লেখক: রানা চক্রবর্তী
( ছবিতে – ‘অপু’ চলচ্চিত্র সিরিজের শেষ চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ এর শুটিং চলাকালীন শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (অপু) ও শ্রীমতী শর্মিলা ঠাকুর (অপর্ণা) কে চিত্রনাট্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন শ্রী সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৯ সালের প্রথম দিকের ছবি।)
সত্যজিৎ ঠিক করেন যে, বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী “বিল্ডুংস্রোমান” পথের পাঁচালী-ই হবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই প্রায়-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটিতে বাংলার এক গ্রামের ছেলে অপুর বেড়ে ওঠার কাহিনী বিধৃত হয়েছে।
এ ছবি বানানোর জন্য সত্যজিৎ কিছু পূর্ব-অভিজ্ঞতাবিহীন কুশলীকে একত্রিত করেন, যদিও তাঁর ক্যামেরাম্যান শ্রী সুব্রত মিত্র ও শিল্প নির্দেশক শ্রী বংশী চন্দ্রগুপ্ত দুজনেই পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেন। এ ছাড়া ছবির বেশির ভাগ অভিনেতাই ছিলেন শৌখিন। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে সত্যজিৎ তাঁর নিজের জমানো টাকা খরচ করে দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন প্রাথমিক দৃশ্যগুলো দেখার পরে হয়ত কেউ ছবিটিতে অর্থলগ্নি করবেন। কিন্তু সে ধরনের আর্থিক সহায়তা মিলছিল না। পথের পাঁচালী-র দৃশ্যগ্রহণ তাই থেমে থেমে অস্বাভাবিকভাবে প্রায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে সম্পন্ন হয়। কেবল তখনই দৃশ্যগ্রহণ করা সম্ভব হত যখন সত্যজিৎ বা নির্মাণ ব্যবস্থাপক শ্রী অনিল চৌধুরী প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে পারতেন। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় ও সে বছরই এটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পরপরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে ও বহু পুরস্কার জিতে নেয়। ছবিটি বহুদিন ধরে ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয়। ছবিটি নির্মাণের সময় অর্থের বিনিময়ে চিত্রনাট্য বদলের জন্য কোন অনুরোধই সত্যজিৎ রাখেননি। এমনকি ছবিটির একটি ‘সুখী সমাপ্তি’র জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধও তিনি উপেক্ষা করেন।
ভারতে ছবিটির প্রতিক্রিয়া ছিল উৎসাহসঞ্চারী। দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া-তে লেখা হয় যে, “It is absurd to compare it with any other Indian cinema … Pather Panchali is pure cinema.” (“একে অন্য যেকোনও ভারতীয় চলচ্চিত্রের সাথে তুলনা করা অবাস্তব… পথের পাঁচালী হল বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র”)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লিন্জি অ্যান্ডারসন চলচ্চিত্রটির অত্যন্ত ইতিবাচক একটি সমালোচনা লেখেন। তবে ছবিটির সব সমালোচনাই এ রকম ইতিবাচক ছিল না। বলা হয় যে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো ছবিটি দেখে মন্তব্য করেছিলেন: “কৃষকেরা হাত দিয়ে খাচ্ছে – এরকম দৃশ্যসম্বলিত ছবি আমি দেখতে চাই না।” দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স-এর সবচেয়ে প্রভাবশালী সমালোচক বসলি ক্রাউদার ছবিটির একটি কঠোর সমালোচনা লেখেন, এবং সেটি পড়ে কেউ কেউ মনে করেছিলেন ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পেলেও ভাল করবে না। কিন্তু এর বদলে ছবিটি সেখানে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি দিন ধরে প্রদর্শিত হয়।
সত্যজিতের পরবর্তী ছবি ‘অপরাজিত’-এর সাফল্য তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে। এই ছবিটিতে তরুণ অপুর উচ্চাভিলাষ ও তাঁর মায়ের ভালবাসার মধ্যকার চিরন্তন সংঘাতকে মর্মভেদী রূপে ফুটিয়ে তোলা হয়। বহু সমালোচক, যাঁদের মধ্যে মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটক অন্যতম, ছবিটিকে সত্যজিতের প্রথম ছবিটির চেয়েও ওপরে স্থান দেন। ‘অপরাজিত’ ভেনিসে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার জেতে। অপু-ত্রয়ী শেষ করার আগে সত্যজিৎ আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ সমাপ্ত করেন। প্রথমটি ছিল ‘পরশ পাথর’ নামের একটি হাস্যরসাত্মক ছবি। আর পরেরটি ছিল জমিদারী প্রথার অবক্ষয়ের ওপর নির্মিত ‘জলসাঘর’, যেটিকে তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সত্যজিৎ অপরাজিত নির্মাণের সময় একটি ত্রয়ী সম্পন্ন করার কথা ভাবেননি, কিন্তু ভেনিসে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা শুনে তাঁর মাথায় এটি বাস্তবায়নের ধারণা আসে। অপু সিরিজের শেষ ছবি ‘অপুর সংসার’ ১৯৫৯ সালে নির্মাণ করা হয়। আগের দুটি ছবির মত এটিকেও বহু সমালোচক সিরিজের সেরা ছবি হিসেবে আখ্যা দেন (রবিন উড, অপর্ণা সেন)। এ ছবির মাধ্যমেই সত্যজিতের দুই প্রিয় অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুরের চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ছবিটিতে অপুকে দেখানো হয় কলকাতার এক জীর্ণ বাড়িতে প্রায়-দরিদ্র অবস্থায় বসবাস করতে। এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অপর্ণার সাথে অপুর বিয়ে হয়। তাদের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্যতে “বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ছবিটির ধ্রুপদী ইতিবাচকতা ফুটে ওঠে”, কিন্তু শীঘ্রই এক বিয়োগান্তক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। একজন বাঙালি সমালোচক অপুর সংসার-এর একটি কঠোর সমালোচনা লেখেন, এবং সত্যজিৎ এর উত্তরে ছবিটির পক্ষে একটি সুলিখিত নিবন্ধ লেখেন – যা ছিল সত্যজিতের কর্মজীবনে একটি দুর্লভ ঘটনা (সত্যজিতের প্রত্যুত্তরের এরকম ঘটনা আরেকবার ঘটে তাঁর পছন্দের চারুলতা ছবিটি নিয়ে)।
তখন ‘অপুর সংসার’ তৈরির প্রস্তুতি চলছে। সিনেমায় নবাগত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অপু-চরিত্র এবং অপু-অপর্ণার সম্পর্ক নিয়ে অনবরত আলোচনা করতেন সত্যজিৎ রায়, একটি নোটও লিখে দিয়েছিলেন তাঁকে, তাতে এক জায়গায় ছিল: ‘‘কলকাতায় এসে কিছুদিনের মধ্যে অবিশ্যি অপর্ণা অপুকে আরও ভালভাবে চিনেছে…অপর্ণা এখন অপুকে মানুষ হিসেবেই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, hero হিসেবে নয়। অপুর দিক থেকে অবিশ্যি…বিয়ের পরে দিনে দিনে অপর্ণার প্রতি তার ভালবাসা ও admiration বেড়েছে। সে বুঝেছে যে কোনও কোনও ব্যাপারে অপর্ণা তার থেকেও বেশি mature।’’ (প্রবন্ধ সংগ্রহ, আনন্দ)। লিখেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও: ‘‘আজ এটুকু বলতে পারি, ‘অপু’র একটা হয়ে-ওঠা ছিল। এবং সেই হয়ে-ওঠার মধ্যে ছিল এক কালজয়ী প্রতিভার স্পর্শ। মানিকদা। সত্যজিৎ রায়।… দুটি ফুলস্ক্যাপ পাতায় নিজের হাতে লিখলেন, ‘অপু’ চরিত্রটি সম্পর্কে ওঁর ভাবনা। মানিকদার স্বভাবসিদ্ধ ডিটেল-এর ছোঁয়া সেখানেও।’’ (গদ্যসংগ্রহ ১, দে’জ)। ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৯-এর ১ মে।
তথ্যসূত্র:
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯শে অক্টোবর ২০১৮ সাল
লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।
বাহ