বাহুবলীর সাথে মহাভারতের সম্পর্ক

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

এই সময়ে সবচেয়ে চর্চিত বিষয়গুলির মধ্যে বাহুবলী ২ সিনেমাটি একটি। ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাহুবলীর প্রথম অংশ, Baahubali : The Beginning। তখন থেকেই মানুষের মনে ছিল দুটো প্রশ্ন। প্রথম, এর দ্বিতীয় ভাগ মুক্তি পাবে কবে আর দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কটপ্পা, যিনি কিনা বাহুবলীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন, কেন বাহুবলীকে হত্যা করেছিলেন। সময় পেরিয়ে মানুষ প্রথম প্রশ্নের উত্তর তো পেয়েছে, কিন্তু বাকি থেকে গেছে দ্বিতীয় প্রশ্নটি, যার জন্য মানুষে অপেক্ষা করে বসেছিল এতদিন, তার উত্তর মানুষ পাবে আজকে। কারণ বিশ্বজুড়ে  আজকে Baahubali 2: The Conclusion মুক্তি পাচ্ছে, যার মধ্যে শুধু ভারতেই ৬৫০০ টি সিনেমাহলে এর মুক্তি। ভারতের সিনেমার ইতিহাসে এটি একটি রেকর্ড করল বাহুবলী।

বাহুবলী প্রথম ভাগ যারা দেখেছেন, তারা বাহুবলী, ভল্লাল দেব, দেবসেনা, রাজমাতা শিবগামী, বিজ্জল দেব এই নামগুলোর সাথে বেশ পরিচিত। কিন্তু কখনও তারা ভেবে দেখেছেন কি এই চরিত্রগুলোর মধ্যে আছে হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের কিছু চরিত্রের ছায়া। হয়ত লেখক-পরিচালক এস এস রাজামৌলী সে কথা মাথায় না রেখেই চরিত্রগুলি এঁকে ফেলেছেন, অথবা সজ্ঞানেই তিনি ভেবেছেন এদের। কিন্তু যাই হোক না কেন, একটি ভারতীয় মহাকাব্যিক সিনেমা বানাতে যে ভারতীয় মহাকাব্যকে অস্বীকার করা যায় না, এই চরিত্রগুলো তারই প্রমাণ।
রাজমাতা শিবগামীকেই যদি ধরা যায়, তাহলে তাঁর ব্যক্তিত্ব মহাভারতের রাজমাতা সত্যবতীকেই মনে করিয়ে দেয়। সত্যবতীর মতই তার দৃঢ়তা, স্থিরতা এবং বিচারক্ষমতা। শুধু সত্যবতী কেন, তার মধ্যে আছে ভীষ্মের জন্য রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা।  তেমনই ভাবে পান্ডুর মত বিক্রমদেবও তার দাদা বিজ্জল দেবের পঙ্গু হওয়ার কারণে বসেন সিংহাসনে। যদিও সিনেমায় বিক্রম দেবের উপস্থিতিই তেমন নেই এবং শুধুমাত্র তার মৃত্যুর খবরটাই আমরা পাই। তার সেই স্বল্প সময়ে রাজত্ব এবং তার মৃত্যুতে সিংহাসন খালি হয়ে যাওয়ায় রাজমাতা শিবগামীর চিন্তা, এসব দেখে বিক্রমদেবকে বেশি করে বিচিত্রবীর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিক্রম দেবের বড়দাদা  বিজ্জল দেবের মধ্যে যে ধৃতরাষ্ট্রের ছায়া পড়েছে, সেটা হয়ত অনেকেই লক্ষ্য করেছেন।  ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ হওয়ার ফলে সিংহাসন না পাওয়া এবং বিজ্জল দেবের একটি হাত পঙ্গু হওয়ার ফলে সিংহাসন না পাওয়া প্রায় সমার্থক। অন্তত বিজ্জল দেব তাই মনে করেন যে তিনি অন্ধ হওয়ার কারণেই সিংহাসন পাননি। আসলে তার মন্দবুদ্ধির জন্যই যে তিনি পাননি সেটা তিনি মেনে না নিলেও ধৃতরাষ্ট্রের মত মনে মনে সিংহাসন না পাওয়ার ক্ষোভ বহন করেছেন জীবনভর। তাঁর এই ক্ষোভ তাঁর সন্তান ভল্লাল দেবের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে, ঠিক যেমন মহাভারতে দেখি আমরা দুর্যোধনকে। আবার দুর্যোধনের মতই ভল্লাল দেব গদাচালনায় বেশ দক্ষ। তবে ভল্লাল দেব কিন্তু পুরোপুরি দুর্যোধনের আদলে তৈরি, তা একদমই না। তার মধ্যে মিশে আছে শকুনির মত রাজনীতির ছায়া। আবার সিংহাসনে বসেও রাজমাতার কিছু কিছু জায়গায় রাজমাতার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা ধৃতরাষ্ট্রের কথাই মনে করায়। আবার ভল্লাল দেবের দেবসেনার প্রতি একটা কথা, “তুমি আমাকে ছেড়ে ওকে গ্রহণ করেছিলে!” মনে করিয়ে দেয় মহাভারতের কর্ণকে। দ্রৌপদীর কর্ণকে প্রত্যাখ্যানে কর্ণের রাগ ছিল প্রচণ্ড। এবং সেই রাগ থেকেই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় তার ভূমিকা ছিল বেশ খানিকটা। আর ভল্লাল দেবকেও আমরা বারে বারে অপমান করতে দেখি দেবসেনাকে। এই সব কারণেই ভল্লাল দেবকে শুধু দুর্যোধনের সাথে তুলনা না করে তাকে মহাভারতের কৌরবের প্রতিনিধি বলা বেশি যুক্তিযুক্ত। আবার তার সন্তান ভদ্র যেন দুঃশাসনকে মনে করিয়ে দেয়। দুঃশাসন যেমন বেড়ে উঠেছিল দুর্যোধনের ছায়ায়, তেমনিই ভদ্র বেড়ে উঠেছে ভল্লাল দেবের ছায়ায়। যেমনভাবে সভার মধ্যে দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল, ঠিক একইভাবে ভদ্র লাঠি  দিয়ে বা লাথি মেরে রানী দেবসেনার ক্রমাগত অপমান করে গেছে। অপরপক্ষে বাহুবলীর মধ্যে দেখব অর্জুনের মত  তীরন্দাজের ক্ষমতা, আবার যুধিষ্ঠিরের মত বিচার ক্ষমতা। তার ছেলে শিবার মধ্যে আবার দেখব ভীমের গুণ। যেমন দেখব ভীমের মত তার শক্তি তেমনই ভীমের মত তার সারল্য। দেবসেনার মধ্যে দেখতে পাই দ্রৌপদীকে। দ্রৌপদীর মতই সে নিজের প্রাপ্য অধিকারটুকু বুঝে নেয় সঠিকভাবে, সে সভার মাঝে যখন অপমানিত হয়েছে, তখন লজ্জায় চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রৌপদীর মতই যুক্তি সাজিয়ে সভার বয়োজ্যেষ্ঠদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। আবার তেমনই দ্রৌপদীর মতই স্বামীকে নিয়ে তার আলাদা অহংকার। এবার আসি বহুচর্চিত কটপ্পা চরিত্রটিতে। রাজসিংহাসনের প্রতি তার দায়বদ্ধতা তিনি প্রমান করেছেন বারবার। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও তিনি নিজের কর্তব্য পালন করেছেন। তার এই নিষ্ঠা একমাত্র মহাভারতের ভীষ্মের সাথেই তুলনা করা যায়।
তবে শুধু চরিত্রেই না, বাহুবলীর বিভিন্ন ঘটনাতেও আছে মহাভারত। প্রথমেই আসি বাহুবলী নামে। বাহুবলীদের বংশে সকলের পদবী কিন্তু দেব। একটু ভেবে দেখুন, বিক্রমদেব এবং বিজ্জল দেব দুই ভাই। বিজ্জল দেবের ছেলে ভল্লাল দেব। কিন্তু  বাহুবলীর ক্ষেত্রে দেখব তার সময় থেকেই তার আগামী প্রজন্মের জন্য পদবী হয়ে গেছে বাহুবলী। এ যেন সেই কৌরব আর পাণ্ডবদের মতই ভাগ হয়ে গেছে পদবীগুলো। পাণ্ডবদের বনবাসের মতই বাহুবলী দেবসেনাকে নিয়ে সিংহাসন ছেড়ে, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে আসে মানুষের মাঝে। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মত গর্ভবতী দেবসেনাকে সভামধ্যে শিকল বাঁধা হাতে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। বাহুবলীর কথা, “একজন গর্ভবতী মহিলাকে এভাবে শিকল বেঁধে সভায় এনে এ সভা আগেই সব সীমা পাড় করে গেছে” এ যেন মনে করিয়ে দেয় মহাভারতের সেই চরম অপমানের দৃশ্যকে। আবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে ভীম আর দুর্যোধনের মতই আমরা লড়তে দেখি শিবা আর ভল্লাল দেবকে।
তবে শুধু এই কটা চরিত্রই বা এই কটা ঘতনাই না, অন্যান্য চরিত্রের মধ্যেও আছে মহাভারতের আরও কিছু চরিত্রের ছায়া, অন্যান্য ঘটনাতেও আছে মহাভারতের ঘটনার ছাপ। আপনি যদি খুঁজে পান এরম কিছু, তাহলে আমাদের জানাতে ভুলবেন না কিন্তু…


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।