পুরোটাই বিতর্কিত

লেখক: শমীক জয় সেনগুপ্ত

মানুষের জীবনে তার সব থেকে বড় শক্তি ও দুর্বলতা হল তার কথা। বলতেই বলে -– মানুষের কথায় জয়, মানুষের কথায় ক্ষয়। আর বর্তমান সময়ে ভাষার অপপ্রয়োগ সে কথার সত্যতাকে চূড়ান্তভাবে স্বীকৃত করে চলেছে। যেদিকেই চোখ যায়, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না-করেই এই অপশব্দের ব্যবহার শুধু যে চোখ ও মনকে বাধিত করছে এমনটা নয়, বরং এ ভীষণভাবেই এক সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকে আমাদের চালিত করছে। ২০২০; সালটা এমনিতে বিষে বিশে নীল। মার্চের পর থেকে প্রতিটি বাড়িই এক একটি ক্ষুদ্র কারাগার হয়ে উঠেছে, যেখানে একটা আংশিক ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গরূপেই অভিশপ্ত জীবন আমাদের গ্রাস করছে। শাপের মধ্যে বরদান লুকিয়ে থাকে শুনেছি। এক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সদ্ব্যবহার করে সকলেই সময় নির্বাহের জন্য অনেক কিছু করলেও ফলপ্রসূ কোনও কাজ চোখে পড়ছে না। বরং শিক্ষার পলেস্তরা খসিয়ে ভিতরের অশিক্ষিত, অমার্জিত এবং অন্যকে টেনে নামানোর খেলায় মেতে থাকা সস্তার জনপ্রিয়তাকামী মনোভাব বহুক্ষেত্রে এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে মনকে ক্রমশ শাসন করি যাতে ও-সব দিকে চোখ না যায়।

অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তাল ভারতবর্ষে নেপোটিজম শব্দের গায়ে আঘাত করার একটা তুমূল হিড়িক দেখলাম। মৃত্যু জিনিসটির প্রতি একটা চরম টান আমার ছেলেবেলা থেকেই আছে। এবং এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এত কুযুক্তি ও বিপক্ষের আত্মরক্ষায় অবতীর্ণ সওয়াল-জবাব এখন দৈনিকের কাটতি বাড়িয়েছে। ঠিকই আছে, করোনায় যখন সংক্রমণের দিক থেকে ভারত একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যুর হার গোপন করা হচ্ছে, সঞ্চয় শেষের পথে, আমাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবি, ফ্রিলান্সার প্রায় সবার পেটে জি.ডি.পির লাথি পড়লেও “জনতা জানতি চায় রেহার কি হৈবো”। সুশান্তের খুনি হিসেবে সন্দেহভাজন তালিকায় থাকা রেহার কী হবে তা নিয়ে বোধহয় খুব একটা মাথা ব্যথা কারো নেই। মহেশ ভাটের সঙ্গে ভাটের সম্পর্কতে মশলা কত আর কতটা টক ঝাল নোনতা, জনতার জিজ্ঞাসা সেখানেই আটকে গেছে। এবং তারপর একজন মহানুভব নেটিজেন বাঙালি মেয়েদের ডাইনি, কালাজাদুর অধিষ্ঠাত্রী ইত্যাদি প্রভৃতি দেগে দিয়ে নিজের মায়ের গর্ভকে আরো একবার কালিমালিপ্ত করে শুরু করলো গালিগালাজ। একই সঙ্গে আরো কিছু সুবিধাবাদী সমব্যথীর ছদ্মবেশে এই মৃত্যুর মুনাফা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো মিডিয়ার সামনে। এখন তো এই মৃত্যু সংক্রান্ত খবর দেখলেই মনটা কেমন করে উঠছে। চ্যানেল, লিংক, পাতা পাল্টাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে আমার বাঙালি মনে সুশান্তের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি “দিল বেচারা”র উদ্দেশ্যে একটা কথা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে। একটা নেপোটিজম ওখানেও দেখলাম, প্রোমো, ট্রেলার জুড়ে। আসলে বাঙালির মেধা, মনন ও প্রতিভার প্রতি অনেকেরই জাতিগত ঈর্ষা আছে। থাকা উচিত নয়। তাও আছে। তাই রাজনৈতিক নেতা থেকে, অভিনেত্‌ নির্মাতাদেরও এই তালিকায় রাখতেই পারা যায়। সিনেমার রিভিউ আমি করছি না, কিন্তু পুরো সিনেমা জুড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে নিজেদের স্বকীয় ছাপ ছেড়ে যাওয়ার পরও সিনেমার প্রোমোতে বা ট্রেলারে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় অনুপস্থিত।

আসলে এই বাঙালি বিদ্বেষটাও মানুষের মনে স্লো পয়জেনি,-এর মতো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ যুক্তিবাদী বাঙালির মনে ধর্ম ও রাজনীতির নাম করে মব লিঞ্চিং, মানুষ খুন, স্বৈরাচার এগুলো করা যায় না। জনৈক এক দলীয় মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারি দুদিন আগেই হেঁকে ডেকে ডিক্লেয়ার করলেন যে বাংলা ভাষা কোনও ধ্রুপদী ভাষা নয় । এখন কলপারের ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না তবে যে যে কথাগুলো এই অর্ধ বা অশিক্ষিত মানুষটিকে ও তার সম-মনভাবাপন্ন সমর্থকদের জানাতে চাইবো তা হল বাংলা ভাষার উদ্ভব সম্পর্কিত কিছু তথ্য। জানি না মোটা মাথায় এসব ঢুকবে কিনা, তবে আশা করবো জ্ঞান তো মানুষের চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে, অন্ধকার সরিয়ে দেয়, সেই আশা থেকেই চাই এরাও আলোকিত হোক। ভাষাচার্য ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে বাংলাদেশে আর্যভাষার প্রবেশের পূর্বে সবাই অস্ট্রিক ও কোল জাতীয় ভাষায় কথা বলতো। এবং বলা ভালো যে সব মানুষ নিজেকে উপরে বসিয়ে অন্যকে হেয় করে তাদের কাছে এই ভাষার গুরুত্ব নেই। কিন্তু প্রাচীনত্বই যদি ধ্রুপদী হওয়ার মূল কথা হয় তবে ২০০০ খৃস্টপূর্বাব্দ সময়ে যখন আর্য অনুপ্রবেশ ঘটে ও তারপর দুই সংস্কৃতি ও কৃষ্টির মেলবন্ধন শুরু হয় সেখান থেকেই অন্যান্য জাতির মতোই বাঙালি জাতিরও উদ্ভব ঘটে। ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক হলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন মহারাজা। তারপর পালবংশর চারশো বছরের শাসনের পর সেনবংশ, এভাবেই বাংলা এগিয়েছে। বাংলা এমন এক অঞ্চল যেখানে বাইরে থেকে আসা মানুষজন অনায়াসে মিলে মিশে যায়। এখানে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানটা খুব সহজেই হয়। পালবংশের সময় বাংলা সাহিত্যের আদিকাব্য চর্যাপদ রচিত হয়।

এই ইতিহাসটাকে একটু এক পেশে করে ভারতীয় আর্যভাষার বিভাগটা নিয়ে কথা বলি। আর্যভাষা তিনপ্রকার –-

· প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা
· মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা
· নব্য ভারতীয় আর্যভাষা

এই ভাষার সঙ্গে সমান্তরালভাবে চলতে থাকে প্রাকৃতভাষা। যার বিভাগগুলো অনেকটা এইরকম-

§ মাগধী প্রাকৃত
§ মহারষ্ট্রী প্রাকৃত
§ শৌরসেনী প্রাকৃত এবং
§ পৈশাচী প্রাকৃত

এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে ভাষার দুটি ধারাই একে অপরের সঙ্গে কালের নিয়মে সম্পৃক্ত, শব্দ ও সংস্কৃতির দিক থেকে পৃথক হয়েও তারা ভাষা প্রবাহে একে অপরের হাত ধরে, তাই মিশেল ওখানেই শুরু হয়ে যায়। বাংলার উদ্ভব হয় মাগধী প্রাকৃত ও তার অপভ্রংশ থেকে। হিন্দির উদ্ভব হয় শৌরসেনী প্রাকৃত এবং তার অপভ্রংশ ভাষা থেকে। এই বিবর্তনের ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে শুধু বাংলার নয় হিন্দির ধ্রুপদী হওয়াটাও প্রশ্নচিহ্নের সামনে চলে আসবে। আর তরুণজ্যোতি তিওয়ারির এ কথা হয়তো জানা নেই বর্তমান এই ভাষায় তথাকথিত আর্যছাপ পাওয়া দুষ্কর কারণ এতে মিশেছে আরবী, ফার্সি, ও আরো বিভিন্ন ভাষার মিশেল। দেবনগরী হরফ ব্যবহার করাটাই একটা ভাষার ধ্রুপদীয়ানার বেঞ্চমার্ক হয় তবে তো বলতেই হয় ধ্রুপদীয়ানা সম্পর্কেও ওর ধারণা নেই। এত অস্পষ্ট চিন্তাধারা নিয়ে এরা কী করে জনগণের উন্নতিসাধন করবে সেটাই বড় প্রশ্ন।

আর রাজনীতির ময়দানে এইধরনের ভাষা সংক্রমণের পূর্বের নেতারাও করেছে এবং আশঙ্কা করি পরবর্তীরাও করবে। এদের না আছে শেখার আগ্রহ, না আছে বাক ও যাপনে সংযম, এবং জীবনবোধ-এর ঝুলিটা শূন্য।

ঠিক যেমন গরুর দুধে সোনা, বা এই কুশল শাসকের শাসনকালেই ভারত আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে ইত্যাদি তো ছিলই; এর মধ্যেই যুক্ত হয়েছে বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্যের বচন ও ন্যাক্কারজনক কাজকর্ম। ভুবনডাঙার মেলার মাঠ বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংযুক্ত মানুষজনেরই নয়, শান্তিনিকেতনের সব আশ্রমিকদের ও বাংলার সব রবীন্দ্র অনুরাগীদের কাছেই বিশেষ ভালো লাগার জায়গা। সেই মেলার মাঠ ঘেরা হচ্ছে। এর পিছনের রাজনৈতিক অভিসন্ধি, ঘাত অন্তর্ঘাত তাদের যদি কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে দেই, তাহলেও বলবো শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্ত্তীর মতো এত অসংলগ্ন স্টেটমেন্ট দেওয়া উপাচার্য শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে কি আগে কেউ দেখেছেন?

শান্তিনিকেতনের জমিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বহিরাগত বলে শ্রী বিদ্যুৎ চক্রবর্ত্তী তার কোনও ধী শক্তির পরিচয় দিলেন সেটা বুঝলাম না এবং একই সঙ্গে রবীন্দ্রভাবনায়, তাঁর আদর্শের ওপর নিজের চিন্তাধারা চাপিয়ে বিশ্বভারতীর চিরাচরিত রীতির ও অন্যান্য আশ্রমিক, প্রাক্তণী ও বর্তমানে সংযুক্ত মানুষজনের ভাবাবেগ নিয়ে খেলা করে উনি ঠিক কতটা লাভবান হলেন, সেটাও খতিয়ে দেখার। একজন শিক্ষকের আনুগত্য কেবলমাত্র শিক্ষার প্রতি হওয়া উচিত, কিন্তু পাওয়ার ও পাইয়ে দেওয়ার খেলায় আখের গোছাতে আসা লোকজনেদের কাছে এত এক সহজলভ্য আয়ের পথ।

আর এই যে লুজ টক দেখে দেখে বিরক্ত হচ্ছেন, রাগ করছেন এ সবই পূর্বপরিকল্পিত। আসলে মানুষজনকে তাদের লক্ষ্যচ্যুত করার ক্ষেত্রে এই অসংলগ্ন কথাগুলোর অবদান অনেক বেশি। মিম ট্রোল এই সব নিয়ে সাধারণ মানুষজন যখন সময় কাটাবার একটা অছিলা খুঁজে পায় তখনই নাকের তলা দিয়ে দেখবেন একটা একটা করে সরকারি সংস্থা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকে সুদের হার কম, যে চাকরিটা চারবছর ধরে করছেন এক নোটিসে তা খুইয়ে গৃহবন্দি হচ্ছেন এবং এ সবের মাঝে আটকে পড়ে কোনদিন দেখবেন আপনার দেশ আর আপনার নেই। আপনার ঠাঁইও হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে।


লেখক পরিচিতি: শমীক জয় সেনগুপ্ত 

জন্মদিন: ৯ই অক্টোবর ১৯৮৬ (বাংলা ২২শে আশ্বিন ১৩৯৩)। বাবা : শ্রীযুক্ত অভিজিৎ সেনগুপ্ত। মা : স্বর্গীয়া কেতকী সেনগুপ্ত। শিক্ষা: ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। লেখালিখি শুরু ১৯৯৪ সাল থেকে কচিকাঁচা সবুজ সাথী পত্রিকার শিশু বিভাগে। ৯০-এর দশকের কনিষ্ঠতম কবিদের মধ্যে একজন হলেও নিজেকে লিটিল ম্যাগাজিন কর্মী বলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। বারো বছরের মতো সময়কাল ধরে শমীক জয় সেনগুপ্তর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়ে আসছে সপ্তপর্ণ পত্রিকা। সপ্তপর্ণ পত্রিকা ও অভিজয় প্রকাশনীর প্রাণপুরুষ শমীককে বাংলা সাহিত্যে আরও একটি বিশেষ কারণে মনে রাখার কারণ হচ্ছে সারা বাংলা জুড়ে জেলা ভিত্তিকভাবে লিটিল ম্যাগাজিন সম্মান ও সাহিত্যের বিশেষ কিছু শাখার জন্য অভিজয় সাহিত্য সম্মানের জন্য। লিটিল ম্যাগাজিনের সাথে সাথেই কলকাতা ক্যুইয়ার মুভমেন্ট ও অ্যান্টি ৩৭৭ আন্দোলনে শমীক জয় সেনগুপ্ত অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ। 
প্রকাশিত বই: নদীর কাছে ওরা ক'জন (২০১৬) পকেট ফুল অফ জয় (২০১৭) পুরাবর্ত্ম (২০১৭) 
পুরস্কার ও সম্মান: কচিকাঁচা সবুজ সাথী শিশু সাহিত্য সম্মান(১৯৯৬), সরলাবালা বিশ্বাস স্মৃতি সম্মান (১৯৯৯) ও চুণী কোটাল সম্মান (২০১৭)
শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।