লেখক: মিজানুর রহমান সেখ
একজন গড়পড়তা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কঙ্কালে সাধারণত ২০৬টি অস্থি বা হাড় থাকে। কঙ্কালের গঠন প্রত্যেকের শরীরের সম্পূর্ণ আকার প্রদানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। হাড় সব জায়গায় সমান মজবুত হয় না, তবে একটি শক্তপোক্ত খাঁচা তৈরি করে এবং এর মধ্যে আবদ্ধ বিভিন্ন খনিজ,মজ্জা,রক্তরস ইত্যাদি নিয়ে কঙ্কালতন্ত্র গঠিত। হাড় গুলোর অনন্য সৃষ্টি এবং নকশা, হালকা ওজন সত্ত্বেও দেহকে তুলনামূলকভাবে মজবুত এবং শক্তিশালী করে তোলে। হাড়ের ম্যাট্রিক্সটির অনেকাংশ স্থিতিস্থাপক কোলাজেন তন্তু দ্বারা গঠিত, যাদের ওসেইন বলা হয় এবং বাকিটা গ্রাউন্ড সাবস্টেন্স । হাড়ের ৯৯% ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় ক্যালসিয়াম ফসফেট, ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সিঅ্যাপাটাইট (Ca10(PO4)6(OH)2) নামের রাসায়নিক যৌগে। অস্টিওব্লাস্টস এবং অস্টিওক্লাস্টস নামে পরিচিত হাড়ের বিশেষ কোষগুলি দ্বারা দেহের হাড় সারা জীবন সক্রিয়ভাবে নির্মিত এবং পুনর্নির্মিত হয়। যে কোনও একটি হাড়ের মধ্যে মূলত দুরকম প্রধান প্যাটার্নে হাড়ের কার্যকরী গড়ন(structure) থাকে, এদের নাম কর্টিকাল এবং ক্যান্সেলাস হাড়। এদের প্রতিটির ভিন্ন ভিন্ন চেহারা এবং বৈশিষ্ট্য আছে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ হাড়কে সুস্থ রাখে। শরীরের বেশিরভাগ ক্যালসিয়াম হাড়ে জমা থাকে। এ ছাড়া হাড় সুস্থ রাখতে সাহায্য করে ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি । দুধ জাতীয় খাদ্য থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। আবার খাদ্য থেকে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন-ডি’র প্রয়োজন।
নিম্নলিখিত বিষয়গুলো কঙ্কাল তন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে-
জিনগত কারণ: বংশগতি যেকোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা রোগে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিভাবক বা পরিবারে কারও হাড়ের সমস্যা থাকলে সন্তানেরও সেই সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ জিনগত ভাবে অনেকের হাড় শক্ত হয় আবার অনেকের দূর্বল হয়।
খাদ্যাভ্যাস: শক্তিশালী ও মজবুত হাড়ের জন্য শরীরের পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম,ফরফরাস ও ভিটামিন-ডি প্রয়োজন। অতিরিক্ত ধূমপান এবং মদ্যপান সহ অন্যান্য নেশা হাড়ের ক্ষয় বাড়িয়ে দেয়।
কর্মময় জীবন: নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর চর্চা এবং কায়িক পরিশ্রম হাড়কে শক্ত করে।
বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ক্ষয়ও বাড়তে থাকা স্বাভাবিক ঘটনা। খাদ্যের মাত্র ২৫% ক্যালসিয়াম বিশোষিত হয় বাকিটা বর্জিত হয়। শিশুরা বেশি ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে তেমনই বার্ধক্যে এই শোষণ করার ক্ষমতা খুব কমে যায় । মেনোপোজের পর অনেকেরই হাড়ের সমস্যা বাড়তে থাকে।
শারীরিক গঠন: শারীরিক গঠন ও খাদ্যের চাহিদা অস্থির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। রুগ্ন শরীর এবং বয়স ও উচ্চতার তুলনায় কম ওজন, হাড়ের সমস্যার অন্যতম কারণ।
অস্থি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা:
হাড়ের অপুষ্টির জন্য শিশুদের রিকেট রোগের কথা অনেকেরই জানা আছে, একই কারণে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের রিকেট’ বা অস্টিওম্যালেশসিয়া রোগ হয়। বৃদ্ধ বয়সে অনেকের হাড়ে ছিদ্র হওয়ার ফলে হাড় নরম ও দুর্বল হয়ে যায় এবং অল্প আঘাতেই ভেঙে যায়। একে বলে অস্টিওপোরোসিস। অস্টিওম্যালেশসিয়া হওয়ার মূল কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের হাড় থেকে ক্যালসিয়াম ফসফেট দ্রবীভূত হয়ে রক্তের মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত হয়ে যায়। ফলে মেরুদন্ড ও পায়ের হাড় বেঁকে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন হাড়ে ব্যাথা,হাড় নরম হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদি নানান সমস্যা দেখা দেয়। শিশুদের ক্যালসিয়াম,ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি এর অভাবে রিকেট রোগ হয়। এই রোগ হল হাত ও পায়ের লম্বা হাড় বেঁকে যাওয়ায় হাঁটা চলা,দৌড় ঝাঁপ করতে সমস্যা দেখা যায়। শক্তির অভাব হয়,দাঁত উঠতে দেরি হয়। অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত বৃদ্ধদের অস্থির ঘনত্ব কমে যাওয়ায় প্রায় হাড় ভাঙে এবং জোড়া লাগতে সময় লাগে। বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে ব্যাথা বেদনা দেখা যায়। হাড়ের বিকৃতি,হাড়ের দূর্বলতা,বক্ষ গহ্বরটি পায়রার বুকের মতো হয়ে যাওয়া,পা ও মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়া ইত্যাদি নানান সমস্যার মূল কারণ শরীরে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সালফার ও ভিটামিন ডি এর অতিমাত্রায় অভাব।
প্রতিকার:
অস্থির গঠনগত উপাদান তৈরিতে সাহায্য করে যে সমস্ত মৌল ও ভিটামিন- সেগুলো বেশি বেশি করে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকাতে রাখতে হবে। মাছের তেল ভিটামিন ডি এর সবচেয়ে ভালো উৎস। সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি শরীরে সংশ্লেষিত হয় বলে একে ‘sunshine vitamin’ও বলে। এছাড়া কর্ড,হ্যালিবাট ইত্যাদি মাছের যকৃতের তেল, দুধ ও দুগ্ধ জাত মাখন,ঘি ইত্যাদি থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের এবং প্রাক বিদ্যালয়ের শিশুদের ভিটামিন ডি এর চাহিদা সর্বাধিক। ভিটামিন ডি এর উপস্থিতিতেই ক্যালসিয়াম শোষণ হয়। গুঁড়ো দুধ, খোসাশুদ্ধ তিলদানা, ছোট চুনো ও শুটকি মাছ ক্যালসিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। এছাড়া রাগি, দুধ,শাকপাতা,কাঁটা সমেত মাছ,মাংসের নরম হাড় ইত্যাদিতে যথেষ্ট ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। আবার প্রোটিনবহুল ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্যে যথেষ্ট ফসফরাস থাকে। ডিম,দুধ, মাছ,মাংস,পোল্ট্রি ফসফরাসের উৎকৃষ্ট উৎস। গোটা দানাশস্য এবং আটাতে প্রচুর ফসফরাস থাকে। সুস্থ সবল অস্থি ও মজবুত দাঁতের জন্য অল্প বয়স থেকেই এই সমস্ত খাদ্য বেশি করে খাওয়া উচিত। এখানে মনে রাখা দরকার বয়স বাড়লে ক্যালসিয়াম,ফসফরাস ও ভিটামিন ডি যুক্ত খাদ্য পর্যাপ্ত খেলেও শরীরের শোষণ ক্ষমতা কিন্তু কমে যায়।
তথ্য সূত্র :
1)https://www.spine-health.com/glossary/cortical-bone
2)https://www.webmd.com/diet/supplement-guide-vitamin-d
3)https://www.healthline.com/nutrition/build-healthy-bones
লেখকের কথা: মিজানুর রহমান সেখ
মিজানুর পেশায় শিক্ষক এবং একজন সমাজসেবক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যই মূলত লেখালিখি। লেখক পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স।