মার্কশিট

লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ

মার্কশিট হাতে নিয়ে প্রণাম অথৈ জলে। কি জবাব দেবে বাবা মাকে? তিনটে সাবজেক্টে টায়ে-টুয়ে পাশ। অথচ এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। সে বরাবরই ক্লাসের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকত। মাধ্যমিকেও দারুণ রেজাল্ট করেছিল সে। কিন্তু তারপরই বাধল গণ্ডগোলটা। আর্টস নিয়ে পড়ার অদম্য ইচ্ছেটাকে দমিয়ে বাবা মায়ের ইচ্ছেতে নিতে হল সায়েন্স। আর তারপরই যেন দুনিয়াটা পাল্টে গেল তার। মাধ্যমিক অবধি তো কোনওরকমে সায়েন্স জুজুর সাথে মোকাবিলা করেছিল, আশা ছিল একটাই। মাধ্যমিক পেরোলে শুধুই তার নিজের পছন্দের সাবজেক্ট। কিন্তু বাবা-মার কাছে সায়েন্সটাই পড়ার মত, অন্যগুলো নয়। আর প্রণাম কখনও বাবা-মার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যায়নি।
তার পা চলছে না এখন। কিভাবে যাবে বাবা মা’র কাছে? স্কুলের মাঠ পেরিয়ে এখনও সে স্কুলের বাইরে আসতে পারেনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন স্কুলের বড় গেটটাও বন্ধ হয়ে গেল, তখন স্কুলের বাইরে আসতেই হল তাকে। অথচ তার পা যে চলতেই চাইছে না। কোনওরকমে চলতে চলতে বাড়ির পথ ধরল প্রণাম। তার সহপাঠীরা যারা এই পথ দিয়েই বাড়ি ফেরে, তারা বাড়ি ফিরেছে আগেই। তাই পথটা ফাঁকা লাগছে প্রণামের। নিতাইয়ের চায়ের দোকানের পাশে যে কুকুরগুলো খেলা করে আর স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রণামকে দেখলেই বিস্কুটের জন্য ধরে, তাদেরও দেখতে পেল না সে। তারাও কি তার খারাপ মার্কশিটের জন্য তার ওপর রাগ করেছে!
প্রণাম বাড়ির দরজার কাছে আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে মায়ের গলার আওয়াজ, “কি রে এত দেরী হল?” প্রণামের থেকে কোনও উত্তর না আসায় মা বেরিয়ে এলো বাইরে, “কি রে! মুখটা অমন কেন?” হঠাৎ রেজাল্টের কথা মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করল, “আজ রেজাল্টের দিন ছিল না?” কিছু বলল না প্রণাম, মাথা নিচু করে বাড়ির ভেতর ঢুকল। ঢোকার আগে মার্কশিটটা মায়ের হাতে দিয়ে দিল।
বিকেলেই মায়ের অনেক কড়া কথা শুনেছে সে। তারপর খাওয়া আর রোচে নি তার মুখে। বাবা আসবার পর আবারও সভা বসল বাড়িতে, বাবা মা আর সে। তার মত ছেলে কি করে এমন নাম্বার পায়, এরকম নাম্বারে কি হবে তার ভবিষ্যৎ, এরকম চললে তার বাবা-মা সমাজে কি মুখ দেখাবে, স্কুলে বা কোচিং-এ সে কোনও কুসঙ্গে পড়ল কিনা , এইসবই সভায় আলোচ্য বিষয়। রাতেও খাবার রুচল না তার মুখে।
“ছেলেটার প্রতি খেয়াল রাখো একটু!” বাবার চাপা গলার আওয়াজ শুনতে পেল প্রণাম। ওঘরে বাবা আর মা তাকে নিয়েই আলোচনা করছে। তার ওপর এখন থেকে কড়া নজরদারি রাখতে হবে। ছেলেটা নিশ্চয়ই কুসঙ্গে পড়েছে। এরকম অনেক মন্তব্য শুনতে পাচ্ছে প্রণাম। যে বাবা-মার তাকে নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না, একদিনেই সে তাদের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা মায়ের আলোচনার কিছু কিছু এখনও শুনতে পাচ্ছে সে। শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরবর্তী কয়েকদিনও না বাড়িতে না স্কুলে খুব একটা ভালো ব্যবহার পেল না সে। এমনকি যে বন্ধুদের এত কাছের মনে করত, তারাও তার মার্কশিট দেখার পর যেন তাকে এড়িয়ে চলছে।
“পড়াশোনায় মন নেই কেন?”, “তোর মন কোথায় রে”, “কি হয়েছে তোমার প্রণাম?”, “এমন করলে ফাইনাল এক্সমায়েও তো একই হাল হবে”, “অমন রেজাল্ট করেও লজ্জা নেই তোমার? এখনও ফাঁকি দিচ্ছ?”, “ছেলে তো সমাজে আমাদের মাথা একেবারে ছোট করে দেবে”, “কি লজ্জা! কি লজ্জা!”, “এরকম কি করে হয়ে গেলি রে তুই?” – এরকম হাজার প্রশ্ন- সমালোচনা তাকে এই কদিন ধরে শুনতে হচ্ছে।
আজ ফিজিক্স কোচিং থেকে ফেরার সময় বাড়ি ফিরল না প্রণাম। উল্টোদিকের পথ ধরল সে, যে পথটা গিয়ে শেষ হয়েছে সামনের রেললাইনটায়। সে পথ ধরে এগোতে থাকল সে, হাতে ধরা তার খারাপ মার্কশিটটা। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলের চেঁচানোতে ঘুরে তাকাল সে পিছন ফিরে।
রেললাইনের পাশে একটা বস্তি। সেইখান থেকেই এলো আওয়াজটা। তারপরই একজন লোকের চিৎকার, “ফের যদি দেকেচি তোকে বইপত্তর নিয়ে, হাড়গোড় সব এক করে দোবো!”
এতক্ষণে অনেকটা কাছাকাছি এসেছে প্রণাম। দেখতে পাচ্ছে সে ঘটনাটা। একজন লোক একটা ছেলেকে মারছে। সম্ভবত ছেলেটি তার নিজের ছেলে।
“মিস্তিরির ছেলে মিস্তিরি না হয়ে লেকাপরা করছিস? ফের যদি দেকি বইয়ের সাতে, তোকেও ছুঁড়ে ফেলে দেবো!” এই কথা বলে লোকটা কয়েকটা বই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটাও ঘরের ভেতর ঢুকল। প্রণাম যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একটা ট্রেন ছুটে গেল প্রণামের পাশ দিয়ে। প্রচণ্ড হাওয়ায় তার হাতের মার্কশিটটা উড়ে গেল রেললাইনের ওপর। চমকে পেছনে চলে এলো সে। ট্রেন চলে যাওয়ার পর আবার কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। প্রণাম শুধু তার হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এত কাছ দিয়ে ট্রেনটা গেছে যে সে ভয় পেয়ে গেছে খুব। হঠাৎ অন্য একটা ছোট্ট আওয়াজে প্রণাম দেখল সামনের বস্তির ঐ ঘরটা থেকে, যে লোকটা ছেলেটাকে মারছিল সেই লোকটা বেরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর একটা আলোর রেখায় প্রণাম বুঝল বস্তির ঐ ঘরের দরজাটা কেউ একজন নিঃশব্দে খুলল ভেতর থেকে। ছেলেটা। যে ছেলেটা মার খেয়েছিল একটু আগে। বাবা চলে যাওয়ার পর সে দরজা খুলে বাইরে এলো, যেদিকে তার বাবা চলে গেছে সেদিকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বাবার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
প্রণাম ছেলেটার পড়ার অদম্য ইচ্ছাটাকে শ্রদ্ধা জানাল মনে মনে। ছেলেটার ওপর তার বাবার শারীরিক অত্যাচারেও ছেলেটার ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারেনি তার বাবা। ট্রেনলাইনের দিকে তাকিয়ে দেখল প্রণাম, তার মার্কশিটটা পড়ে আছে ছিন্নভিন্ন। হঠাৎ মনটা যেন হাল্কা লাগলো তার। এই মার্কশিটটার জন্যই তো যত ঝামেলা। ভালো হয়েছে এটার এই দশা হয়েছে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাড়ির পথ ধরল সে।
যখন সে বাড়ি ফিরল, তখন বাজে রাত এগারোটা। বাবা মা তো খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। মা ফোন করছিল কাকে, প্রণামকে দেখেই ফোনটা রেখে তার সামনে এসে মা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় ছিলিস? স্যারের বাড়ি ফোন করেছিলাম, বন্ধুদের বাড়ি ফোন করেছিলাম, কোথাও তো ছিলিস না, তাহলে কোথায় গেছিলিস?” প্রণাম মাথা নিচু করে ছিল, এবার মাথা তুলে চাইল। তারপর মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে সে বলল, “আমি আর্টস নেব।”


শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।