আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ৪)

লেখক: মিত্রা হাজরা

“কানাই কার ভাবে তোর এ ভাব দেখিরে/ব্রজের সে ভাব তো দেখি নারে
পরনে ছিল পীতধড়া, মাথে ছিল মোহন চূড়া—করে বাঁশি রে! “—লালন।

বাঁকা নদীর ধারে ভোর আলতো করে ঘোমটা খুলছে। গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়ানো, একদৃষ্টে পুবের আকাশ দেখছেন লালন সাঁই। আল্পনা আঁকা প্রভাতে কৃষ্ণের গেরুয়া রঙে ছোপানো আকাশের গায়ে নতুন দিনের আশার, অপেক্ষার সূর্য দেখছেন সাঁইজী। মনের মানুষের খোঁজে পিপাসার্ত লালন, নদীতীরে একাকী, ছেউড়িয়ার ঘুম ভাঙছে, দুরে হতদরিদ্র মানুষের ভাঙা কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে। সাঁইজী ভাবতে লাগলেন সর্বস্ব হারানো মানুষ গুলো ধনীর লোভের চাপে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে। ফকিরী–কেই শেষ আশ্রয় করছে। সময় পায়ে পায়ে চলে যাচ্ছে। নানা ধর্মগোষ্ঠী মানুষ, সম্প্রদায়, মতবাদে আজ ভিন্নতা, সকলেই তো মানুষ, কবে নিজেকে ও অন্যকে মানুষ ভাবতে শিখবে। অন্য ধর্মে অসহিষ্ণুতা মারাত্মক আকার ধারণ করছে ।

খড়ের চালের কয়টা বেত বাঁশের চালার ঘর, আদিঅন্ত চর ধূ ধূ বালিয়াড়ি ।মতি বিবিকে দেখা গেল জঙ্গল ঢুঁড়ে কিছু গাছ গাছালি জোগাড় করতে। গ্রামের বয়নকারিনী এই রমণী আশ্রমের সব কাজ স্বেচ্ছায় করে। সকলের জন্য বড়ো মায়া এ রমণীর , লালন সাঁইকে গুরু মেনেছেন। মতি বিবির সাথে কখনো কখনো ভোলাই শাহ যায় এই শিকড় বাকল চেনাতে। লালন সাঁই কবিরাজী চিকিৎসা করেন গ্রামের হতশ্রী রোগা ভোগা মানুষগুলোর। শিষ্য ভোলাই শুধু গুরুর গান নয়, কবিরাজী জড়ি বুটির নাম ও লিখে রাখে তার গানের খাতায়। হয়তো পরে কারোর কাজে লাগবে এ লেখা। মাটির হাঁড়িতে কিছু জড়ি বুটি পাতা সেদ্ধ করে মতি বিবি , চায়ের মত সেই গরম পানি ভাঁড়ে করে এক এক ভাঁড় সকলকে দেয়। ভোলাই, মানিক শাহ, মনসুরউদ্দিন সকলেই পান করতে থাকে। লালন সাঁই একদৃষ্টে সেই মাটির ভাঁড়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
বললেন— ভান্ড, ব্রহ্মাণ্ড, দেহভান্ড।
“কেমন দেহভান্ড চমৎকার! —ভেবে অন্ত পাবা না যার “
চারিদিকে শিষ্যরা গোল হয়ে বসে গেল– গুরুর মুখ নিঃসৃত বাণী শুনবে বলে। এক কোণে মতিবিবিও বসে গেল–।

“কেমন দেহভাণ্ড চমৎকার, ভেবে অন্ত পাবা না যার
আগুন জল আকাশ বাতাস আর মাটিতে গঠন তার।
এ পঞ্চতত্ত্ব করে একত্র কীর্তি করেন কীর্তিকার।
মেরুদন্ড শতখন্ড, ব্রহ্মাণ্ড হয় তাহার ‘পর
সাত সমুদ্র চৌদ্দ ভুবনে, নয় নদী বয় নিরন্তর।
ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না দেখো রঙ হয় তিন প্রকার
উপরে ব্রহ্মনাড়িতে ব্রহ্মরন্ধ্র রয় মূলাধার।
সপ্তদল পাতালে নিচে চতুর্দল /আর কুল কুণ্ডলিনী সদাই স্থির
তার উর্ধ্বে বিজনেতে দশম দল
কমলের পর মণিপুরের ঘর”———

লালন দর্শন মূলত তত্ত্ব দর্শন, তত্ত্ব অর্থ যা সৃষ্টির মূল। যেমন কলসীর তত্ত্ব মাটি, অলঙ্কারের তত্ত্ব সোনা, আলোর তত্ত্ব আগুন–মানবদেহ এই পঞ্চতত্ত্ব বা পাঁচ মূল উপাদানে গঠিত। এই পঞ্চতত্ত্ব থেকে সৃষ্টি তথা দেহ পরিচালিত ও সম্পাদিত হয়। আবার এই দেহ থেকেই দেহ লয়প্রাপ্ত হয়। আকাশ বাতাস আলো মাটি জল—- এদের ঘনীভূত সমষ্টি চেতনা। পঞ্চভূতের মধ্যে আকাশ একটি মহান গুণ, এটি কারোর আশ্রয়ভুক্ত নয়। আকাশ না থাকলে মাটি, জল, আলো হাওয়ার অস্তিত্ব থাকত না। সর্বোপরি আকাশে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় প্রত্যেক পল অনুপলে ঘটে চলেছে। এর অবস্থান দর্শিয়েছেন লালন সাঁই এই দেহভান্ড কাব্য সুষমায়।

চলবে…

গ্রন্থ ঋণ —
লালন ভাষা অনুসন্ধান –আবদেল মান্নান
লালন সমগ্র–মোবারক হোসেন খান
লালন শাহ ফকির–মুহম্মদ আবদুল হাই।


লেখকের কথা: মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা, লেখালেখি করতে ভালোবাসি, কবিতা, ছোটগল্প লিখি মাঝে মাঝে। বই পড়তে ও গান শুনতে ভালোবাসি। পড়ি শংকর এর লেখা, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প আমার খুব প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ, রুদ্রমুহম্মদ শহিদুল্লা, সুনীল, বিষ্ণু দে এর কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগলে বা খারাপ লাগলে অবশ্যই জানাবেন।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ৩)আমি তারেই খুঁজে বেড়াই (পর্ব – ৫) >>
শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।