ধন্যবাদ এয়ারটেল!

লেখক: অয়ন মৈত্র


ছোটবেলায় অংকে কম নম্বর পেলে যেমন দুশ্চিন্তায় পড়তাম, তেমনটা আর কোন বিষয়ে কম নম্বরে পড়তাম না। অংকে কম নম্বর মানে-বাড়িতে বাবার রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে এরকম ফলের কারণ কি।বন্ধু সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।কিন্তু বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর কখনো অংকের নম্বরের খামতি পূরণে যথেষ্ট বলে গণ্য হতো না কেন, সে উত্তর আমার কাছে তখনও ছিল না, আজ ও নেই।বাংলা অনেকটা বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো ছেলের মত- বাঁচলো না মরলো কেউ অত খেয়াল রাখে না।
কলেজে উঠে দেখলাম বাংলায় যারা অনার্স পড়ে, তাদের নিয়ে লোক সমাজ থেকে পাড়া পড়শি সবাই একরকম আশা ত্যাগ করে রাখে।এ ছেলে বা মেয়ে ভবিষ্যতে কিছু যদি করতে পারে, তো তার চেয়ে অলৌকিক আর কিছু হবে বলে মনে হয় না। সায়েন্স পড়া বন্ধুর বাবাকে বলতে শুনেছি, জয়েন্টে বসিয়েছি-একবার দেখবো, র‍্যাঙ্ক ঠিকঠাক হলে ভাল, নাহলে কান ধরে ইংরাজী অনার্সে ভর্তি করে দেব।আমি বলেছিলাম- সায়েন্স এর বিষয়গুলোয় ভর্তি না করে ইংরাজী কেন? বললেন- ধুর ওসব পরে মাস্টারি করা ছাড়া গতি নেই।ইংরাজী পড়লে করে খেতে পারবে।আমি বললাম -বাংলাটা কি দোষ করল! ছ্যা ছ্যা- সায়েন্স পরে শেষে কিনা বাংলা পড়বে!লোক সমাজে মুখ দেখানোর আর জায়গা থাকবে না।
বাংলা নিয়ে এই ধারণার সঙ্গে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। এয়ারটেলও আশা করি একইরকম পরিচিত।তাই প্রমিস করার শপথে বাক‍্যগঠনে এত ভুল থাকা সত্ত্বেও তা এক বহুল প্রচারিত দৈনিকের সামনের পাতা জুড়ে ছেপে বেরিয়ে যায়। এয়ারটেল জানে তাদের যারা অনুগত গ্রাহক তারা অনুগত এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক পরিষেবার জন্য, এয়ারটেলের বাংলা ভাষায় অবদানের জন্য নয়। তবুও মানুষ হোক আর প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক হোক আর সমাজসেবী, জনগণের মনে একবার বিশ্বাসের চারা রোপন করে দিলে রোজ নিয়মিতভাবে সেই চারায় জল দিতে হয়। এটা ঠিক যে এয়ারটেলের দায়বদ্ধতা তার ‘প্রমিস’ করা কথা গুলো রাখতে পারায়, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির প্রতি নয়।কিন্তু তবুও কিছু দায় তো বর্তায়ই যখন বাংলায় থেকে বাঙালি গ্রাহকদের উদ্দেশ্য করে কোন ‘প্রমিস’ করা হয়, সেই প্রমিসের বিশ্বাসযোগ্যতা স্পষ্ট হয় শব্দের ব্যবহারে। শব্দই প্রতিজ্ঞা তৈরী করে, শব্দই সেই প্রতিজ্ঞা ভাঙে। আরো খানিকটা যত্ন, আরোও খানিকটা দায় নেওয়া যেত, বিজ্ঞাপনের শেষ খসড়া সংশোধনের সময় যে- বাংলা ভাষায় ‘সম্পর্কতা’ বলে কোন শব্দ নেই। বাংলা ভাষায় মানুষ ‘প্রমিস’ বানায় না, ‘প্রমিস’ করে। ছোটবেলা থেকে শেখা জ্ঞান শিখিয়েছে আমাদের-‘চিন্তার নেই’ বাক্যটাতে ‘কারণ’ শব্দটি ছাড়া বাক্য অসম্পূর্ন থেকে যায়। ছোট বাচ্চাও তাই বলে-মা ‘চিন্তার কোন কারণ নেই’ কিংবা ‘চিন্তা নেই’- আমি ভালো আছি।ঠিক আছি।

এয়ারটেল বিজ্ঞাপন
এয়ারটেল বিজ্ঞাপন


এতো সামান্য কিছু নমুনা। বাকি আপনারাই পড়ে নিন। ব্যাকরণ বা বানানগত ত্রুটির কোনদিন কোন ভাষাতেই এত ক্ষমতা ছিল না যে সে মূল বক্তব্যকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। আজও নেই। ‘বিজ্ঞাপন মারিবেন না’ যখন ‘বিঞ্জাপন মারিবেন না’ হয়ে যায় তাতে যে উদ্দেশ্যে লেখা সেই উদ্দেশ্য কিন্তু পূরণ হয়। বিজ্ঞাপন সত্যিই সেখানে মারা হয় না। আসলে আমরা সকলেই ভেজাল দেখতে দেখতে আর খেতে খেতে আসলের গুরুত্বটা নিয়ে আর মাথা ঘামাই না। রোলের দোকানে যে টমেটো সসের বোতলে কুমড়োর সস থাকে, এ আমরা সবাই জানি। লাল রঙের সস নিয়ে দরকার, কুমড়ো না টমেটো ওতে কি এসে যায়। অবাধ্য ছাত্রকে বশে আনতে এক মিনিট শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে বলি।ছাত্রের দ্রুত প্রতিক্রিয়া-স্যার আর হবে না।আর একটাও কথা বলবো না।ছাত্র আমার চালাক। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সে শিখেছে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে গেলে যে স্নায়বিক ক্রিয়াশীলতার প্রয়োজন তার থেকে কথা না বলা অনেক বেশি আরামপ্রদ। লজ্জা লাগে এরকম শাস্তির সফলতা দেখে।ইংরাজী মাধ্যমের ছাত্রকে বাংলায় ইংরাজী ব্যাকরণ বোঝাতে গেলে-ছাত্রের মা এসে বলে যান, স্যার ওকে প্লিজ বেঙ্গলিতে গ্রামারটা বোঝাবেন না।বেঙ্গলিতে ও খুব পুওর। আ্যকচুয়ালি আমি পাতি বেঙ্গলি মিডিয়ামের স্টুডেন্ট, সো ইংলিশটায় আই আ্যম নট সো ডেফ্ট।তাই স্যার আপনি যদি ওকে ইংলিশে টট করেন গ্রামারটা, ইট উড বি বেটার ফর হিম।অবাক আমি বোঝার চেষ্টা করি, উনি আসলে বাংলায় দুর্বল না ইংরেজিতে!বাংলা ভাষাকে নিয়ে এই যে ‘ও খরচার খাতায় চলে গেছে’ মনোভাব, এই মনোভাবের বশবর্তী হয়েই তাই এয়ারটেলের  এই বিজ্ঞাপনের পরও ক্ষমা প্রকাশ করতে দুদিন লাগে তাদের এই অবাঞ্ছিত ত্রুটির জন্য।ওই যে বললাম, ব্যাকরণগত ত্রুটি কোনদিনই বক্তব্য প্রকাশে এবং তা বুঝতে অন্তরায় হয়নি।আমরা ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ হাতে অনেকেই হয়ত পড়েছি বিজ্ঞাপনটা, কেউ লক্ষ্য করেছি ত্রুটিগুলো, লক্ষ্য করে নিজের মনেই হেসেছি। আবার কেউ হয়ত বুঝতেই পারিনি বিজ্ঞাপনে ত্রুটিগুলো  ঠিক কোথায়। আবার কেউ সব পড়ে, বুঝে কল করেছি কাস্টমার কেয়ারে ‘প্রমিস’-এ আর কি কি সুবিধা আছে জানতে। বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের যেন কেমন বোকা মনে হয় আজ। কী দরকার ছিল খামোখা আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দেওয়ার। বাংলা জীবনের মৌলিক অধিকার নাকি যে তার অবমাননায় আন্দোলন হবে, প্রাণ যাবে।এয়ারটেল কে ধন্যবাদ জানাই সমস্ত বাঙালির, মানে যারা বাংলায় খুব ‘পুওর’ নয় তাদের সবার পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার গুরুত্ব আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা প্রকট করে দেওয়ার জন্য।অনেক অনেক ধন্যবাদ এয়ারটেল।বাংলায় বসে বাঙালি কে উদ্দেশ্য করে তার ভাষাকেই অপমান করা হবে, আর আমরা তথাকথিত বাঙালিরা এরপরও পয়লা বৈশাখে ‘অথেনটিক বেঙ্গলি মেনু’ সাবাড় করতে করতে বলব, ধুস্ এ পোড়া বাংলায় কোন ফিউচার নেই- এই বিরতিহীন পরম্পরায় এবার অন্তত বিরতি পড়ুক। না এয়ারটেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বলছি না, কিন্তু বাংলা ভাষার এই অবমাননায় আমরা একটু প্রতিবাদ তো করতেই পারি নাকি!


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।