হাবুকথা : নির্বাচন

লেখক : রাজীব চক্রবর্ত্তী

সপ্তাহের শেষে হাবুর নেশার মাত্রাটা একটু বেড়ে যায়। ফলে মেজাজটাও হয় একটু আলাদা। গত শনিবারে ঝড়-জলের মধ্যে ঠেকে গিয়ে দেখি রক ফাঁকা। হাবু একা চোখ বুজে বসে আছে। হাতদুটো বুকের সোজাসুজি তোলা। একটু কাছে গিয়ে দেখি বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও হাবুর কোনও হুঁশ নেই। হাত দুটো উপর নিচে করছে। কখনও ডান হাত উপরে তো কখনও বাঁ হাত। ঠিক দাঁড়িপাল্লার মত। কয়েকটা শব্দ ভেসে এল – ডাকাত … চোর … বখাটে … বাউন্ডুলে ….
কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বললাম, তোর যে এত ধরণের নাম জানতাম নাতো!
একটুও না রেগে চোখ খুলে তাকাল। শান্ত গলায় বলল, গভীর সমস্যা। এদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।
কি বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না। খুলে বল।
পা দুটো মুড়ে আরাম করে বসল হাবু। পকেট থেকে বের করে একটা বিড়ি ধরাল। তারপর বাঁ হাত হাঁটুর উপর রেখে, ডান হাতে ধরা বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে চোখ বুজে বলল, কাল রাত্রে স্বপ্নে এক সাধু এসেছিলেন।
অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, এই রে!
হাবু চোখ খুলে ঠান্ডা গলায় বলল, কথার মাঝখানে একদম প্যাকপ্যাক করবি না। চুপ করে শোন।
নেশা দেখছি ভালই চড়েছে। মজা করে বললাম, আর কথা বলব না। বাবা হাবুনন্দ, আপনি শুরু করুন। শুনে ধন্য হই।
চারিদিক ধোঁয়ায় ঢাকা। তারমধ্যে এসে দাঁড়ালেন এক সাধুবাবা। লম্বা চুল, সারা মুখ ঢাকা কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফে। কাঁধের ঝোলাটা থেকে বের করলেন একমুঠো ফুল। তাদের কত রকমের রং। ফুলগুলো শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে বললেন – হাবু বেটা, নানা রঙের ফুল দিয়ে গাঁথা একটা মালা কয়েকদিন পরে তুই পাবি। সেই মালা পাবার পরেই তোর কাছে চারজন লোক আসবে। তাদের মধ্যে একজনের গলায় মালা পরিয়ে দিবি। যার গলায় মালা দিবি সেই রাজা হবে।
সাধুর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। বলে কি সাধু মহারাজ! আমি মালা পরালেই রাজা! হাত জোড় করে বলি, কি বলছেন প্রভু? আমি যাকে মালা পরাব সেই রাজা হয়ে যাবে?
সাধু হেসে বললেন, শান্ত হ। তোর মত তোর বন্ধুরাও মালা পড়ানোর সুযোগ পাবে। বেশি লোক যাকে মালা পড়াবে সেই রাজা হবে। তাই ভেবেচিন্তে মালা পরাস।
এইবার বুঝলাম। মাথা চুলকে বললাম, তা বাবা লোকগুলোকে দেখতে কেমন?
সামনে এলেই দেখতে পাবি। একটা শক্তিশালী ডাকাত। ধনসম্পত্তি তো ছিনিয়ে নেয়ই, আবার মাঝে মাঝে গলা টিপেও মেরে ফেলে। দ্বিতীয় জন চুরির নেশায় মাতাল। দিনরাত শুধু ফন্দি করে। কখনও নেশার টানে চুরি করে, কখনও আবার চুরি করে নেশা করে। তার পরে আছে একটা বুড়ো ছিঁচকে চোর। মার খেয়ে কোমর ঝুঁকে গেছে। তবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সব শেষে সেজেগুজে, গায়ে সুগন্ধি মেখে আসবে এক বখাটে, বাউন্ডুলে। আয়েশ করেই সময় কাটে। মনে ভাবে অনেক কিছুই, কিন্তু শুরু করার আগেই দিন শেষ। এই পর্যন্ত বলে সাধু মুচকি হেসে মিলিয়ে গেল।
সাধু তো বলে গেল ভেবেচিন্তে মালা পরাস। এদিকে আমি ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। বুঝতেই পারছি না কার গলায় মালা দেব?
সত্যিই হাবু বড় মুশকিলে পড়েছে। ওকে উদ্ধার করার জন্য বললাম, সব কটাই তো দেখছি গুণধর। কি দরকার এদের গলায় মালা দেবার! কাউকেই দিবি না। মালা ছিঁড়ে ফেলবি।
চোখ কুঁচকে হাবু বলে, ওতে সমস্যা মিটবে না। আমি না দিলেও তোরা কোনও একজনের গলায় মালা দিয়ে দিবি। ধরে নিলাম তোরাও দিবি না। কিন্তু অন্য কেউ দেবে। মোদ্দা কথা আমার অপছন্দের কেউই রাজা হবে।
ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, তাহলে আর কি করবি! ওদের মধ্যে যেটাকে কম ক্ষতিকারক মনে হয়, তাকেই মালা পরাস।
হাবু সোজা হয়ে বসল, ঠিক বলেছিস। সেই চেষ্টাই তো করছি।
হাত দুটো আবার আগের মত উপর নিচে করতে করতে মাথা দুলিয়ে বলতে লাগল, দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখছি কার পাপের পাল্লা কম ভারী।
হঠাৎ করে থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো লাল। গম্ভীর গলায় বলল, বিশু দাদুকে মনে আছে?
কি বলছিস হাবু! বিশুদাদুকে মনে থাকবে না।
হ্যাঁ। তোর তো মনে থাকবেই। তুই আর ভুতো তো পড়তিস দাদুর কাছে।
পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিল হাবু। দুপুর বেলা পড়তে যেতাম দাদুর কাছে। ইংরেজি আর অঙ্ক। লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে দাদু পড়াতেন। শীতকালে গায়ে থাকত একটা ফতুয়া। মাঝে মাঝে নাকে নস্যি নিতেন। বাঁধানো দাঁতে দাদু হেসে হেসে মজা করে পড়াতেন আর মাঝে মাঝে ছড়া কাটতেন। টেন্স পড়াতে গিয়ে বলে উঠতেন – 

শেষ হয়েও না হল শেষ,
রয়ে গেল কাজের রেশ।
প্রেজেন্ট পারফেক্ট ….

কিংবা অঙ্ক করানোর সময় –

সিঁড়িগুলোয় সাবধানে পা ফেলো পরপর,
সব শেষে পৌঁছলেই মিলে যাবে উত্তর।

তোরা ভাগ্যবান দাদুর কাছে পড়তিস। দাদু জিনিয়াস ছিলেন বুঝলি।
হঠাৎ করে হাবুর বিশুদাদুর প্রতি ভক্তির কারণ বুঝতে পারলাম না। হাবুকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিলাম।

– তুই তো দাদুর পিছনে লাগতিস। সুযোগ পেলেই লুঙ্গি ধরে টান মারতিস।
– দাদু কিন্তু রাগতেন না। মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে শোনাতেন। একদিন দেখি দাদু বাজার থেকে ফিরছেন। ফতুয়াটা ঘামে ভিজে গেছে। দুহাতে দুটো ভারী ব্যাগ। মুখে হাসি। মনের আনন্দে হেঁটে চলেছেন ছড়া বলতে বলতে –

যাচ্চলে ভাই যাচ্চলে
হচ্ছে কি সব কলিকালে!
সিঁধিয়ে গেল সিঁদেল চোরে
বাঁশবাগানে, ঝোপের ধারে।

বড় চোর বড় গলায়
হেসে বলে আয় কাছে আয় ,
শুখা আঙুল আর চাটিস না
ভাগ পাবি যে দুচার আনা।

হাটি হাটি পায় পায়
মহা চোরের জামার তলায়
ঢুকে বলে সিঁদেল চোর
দেখব এবার নতুন ভোর।

হল কি যে হঠাত্‍ করে
চারিদিকে হা রে রে রে ,
চোরের মাথায় পড়ল পা
নাচে ডাকাতের তিনটে ছা।

– হাবুর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম, তুই এখনও ছড়াটা মনে রেখেছিস!

হাবু মুচকি হেসে বলল, ছোটবেলায় তো শুধু শুনতাম আর তালে তালে মাথা দোলাতাম। ভাগ্যিস মনে আছে। তাই আশেপাশের নাটকগুলো সহজে বুঝতে পারি।


লেখক পরিচিতি : রাজীব চক্রবর্ত্তী
জন্ম ১৯৭০ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, কলকাতার সিঁথিতে। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। দৈনন্দিনতার ক্লান্তি কাটাতেই মূলত: কলম ধরা। বেশ কয়েকটি লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখেছেন গল্প, কবিতা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "সংশ্লেষ" নামক গদ্য সংকলনে স্থান পেয়েছে তাঁর মুক্তগদ্য। ঐ একই বছরে সোনারপুর কাব্যমঞ্চ আয়োজিত স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন তিনি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত "অন্য গদ্য" গ্রন্থে স্থান পেয়েছে তাঁর গদ্য। জীবনের বিবিধ অনুভূতি, বাস্তবতাকে ছন্দে বাঁধার প্রয়াসে তাঁর কবিতাচর্চা।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।