প্রথমেই বাহুবলী নিজের রাজপরিচয় দিতে পারত, কিন্তু সে দেয়নি। কারণ সে তো দেবসেনাকে তার বৈভব দিয়ে পেতে চায়নি, সে দেবসেনাকে পেতে চেয়েছে তার নিজস্বতা দিয়ে।
যেমন দেবসেনাকে সে দিতে চেয়েছে তার নিজস্বতা,  তেমনই ভাবে বাহুবলীও দেবসেনার মধ্যে খুঁজতে চেয়েছে শান্তি, খুঁজতে পেয়েছে মমত্ব এবং সে তা পেয়েছে তার মত করে। বাহুবলীর সাথে দেবসেনা যখন একটি বলদের মারামারি করতে বলে এবং বাহুবলী স্বেচ্ছায় বলদের ধাক্কা খায়, তখন নকল মামা সেজে কটপ্পা  দেবসেনাকে বলে যে তার ভাগ্নের এবার ঘুম হবে কি করে! তখন মনে মনে দেবসেনা সে ইঙ্গিত বোঝে। সেও যে বাহুবলীর জন্য সমব্যথী। একটা ছেলে কখনও তার সঙ্গিনীর কোলে মায়ের আদর খোঁজে। সে তথ্য নিশ্চয়ই অজানা নয় দেবসেনার কাছেও। তাই কৃষ্ণপুজোর মাঝেও সে বাহুবলীর জন্য ব্যথা প্রকাশ করে, তার পুজোর গানের মধ্যেও সেই আকুতি, সেই ভালবাসা। একজন নারী যাকে প্রকৃত ভালবাসে, তাকে নিয়েই ভাবে সবসময়। তাই তো দেবসেনাও পুজোর মাঝেও তার কথাই ভাবে, সে আসলে বাহুবলী কে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। এবং অবশেষে তার গান শুনে আদরের নিদ্রায় মগ্ন হয় আমাদের নায়ক।
এরপরে দেখি আমরা, দেবসেনার রাজত্বে যখন হামলা করে পিণ্ডারী নামক দস্যুরা, তখন বাহুবলী দেখায় তার আসল রূপ, তার শক্তি, তার বীরত্ব, তার সাহস। সবচেয়ে বড় কথা সে দেবসেনার পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে। মেয়েরা তো এটাই চায়। তার জীবনসঙ্গী সময়ে অসময়ে তার পাশে থাকুক সবসময়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলুক সবসময়। শুধু সেই যুদ্ধেই নয়, বাহুবলী সারাটা জীবন থেকেওছে দেবসেনার পাশে।  আবার শুধু পাশে থাকা না, তার সিদ্ধান্তের মর্যাদা দিয়ে থেকেছে তার পাশে। একজন স্বাধীনচেতা মেয়ে কখনই কোনো ভুল সিদ্ধান্তকে মেনে নেয় না এবং সে আশা করে তার সঙ্গীর সঙ্গও সে পাবে। এক্ষেত্রে বাহুবলী করেছেও তাই। যদিও ভাল ছেলের মত সে তার মায়ের অবাধ্য কখনও হয়নি, কিন্তু তার স্ত্রী দেবসেনার ওপর মায়ের অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ করতেও সে ভোলেনি। শুরুতে যখন তার মা তাকে আদেশ দেয় দেবসেনাকে বন্দী করে আনতে, সে তাকে বন্দী করে আনেনি কারণ সে জানে এখানে তার মা ভুল। আবার যখন সভায় মা তাকে বলে  যে সে ভল্লাল দেবকে কথা দিয়েছে দেবসেনার বিয়ে ভল্লাল দেবের সাথেই দেবে, তখন বাহুবলী মাকে বলতে বাধ্য হয়, “তুমি ভুল মা।” তার ফলে তাকে সিংহাসন থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তবু সে নিজের সত্য থেকে সরে না। একজন মেয়ের আর কি চাই যখন দুনিয়া তার বিরুদ্ধে গেলেও তার স্বামী তার সাথ ছেড়ে যায় না।
সেইরকমই রোমাঞ্চকর সেই দৃশ্যটা , যখন গর্ভবতী অবস্থায় মিথ্যে আরোপ দিয়ে দেবসেনাকে সভা মধ্যে শিকল দিয়ে রাখা হয়েছিল এবং বাহুবলী সেখানে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। যখন দেবসেনার মুখে সে শুনল, তার দিকে হাত বাড়িয়েছিল সেনাপতি, তখন সে বলল, “নারীর দিকে হাত বাড়ালে তার হাত কাটতে নেই, কাটতে হয় গলা” এবং সে নিজেই কেটে দেয় তার গলা। নিজের স্ত্রীর অপমান কখনোই সহ্য করেনি বাহুবলী। এবং এই কারণে তাকে রাজমহল ও ছাড়তে হয়। এর আগে দেবসেনার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে সে হারিয়েছিল সিংহাসন এবারে হারাল রাজপ্রাসাদ। কিন্তু তার কাছে স্ত্রীর সম্মান সবার উপরে। একজন প্রকৃত পুরুষের তথা প্রকৃত স্বামীর কাছে এটাই হওয়া উচিত।
মেয়েরা যেমন তার শশুরবাড়িকে সম্মান করে, তেমনই বাপের বাড়িকেও ভালোবাসে। আর তাই কোনও মেয়ে এটাই চাইবে তার সঙ্গীও ততটাই সম্মান করুক তার বাপের বাড়ির মানুষজনদের। এবং সে শিক্ষা আমাদের নায়ক বাহুবলীর আছে। আর আছে বলেই তো তাকে এত বড় মহারাজা জেনে দেবসেনার বাড়ির সকলে যখন তার কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয়, তখন বাহুবলী তাদের তুলে ধরে বলে, “যাদের মধ্যে সম্বন্ধ হচ্ছে, তারা তো কোলাকুলি করে, এমন মাথা ঝোঁকায় নাকি?”
শুধু তাই নয়, একটা মেয়ে কিন্তু তার পুরনো বাড়ি বন্ধু ছেড়ে যখন নতুন বাড়িতে আসে, তার মানে এই নয় যে সে তার বাপের বাড়ি বা পুরনো বন্ধুদের ত্যাগ করে এসেছে। দেবসেনার বন্ধু এবং আত্মীয় কুমার ভার্মাকেও বাহুবলী কিন্তু মেনে নিয়েছে। শুধু মেনে নেওয়াই নয়, সে তাদের সঙ্গে বাহুবলীর রাজ্যেও এসেছে। তবে রাজ্য তো অনেক পরে। বিয়ের আগে থেকেই যখন বাহুবলী জানত কুমার ভার্মার দেবসেনার প্রতি দুর্বলতা আছে। কিন্তু সে তার সাথে শত্রুতা করেনি, বন্ধুত্ব করেছে। এটাই তো হওয়া উচিত একটা দাম্পত্য জীবনে। স্ত্রীর যে বন্ধু তাকে তো স্বামী আপন করে নেবে। একজন স্বামী তার স্ত্রীর সব বন্ধু বা আত্মীয়ের  থেকে তাকে তো আলাদা করে দেবেনা। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই তো আর সে স্বামীর সম্পত্তি হয়ে যায়নি, যে স্বামী তার আগের সব কিছু থেকে তাকে সরিয়ে নিয়ে আসবে।। একই বিষয় বাহুবলীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনেক মেয়েকে দেখছি বিয়ের পড়ে তাদের চাহিদা স্বামী যেন তার বন্ধুবান্ধবকে একেবারেই ভুলে যায়। প্রকৃত নারীরা কখনই এমন চাইবে না। স্বামীকে বন্ধু-আত্মীয়ের থেকে একটা স্ত্রী কখনই আলাদা করে না। বরং তাদের সাথে নিজেও আত্মীয়তা গড়ে তোলে। দেবসেনা তাই করেছে। স্বামীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র কটপ্পাকে নিজের পিতার স্থান দিয়েছে। আবার  যখন বাহুবলী দেবসেনার প্রসবের সময় পাশে না থেকে কটপ্পাকে বাঁচাতে যায়, তখনও কিন্তু বাধা দেয়নি দেবসেনা। কারণ সে জানে কটপ্পাকে বাঁচানোটা বেশি জরুরি। তাই সে স্বামীকে সাহস দিয়ে বলে, “যাও ওনাকে নিয়ে এসো।”   স্বামীর সিদ্ধান্ত গুলো সম্মানের সাথে মেনে নিয়েছে সে। আবার স্বামীর অধিকারের জন্য সে লড়াই করেছে শাশুড়ির সাথে। প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে শাশুড়িকে এইভাবে ক্যাটক্যাট করে কথা বলা কি শোভা পায়! কিন্তু স্বামীর প্রতি অন্যায়, নিজের প্রতি অন্যায় সে একবারের জন্য ও মুখ বুজে মেনে নিতে পারে নি। এবং অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার শাশুড়ি শিবগামী তার পা ছুঁয়ে ক্ষমা পর্যন্ত চেয়ে নেয় তার কাছে।
বাহুবলী যেমন দেবসেনার পাশে থেকেছে, তার সব কথার সম্মান করেছে,  দেবসেনাও তেমন স্বামীর সবসিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছে, সব সময় স্বামীর পাশে থেকেছে। সুখে দুঃখে কখনো তাকে ছেড়ে যায়নি। বাহুবলী যখন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যায়, তখন নিজের রাজ্যাভিমান ত্যাগ করে স্বামীর সঙ্গে চলে আসে। হাসিমুখে স্বামীর সাথে, স্বামীর পাশে সুখে জীবন কাটায় সে। একটা পুরুষও তার স্ত্রীর থেকে এইরকম সাথই চায়। যে স্ত্রী শুধুমাত্র স্বামীর বৈভবেই না, স্বামীর দুর্দিনেও তার পাশে যেন থাকে।
এক কথায় বলতে গেলে দুজন দুজনের পরিপূরক, সম্পূর্ন অর্থেই। একে ছাড়া অন্যজন যেন অসম্পূর্ণ। যখন সে দেবসেনাকে কথা দিল, তার সমস্ত দায়ভার আজ থেকে তার, তখন দেখব কিভাবে সে তার কথা রেখেছে। যখন নৌকায় পৌঁছতে গিয়ে কাঠের পাটাতন ভেঙে যায়, তখন রাজা হয়েও জলে নেমে সে নিজের কাঁধকে পাটাতন হিসাবে দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই দেবসেনাকে তুলে নিয়েছে কাঁধে। স্বামী স্ত্রীর এই যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো আমরা বাহুবলীতে দেখতে পেয়েছি খুবই সুন্দরভাবে। একটা আদর্শ দাম্পত্য জীবন তো এভাবেই গড়ে ওঠে এবং বাহুবলী আর দেবসেনার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাই সেটা।


লেখাটি লেখকের কণ্ঠে শুনুন এখানে

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।