আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ৩)

লেখক: মিত্রা হাজরা

এ যে বড় আজব কারখানা–
সিরাজ সাঁই এর কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর একটা আমবাগানে বসে লালন গান বাঁধতেন মুখে মুখে, আর একতারা নিয়ে বিভোর হয়ে থাকতেন। তাঁর গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। কুষ্টিয়ার কাছে ছেঁউড়িয়ায় নদী কিনারে লালন ভক্ত মলম শাহ কারিগর ষোলো বিঘা জমি দান করলেন। কারিগর সম্প্রদায় আখড়া বানিয়ে দিলেন। দলে দলে মানুষ এসে জড়ো হলেন চারপাশে। এ যে ভক্তিরসের প্লাবন, রোখে কার সাধ্য! কাঙাল হরিনাথ, পাঞ্চু শাহ, ভোলাই শাহ, মলম শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দিন, গগন হরকরা চলছে সাধনা—সহজ সাধনা, নিজেকে জানো, নিজেকে জানো—–এটাই সবচেয়ে বড় জানা। লালন ফকিরের গানে দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ব, ভাব সম্মেলন, মানুষ ভজন, জাতিভেদহীনতা আকৃষ্ট হলেন সব মানুষ, রসের ভান্ডার এ। ভিক্ষাই জীবিকা, পেলে খান, না পেলে গান গেয়ে সব মজে থাকেন। উচ্চনীচ সব ভেদ ভাব ভুলে একাকার হয়ে গেল। এক হরিনামে জগৎ ভাসিয়ে ছিলেন নিমাই, আর এক বাউল গানে জগৎ ভাসালেন লালন ।

‘হকের ধন’–নামে একটা কুটিরে থাকতেন লালন সাঁই, শিষ্যদের সাথে সাধন মার্গের আলাপ আলোচনা করতেন। বলতেন— এ বিশ্ব সংসারে আমি নিঃস্ব।
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি —কমনে আসে যায়-‘—দেহের ভিতর এই অচিন পাখির বাস। সেই পাখির সন্ধানে সীমাহীন এ যাত্রা। পার্থিব দেহ সাধনার ভিতর দিয়ে দেহোত্তর জগতে পৌঁছানোর এটা এক মাধ্যম। ঠিক সেই সময় বলছেন এ সব কথা — যখন হিন্দু মুসলমান বিভেদ বাড়ছে। মানুষ শুনছে লালনের এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলাতে মানবতার জয়ধ্বজা উড়িয়েছেন ফকির লালন।

সবলের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে দুর্বল, লালন খবর পেয়েই চললেন সেখানে। কাঙাল হরিনাথ এর বাড়িতে আগুন লাগাবে বলে জমিদারের নায়েব লোক লস্কর নিয়ে হাজির, হরিনাথ বাড়ি নেই। বাড়ির মেয়েরা ভয়ে কেঁদে কেটে অস্থির। কে রক্ষা করবে এ বিপদে? জঙ্গল ফুঁড়ে নায়েবের সামনে এসে দাঁড়ালেন লালন—কী ! যে কাঙাল তার সব কিছু দান করে দিয়েছে গ্রামে স্কুল গড়ে দিয়েছে, তার খাজনা বাকি বলে হেনস্থা করতে এসেছো? লাঠি হাতে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, ভয় পেয়ে পিছু হলো নায়েব। একতারা ধরা হাত, সে দিন লাঠি তুলে নিয়েছিল। আসলে হরিনাথ তাঁর সম্পাদিত –‘গ্রাম বার্তা’ পত্রিকায় শিলাইদহের জমিদারের প্রজা পীড়নের খবর ছাপান। তাই নায়েব হরিনাথকে শিক্ষা দিতে চড়াও হয়। কিন্তু লালনের প্রতিরোধে পালাতে পথ পায়নি সেদিন। শুধু গান নয়, লাঠি হাতে দুষ্টকে জব্দ করতেও ফকির লালন পিছ পা হননি কখনো।

মানুষ জাগছে, জানার চেষ্টা করছে ভুল ঠিক। সব মানুষ ই সমান, কেউ ছোটো বড় নয়। কখনো নির্জন বনে, কখনো নদীর ঘাটে লালন গান গাইছেন—–
“বাড়ির কাছে আরশী নগর—সেথায় এক পড়শী বসত করে
আমি একদিন ও না দেখলাম তারে।
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি—নাই কিনারা নাই তরণী পারে
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে–কেমনে সে গাঁয় যাই রে!”

লালনের এই গানে দেহসাধনার ইঙ্গিত পাই আমরা। লালন বললেন— বাড়ির কাছে আরশীনগর, এক পড়শী বসত করে। এ জায়গা সাধকের শুদ্ধতম হৃদয়, পড়শী এখানে ঈশ্বর। জায়গার নাম আরশীনগর কেন?
আরশী মানে আয়না, আয়নাতে আমরা নিজেকে দেখি ।আমাদের অন্তরাত্মা হলো আমাদের প্রতিচ্ছবি, সেই শুদ্ধতম আমি ঈশ্বর। বাউল মতে এই ঈশ্বর নিরাকার, তাই কখনো শূন্যে ভাসেন কখনো থাকেন জলে। আসলে বলছেন— কখনো অনুভূতি গোচর, কখনো অনুভূতি শূন্য। তাহলে আমরা তাঁর সাক্ষাৎ পাই না কেন? বলছেন— সেখানে আছে অগাধ জলরাশি, এই জলরাশি মানুষের অন্তহীন বাসনা। তাই পাশে থেকেও আমরা ঈশ্বর কে ছুঁতে পারি না।

চলবে…

গ্রন্থ ঋণ —
লালন ভাষা অনুসন্ধান –আবদেল মান্নান
লালন সমগ্র–মোবারক হোসেন খান
লালন শাহ ফকির–মুহম্মদ আবদুল হাই।


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ২)আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ৪) >>

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum