লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
- সিনেমার নাম: বাহুবলী ২- দ্য কনক্লুশন
- পরিচালনা: এস এস রাজামৌলী
- প্রযোজনা: অর্ক মিডিয়া ওয়ার্কস
- অভিনয়: প্রভাস, রানা দাগগুবটি, অনুস্কা সেট্টি, তামান্না, রাম্যা কৃষ্ণান, সত্যরাজ, নাসার এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
- সময়: ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট
ভারতীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তে ২০১৭ সালে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় বোধয় বাহুবলী ২, সে সিনেমার এত প্রচারেই হোক, বা তার চাপে অন্যান্য অনেক সিনেমার নাভিশ্বাস অবস্থা থেকেই হোক, বাহুবলী ২ আছে শিরোনামেই। শুধু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি কেন, গোটা দেশেই অনেকগুলো আলোচ্য বিষয়ের মধ্যেই অন্যতম ছিল বাহুবলী ২। আর থাকবে নাই বা কেন, যে ইতিহাস সিনেমাটি রচনা করেছে, তার জন্য এই উচ্ছ্বাস তার অবশ্যই প্রাপ্য।
এখন কথা হল এই মাতামাতির কারণই বা কি, যৌক্তিকতাই বা কি! অনেক সিনেমাই তো তৈরি হয়েছে, আরও অনেক তৈরি হবে। তাহলে কি এমন আছে এই সিনেমাটার মধ্যে, যার জন্য একে নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই? আছে তো অনেক কিছুই, তবে সবচেয়ে বেশি যেটা আছে, সেটা হল বিশ্বাস আর সেই বিশ্বাসের প্রমাণ। হলিউডের থেকে যে আমরা আর পিছিয়ে নেই তার বিশ্বাস। গল্প, গ্রাফিক্স, অ্যাকশান কোনও কিছুতেই আর পিছিয়ে নেই আমরা এটা তারই প্রমাণ। তবে এর আগেও অসাধারণ অ্যাকশান বা গ্রাফিক্স নিয়ে রা ওয়ান বা শিভায়ের মত সিনেমা হলেও সেক্ষেত্রে লোকেশনের বেশিরভাগই ছিল বিদেশ। যেন গ্রাফিক্স বা অ্যাকশান করতে গেলে যেতে হত বিদেশেই। এক্ষেত্রে সবকিছুই ভারতীয়। যদি হলিউডের কাছে লর্ড অফ দ্য রিংস থাকে, তো আমাদের আছে বাহুবলী, এটা গর্ব করে বলতে পারি
যদি গল্পের আঙ্গিকে দেখি তাহলে ছোটবেলার সেই রঙিন মলাটে পরা রূপকথার রাজপুত্র, রাজকন্যা, দুষ্ট মানুষের ষড়যন্ত্র, রাক্ষস, যুদ্ধ,অবশেষে মন্দের ওপর ভালোর প্রতিষ্ঠা এসবইএসবই আছে। শুধু বইয়ের পাতা থেকে যথার্থভাবে তারা উঠে এসেছে সিনেমার পর্দায়।যে উঠে আসা, যে রপান্তরটা হলিউডে হয়ে গেছিল বহু আগেই, আমরাই সেইভাবে এতদিন পারিনি। বাধা ছিল সেই উন্নত প্রযুক্তির গ্রাফিক্স, বাধা ছিল এত টাকা খরচা করে সিনেমায় সেই পরিবেশ তৈরি করবার সাহস। তাই আমাদের রূপকথা আটকে ছিল আমাদের বইয়ে, আমাদের কল্পনায়। যেটুকু তৈরি হয়েছিল, সেটুকু যথেষ্ট নয়। তাই এটা ছিল আমাদের অনেকদিনের পাওনা, যা পরিচালক রাজামৌলি উপহার দিলেন আমাদের। তবে এটাকে শুধু রূপকথার সাথে তুলনা করা যাবে না, এতে আছে ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর অন্যতম একটি মহাকাব্য মহাভারতের ছায়া। এই ছায়া ছিল বাহুবলীর প্রথম ভাগেও। এর প্রায় প্রতিটি চরিত্রে আছে তার প্রভাব। বাহুবলীর প্রথম ভাগে যেমন দেখেছিলাম সত্যবতীর মত শিবগামীকে, এবারে দেখব তার মধ্যে গান্ধারীর ছায়া। প্রথম ভাগে দেখেছিলাম ভল্লাল দেবের মধ্যে দুর্যোধন তথা কৌরবদের একটা মিশ্রণ, এবারে দেখব তার মধ্যে আছে শকুনির প্রভাবও। দেখব পান্ডবদের বনবাসের মতোই বাহুবলী আর দেবসেনার রাজমহল থেকে বেরিয়ে সাধারণের মত থাকা। দেখব বয়োজ্যেষ্ঠদের মাঝে দৌপ্রদীর বস্ত্রহরণের যে অপমান হয়েছিল, তারই মত দেবসেনাকেও রাজসভার মাঝে অপমান করা হল এবং তখনই দেখব ভীমের মত বাহুবলীকে। আবার তেমনই অর্জুনের মত দেখব তার ক্ষিপ্রতা।
যদি গ্রাফিক্সয়ের দিক থেকে বলি তাহলে বলব, সেটা সিনেমা হলে গিয়েই দেখে আসুন। ভারত যে আর হলিউডের থেকে পিছিয়ে নেই সেটা বোঝা যাবে। বাহুবলীর প্রথম ভাগের থেকে এই ভাগের গ্রাফিক্স আরও উন্নত, আরও দুর্ধর্ষ। কিছু কিছু জায়গায় জোর করে ভুল ধরাই যায়, আবার সেগুলো এড়িয়েও যাওয়া যায়। আপাতত আমি সেগুলো এড়িয়েই গেলাম।
অভিনয়ের দিক থেকে যদি দেখা হয়, তাহলে বোধয় সিনেমাটার অন্যতম মূল আকর্ষণ এটা। এই দুবছরে বাহুবলীর মূল দুই চরিত্র এর পরিশ্রম নিয়ে অনেক খবরই এসেছে বাজারে, তার কোনোটাই যে মিথ্যে নয়, সেটা সিনেমাটা দেখলেই বোঝা যায়। তবে খবরে থাকা প্রভাস বা রানাই শুধু নয়, অসাধারণ অভিনয় করে গেছেন প্রতিটা অভিনেতা অভিনেত্রীই। চরিত্রের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছেন একেবারেই। চরিত্রগুলোকে পুরোমাত্রায় জীবিত করে তুলেছেন প্রত্যেকে।
সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং আর মিউজিক নিয়ে আলাদা করে কিছু বলছি না। ওগুলো সিনেমার সাথে এমনভাবেই মিশে গেছে, তাদের আলাদাভাবে চেনা মুশকিল। আলাদাভাবে তাদের বিচার করতে যাওয়া মানে জোর করে বলতে হয় বলে বলা।
তবে খুঁত কিছু আছেই। হয়তো গল্পের কোনো জায়গা মনে হতে পারে আরও একটু যুক্তিগ্রাহ্য হলে ভালো হত। আবার কখনও মনে হতে পারে হয়তো কোনো দৃশ্য আরও একটু দীর্ঘায়িত হলে ভালো হত।এই মতামত অবশ্য মানুষবিশেষে আলাদা হতেই পারে। তবে সিনেমাটা শেষ হয়ে যাবার পর মনে হবে, যদি এটা দুটো অংশের সিনেমা না হয়ে একটা সিরিজ হত, কি ভালই না হত…
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।