লেখক : রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
- সিনেমার নাম: শেরনি
- পরিচালনা: অমিত মাসুরকার
- প্রযোজনা: টি সিরিজ
- অভিনয়: বিদ্যা বালন, শরৎ সাক্সেনা, বিজয় রাজ এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
- সময়: ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বিশাল বড় বাগান ছিল। নানারকমের পাখির বাস ছিল সেখানে। আমাদের মত তাদেরও ঠিকানা ছিল জায়গাটা। শুধু পাখি না, আরো কিছু প্রাণীও ছিল। যেমন ছিল সাপের বাস। কিন্তু আমরা সাপকে ভয় পেতাম, তাই কখনো গর্ত থেকে বেরোলেই তাদের মরতে হত। খুব ছোট ছিলাম তখন। প্রার্থনা করতাম যেন সাপগুলো না বেরোয়। তারপর একটু একটু করে বাগানটা কয়েকটি ভাগে বেশ কিছু জনের কাছে বিক্রি হয়ে গেল। গাছগুলো কাটা পড়ল, নতুন ক্রেতাদের বাড়ি উঠল সেখানে। এখন সেখানে শুধু মানুষেরই বাস।
বর্তমানে যেখানে থাকি, সেই এপার্টমেন্ট এর বাইরে কয়েকমাস আগেও জঙ্গলের মত জমি ছিল। সেখানে সাপ, বেজি, বুনো বেড়াল আমাদের জানলা দিয়ে দেখা যেত। এই করোনার ঘরবন্দি সময়ে বিকেলবেলায় ওয়ার্ক ফ্রম হোমের মাঝে পাঁচ মিনিটের জন্য বেজিগুলোর দৌড়াদৌড়ি দেখে মনটা বেশ আনন্দে ভরে যেত। বেশ কয়েক মাস হল জঙ্গল সাফ করে বহুতল নির্মাণের কাজ চলছে। বেজিগুলো কোথায় গেল কে জানে!
মানুষ আর প্রাণীদের বাসস্থানের এই যে দ্বন্দ্ব, দিনদিন বেড়েই চলেছে। জঙ্গল কেটে বাড়ি বা কারখানা তৈরির ফলে জংলি প্রাণীরা তাদের বাসস্থান হারাচ্ছে। এর ফলে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ভারসাম্য। এটা বর্তমান সময়ের একটা বড় সমস্যা। কিন্তু এই নিয়ে কথা হয় বোধয় সবচেয়ে কম। এই সমস্যা নিয়ে কথা বলা দরকার, সচেতনতা দরকার, সিনেমা করাও দরকার। ‘শেরনি’ সেইরকমই একটি সিনেমা।
অমিত মাসুরকার পরিচালিত শেরনি সিনেমাটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন প্রাইমে ২০২১ সালের ১৮ জুন মুক্তি পেয়েছে। সিনেমার গল্প উপরের অংশে উল্লিখিত মানুষ প্রাণীর বাসস্থানের দ্বন্দ্ব এবং সমস্যা নিয়ে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি বিভাগ আছে, অনেক অভিজ্ঞ মানুষ আছে। কিন্তু প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষের অজ্ঞতা, উপেক্ষা, জঙ্গলের প্রাণীদের প্রতি মানুষের ভয় এবং সর্বোপরি একদল মানুষের ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা ভোগের লোভে এই সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে। এর সমাধান পাওয়া মুশকিল। এই সিনেমায় সেই বাস্তবকেই তুলে ধরা হয়েছে। একটি বাঘিনী জঙ্গল আর লোকালয়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তার চলাফেরার জায়গাকে ট্র্যাক করে সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের যেতে মানা করে বন্যবিভাগের কর্মীরা। উদ্দেশ্য বাঘিনীটিকে ধরে সামনের জাতীয় উদ্যানে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু বন্যবিভাগের নিষেধ উপেক্ষা করে স্থানীয় মানুষ গরু ছাগল চরাতে সেই জায়গায় যায়। একজন মারা পড়ে। মানুষ না বুঝেই রেগে যায় বাঘের ওপর। শুরু হয় রাজনীতি। বাঘটাকে মারলে ভোট তাদের পকেটে ভেবে দুই দলের বিধায়ক মাঠে নামে। বেশ কয়েকজন শুট্যার চলে আসে। তাদের উদেশ্য কটা বাঘ মেরেছে এই নিয়ে গর্ব করা। বন্যপ্রাণী, পরিবেশ নিয়ে কেউ ভাবে না। বনবিভাগের কিছু অফিসার, স্থানীয় প্রফেসর এবং স্থানীয় কিছু মানুষ এইসবের গুরুত্ব বোঝে। তারা এত কিছুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে বাঘটাকে সাবধানে জাতীয় উদ্যানে পাঠাবে ভেবে ধরবার চেষ্টা করে। কিন্তু সব অফিসার একরকম হয় না। চাকরির চাটুকারিতা, রাজনীতি আর মানুষের লোভের কাছে হার মেনে শেষমেশ হত্যা করা হয় বাঘিনীকে। তবে এই গল্প যতটা বাঘিনীর, ততটাই একজন বনবিভাগের একজন নারী ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের, যে নিজের চাকরি নিয়ে বেশ হতাশ। সে কাজ করতে চাইলেও করতে পারছে না। সিনিয়র অফিসারদের কাছে তাকে নত হতে হচ্ছে। কিন্তু সে দমতে চায় না। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের কাছে সে যেন অসহায়। কর্মক্ষেত্রেও এই পুরুষতন্ত্র কিভাবে ঢুকে গেছে সেটাও সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। বাহুবলীতে দেখানো হয়েছিল আদর্শ নারীসমাজ কেমন হওয়া উচিত। পাঠক চাইলে এখানে সেটা পড়তে পারেন। সে চেয়েও বাঘের হত্যা আটকাতে পারে না। হতাশ হয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু শেষ অবধি দেয় না। কারণ জানতে আপনাকে দেখতে হবে সিনেমাটি। সেই অর্থে বাঘিনী বলতে এই অফিসারকেও বলা হয়েছে।
তবে গল্পটির সাথে বাস্তবের ঘটনার অনেক মিল রয়েছে। এর জন্য আসগর আলির থেকে নোটিশ ও পেয়েছেন নির্মাতারা, এবং স্বাভাবিকভাবেই নির্মাতারা এই ঘটনার সাথে সিনেমার মিলের কথা অস্বীকার করেছেন।
ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের চরিত্রে বিদ্যা বালন অসাধারণ। তবে শুধু তিনিই নয়, প্রতিটা অভিনেতাই একেবারে মানানসই। তারা এমনভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে চরিত্রকে যেন গল্পের চরিত্র এবং তারা আসলেই অভিন্ন। অভিনয় এবং গল্প এই সিনেমার ভিত্তি। এই দুইয়ের গতিতে এমন ভাবেই এগিয়েছে, যে সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এর প্রভাব মনে ছাপ রেখে দিয়েছে। এখনও ভাবছি, আমরা কি এতটাই লোভী আর বোকা? নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য এভাবে হত্যা? আমাদের ভবিষ্যৎকে কোথায় ঠেলছি? রাজনীতির কাছে কি এতটাই অসহায় আমরা? চাকরিক্ষেত্রে চাটুকারী ঊর্ধ্বতনের কাছে একজন অফিসার কতটা অসহায়?
চিত্রনাট্য খুব সুন্দর । ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। আবহসঙ্গীত মানানসই। কিন্তু সিনেমাটা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি দীর্ঘ এটা অনেকের মনে হতে পারে। কারণ গল্পের পরিবেশ তৈরি করতে সময় লাগবে। তাছাড়া জঙ্গলে বাঘ খোঁজা, ক্যামেরায় বাঘ ধরা পড়া এইসব দেখাতে দেখাতে কখনও যেন ডকুমেন্টারির ছন্দে চলেছে এডিটিং। অনেকের এই গতি পছন্দ নাই হতে পারে। যেহেতু এটা সব দর্শকের জন্য নয়। তবে এইরকম অসাধারণ আরও অনেক এইরকম সিনেমা এই সময়ে দাঁড়িয়ে দরকার।
তথ্যসূত্র:
১. https://timesofindia.indiatimes.com/city/hyderabad/avni-killer-asghar-serves-notice-on-sherni-filmmakers/
২. https://thecinemaholic.com/is-sherni-a-true-story/
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।
চমৎকার লাগল