বেতার পুরুষ – শেষ পর্ব

লেখক: রানা চক্রবর্তী

বেতার পুরুষ – প্রথম পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন

বেতারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তবে রেডিয়ো-নাটকের তিনি ছিলেন অবিসংবাদী পথিকৃৎ। রঙ্গমঞ্চে অভিনীত গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শচীন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ নাট্যকারের বিখ্যাত নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে। অনেক নাটক পেশাদারি মঞ্চের চেয়েও বেতারে বেশি সফল হয়েছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ডাকেই তখনকার রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত শিল্পীরা নাটক করেছিলেন বেতারে। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’। বিকাশ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘মাইক্রোফোনের সঙ্গে দোস্তি ছিল বীরেন ভদ্রের। ওঁর যে কোনও অনুষ্ঠান হাঁ করে শুনতাম। মনে হত, শ্রোতাদের সঙ্গে খেলা করছেন।’’

সম্ভবত ১৯৩২ সাল। জামাইষষ্ঠীর দিনে অভিনয়ের জন্য একটি প্রহসন লিখলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। যে দিন অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে, সেদিন চার-পাঁচটি গান রচনা করে তাতে সুর বসিয়ে গানগুলো কুশীলবদের তুলিয়ে দিলেন তিনি। সন্ধ্যেবেলা বেতারস্থ হল ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’। শ্রোতাদের অনুরোধে অনেক বার প্রচার করা হয়েছে প্রহসনটি। তবে এই অনুষ্ঠানটি শুরুর পিছনেও একটি ঘটনা আছে। নৃপেন মজুমদার, জামাইষষ্ঠীর দিনে অভিনয় করার জন্য এক ভদ্রলোককে একটি প্রহসন লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। ‘আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি’ করে প্রায় দিন পনেরো পেরিয়ে গেল। নাটক আর লেখা হয় না। এ দিকে জামাইষষ্ঠী এসে পড়ল বলে। শেষমেশ ঠিক আগের দিন, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ প্রহসনটি লিখতে বসেন। মাত্র একদিনে একটি বই শুধু লিখে ফেলেননি তিনি, যেদিন সন্ধ্যায় নাটকটি অভিনীত হবে সেদিন চার-পাঁচটি গান লিখে, নিজে সুর দিয়ে কুশীলবদের শিখিয়েও দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর প্রযোজিত নাটকের মধ্যে অন্যতম ডি. এল রায়ের ‘সাজাহান’, শচীন সেনগুপ্তের ‘প্রলয়’।

১৯৩১-এর ৮ মে বেতারে অভিনীত হল ডি এল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটক। সে এক মনে রাখার মতো ঘটনা! বীরেন্দ্রকৃষ্ণ (আওরঙজেব),অহীন্দ্র চৌধুরী (সাজাহান), দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (দারা), নিভাননী (জাহানারা), মিস বীণাপাণি (পিয়ারী)। সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শচীন সেনগুপ্ত প্রমুখ দিকপাল নাট্যকারদের বহু নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণর প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে। অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, সরযূবালা দেবীকে দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ অভিনয় করালেও শিশির কুমার ভাদুড়ী বেতারে নাটক করতে চাননি সেটা বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কথা থেকেই জানা যায়। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ জানিয়েছিলেন, “শিশির ভাদুড়ী মাইক্রোফোনের সামনে এসে কেবলই এদিক-ওদিক হাত পা নেড়ে অভিনয় করতে চাইতেন। পরে নাকি বলেছিলেন, ধূর রেডিয়োয় আমি গিয়ে কী করব? সব কেমন বন্ধ, বন্ধ! আমার কিছুই করার নেই!”

রেডিয়োতে তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হয় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (দ্বিজেন্দ্রলাল), ‘প্রলয়’(শচীন সেনগুপ্ত), ‘প্রফুল্ল’(গিরিশচন্দ্র ঘোষ)-র মতো নাটক।
শ্রী নলিনীকান্ত সরকারের স্মৃতিচারণেও বীরেন্দ্র কৃষ্ণ কে নিয়ে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্যে, “বর্ষাকাল। বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে বেতারের কেউই বেরোতে পারেনি। সন্ধ্যা নাগাদ বৃষ্টির তোড় আরও বাড়ল। রেডিয়োটা চালালাম। বীরেন্দ্র ভদ্রের কণ্ঠে ঘোষণা। বললেন, ‘এ বার একটু পিয়ানো শুনুন’। বুঝতে পারলাম, প্রথম আর্টিস্ট আসেননি। পিয়ানো বাজিয়ে অভাব পূরণ করলেন বীরেন্দ্র ভদ্র। দ্বিতীয় আর্টিস্টও অনুপস্থিত। বীরেন্দ্র ভদ্র ঘোষণা করলেন এ বার রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাহুল্য এ বার গায়কও বীরেন্দ্র ভদ্র।”

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রসবোধের গুণে তাঁর অনুষ্ঠানগুলি শ্রোতাদের কাছে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। এমনই একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল শ্রোতাদের চিঠিপত্রের উত্তরদানের অনুষ্ঠান: ‘সবিনয় নিবেদন’। এক বার এক শ্রোতা চিঠি লিখলেন, রেডিয়োয় কীর্তনের অনুষ্ঠান কেন কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে। সেই শ্রোতার মতে, কীর্তন যে ধর্মসাধনার অঙ্গ। তার উত্তরে সবিনয় নিবেদনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘‘দেখুন, আমাদের হরেক শ্রোতার মন জুগিয়ে চলতে হয়। শ্রোতারাই চিঠিতে নানা রকম অবাক্যি-কুবাক্যি বলে আমাদের কীর্তন কমাতে বাধ্য করেছেন। এক শ্রোতা কী লিখেছেন জানেন? সকাল, বিকেল, রাত্তির— যখন রেডিয়ো খুলি, খালি কীর্তন আর কীর্তন। শ্রোতাদের বাড়িগুলোকে যে আপনারা শ্রাদ্ধবাড়ি করে তুললেন!’’ বেতারকেন্দ্রের ক্যান্টিনে বসে ছোট-বড় সকলের সঙ্গেই গল্প জমিয়ে দিতে পারতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেখানে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। তবে কাজের সময়ে গল্প জুড়লে যত রথী-মহারথীই হোন, তাঁকে নিষেধ করতেও পিছপা হতেন না। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব।

বীরেন্দ্র কৃষ্ণের অসম্ভব রকমের এই সব ক্ষমতার জন্য বহু গুণিজন তাঁকে বেশ মান্যি করতেন। একবার জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় অল্প টাকা পাওয়ার জন্য স্থির করেছিলেন রেডিয়োতে আর অভিনয় করবেন না। তখন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ তাঁকে ডেকে ধমকে বললেন, “তুমি কি রেডিয়োতে টাকা রোজগার করতে এসেছ?” ওই এক কথাতেই কাজ হল। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় আর কোনও উচ্চবাচ্চ্য করেননি। রেডিয়োর প্রতি বীরেন্দ্র কৃষ্ণের অমন টান দেখে তিনি আবার রেডিয়োয় চলে আসেন।

১৯৪১ সালের ৭ অগস্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর অত্যন্ত খারাপ। স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির দিকে। স্টেশন ডিরেক্টরের নির্দেশ, সকাল থেকে প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর কবির খবর শ্রোতাদের কাছে জানাতে হবে। নলিনীকান্ত সরকার গেলেন জোড়াসাঁকো। সেখান থেকে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ফোন করে পাঠালেন কবির খবর। আর সেই সূত্র ধরে রেডিয়ো অফিস থেকে পনেরো মিনিট অন্তর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঘোষণা চলল দুপুর পর্যন্ত। বেলা বারোটা তেরো মিনিটে বিশ্বকবি অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, শ্মশানক্ষেত্র থেকে অনুষ্ঠানাদি রিলে করা হবে। কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষযাত্রার ধারাবিবরণী রেডিয়োয় সেই প্রথম। এর পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখের অন্তিমযাত্রার বিবরণও দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এক সময়ে নিমতলা ঘাট থেকে প্রতিমা বিসর্জনের ধারাবিবরণীও দিয়েছেন নিয়মিত।

ক্রিকেট-ফুটবল খেলার ধারাবিবরণীও প্রথম শোনা গিয়েছে তাঁরই কণ্ঠে। তবে ফুটবল খেলাটা প্রথম দিকে একেবারে জানতেন না। তবু চলে গেলেন মাঠে। খেলার নিয়ম না জানায় কৌতুককর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হল। যেমন, এক বার দলের গোলের সামনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। তবে গোলকিপার কোনও ক্রমে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ উত্তেজনায় বলে উঠলেন, ‘‘এই রে হ্যান্ডবল হয়েছে, হ্যান্ডবল হয়েছে।’’ পাশ থেকে তখন কেউ তাঁকে শুধরে দিলেন। আর এক বার গোল হয়েছে, তিনি তা জানাতেই ভুলে গেলেন।

বেতার কেন্দ্রের বাইরেও তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে, গ্রামোফোন রেকর্ডে, ছায়াছবিতে আর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখিতেও তিনি ছিলেন অনন্য বিস্ময়। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম অভিষেক রঙমহলে ‘অভিষেক’ নাটকে (১৯৩৭)। ১৯৪৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ওই বছর মিনার্ভায় প্রথম বার মঞ্চস্থ হল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ নাটক। নামভূমিকায় অভিনয় করলেন কমল মিত্র আর প্রধান স্ত্রী চরিত্রে সরযূবালা দেবী। ১৯৫৮ সালে বীরেন ভদ্রের পরিচালনায় ‘মায়ামৃগ’ নাটকে প্রথম বার মঞ্চে অভিনয় করলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি যেতাম। উনি আমাকে আকাশবাণীতে বীরেনদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কী জানি, আমাকে দেখে ওঁর কী মনে হয়েছিল! বলেছিলেন, তুমি পারবে। মঞ্চে অভিনয়, বেতারে কণ্ঠস্বর মডিউলেশন সব কিছুই ওঁর কাছে শেখা। আমাকে বলতেন, নিজে মেকআপ করবে। কারও উপরে নির্ভর করে থাকবে না। অভিনয় জগতে চলতে হলে কার সঙ্গে কী ভাবে মিশতে হবে, সেটাও উনি বলে দিয়েছিলেন।’’ তবে বিশ্বজিতের আক্ষেপ, ‘‘উনি যখন মারা যান, কেউ আমাকে জানায়নি। আমি তখন বম্বেতে কাজ করছি। জানার পরে খুব কেঁদেছিলাম।’’

বেতারে ‘রূপ ও রঙ্গ’র আসরে ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে নিজের লেখা কৌতুক-নকশা পরিবেশন করেছিলেন বীরেন। ‘বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট’, ‘বিরূপাক্ষের বিষম বিপদ’, ‘বিরূপাক্ষের অযাচিত উপদেশ’ বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।

রেডিয়ো ছাড়া তো তখন অন্য কোনও বিনোদন মানুষের ছিল না। আর রেডিয়োয় তখন থিয়েটারের ভূত চেপেছিল যেন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণও সেই পথে হেঁটেছিলেন। কিন্তু তাঁকে একেবারে নতুন করে সব কিছু করতে হয়েছিল। তাঁর সামনে তো কোনও কাঠামো ছিল না। কাজ করতে করতে তাঁকে খুঁজে বার করতে হয়েছিল রেডিয়ো নাটকের নিজস্ব ভাষা। কেমন করে পাতা ওল্টাতে হবে, যাতে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ না শোনা যায়। সংলাপ বলার সময় চোরা দম কেমন করে নিতে হয়। শুধু কণ্ঠস্বর দিয়ে রাগ, দুঃখ, ভালবাসা সমস্তই প্রকাশ করতে হয় কেমন করে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে কেমন করে মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে সংলাপ বলতে হয়। কাউকে শিক্ষা দেওয়াতে তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। কখনও ধমকাতেন, কখনও ভালবাসতেন, কেউ তাঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন না।

চলচ্চিত্র জগতেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৪৩ সালে ‘স্বামীর ঘর’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেন। কয়েকটি ছবিতে চিত্রনাট্যও লিখেছেন, ‘মা অন্নপূর্ণা’ (১৯৫৪, পরিচালনা হরি ভঞ্জ), ‘সতীর দেহত্যাগ’ (১৯৫৪, পরিচালনা মানু সেন), ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ (১৯৫৮, পরিচালনা নারায়ণ ঘোষ)। তাঁর নিজের লেখা দু’টি নাটক ‘ব্ল্যাক আউট’, ‘৪৯ নম্বর মেস’ও মঞ্চসফল হয়েছিল।

এত বর্ণময় ও ব্যস্ত কর্মজীবনের চাপে বাড়িতে সে ভাবে সময় দিতে পারতেন না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার কথায়, ‘‘তা নিয়ে মায়েরও কোনও দিন অভিযোগ ছিল না। আমরাও কিছু বলিনি। এমনও হয়েছে, রাত দুটোয় বাবা ফিরেছেন। পাড়ার ছেলেরা আবার এসে ধরে নিয়ে গেল ওঁকে। উনি না গেলে তাঁরা নাকি মার খাবে।’’ আর কথা দিয়ে কথার খেলাপ করার মানুষ তিনি ছিলেন না।

খাওয়াদাওয়া নিয়েও বিশেষ ফরমায়েশ ছিল না। তাঁর কন্যা সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘খাবারে ঝাল আর নুন কম বেশি হলে বাবা বুঝতেন। রাতে ঘন দুধ চাইতেন।’’ সাধারণত অনুষ্ঠান বাড়িতে সব শেষেই আসতেন। তবে সেজ মেয়ের বিয়েতে রাত দশটায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখনও বরযাত্রী আসেনি। এ দিকে সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘বাবার চিন্তা, জমাদাররা অনেকক্ষণ বসে আছে। ওদের খাইয়ে আগে বাড়ি পাঠিয়ে দাও!’’

বেতারে আক্ষরিক অর্থে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু বেতার কি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে? তখন স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন-গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা ছিল না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে অবসর নিলেন। রবীন্দ্র ভারতীতে বেতার-নাটক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলেন কিছু দিন। শিল্পী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে কলকাতা ও অন্যত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাভারত বিষয়ে পাঠ-গান করতেন। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন, এমনকি প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতেন!
স্টাফ আর্টিস্ট হয়েই অবসর নিয়েছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। পেনশন জোটেনি। আসলে আখের গোছানোর কথা কখনও তো ভাবেননি। অবসরের পরে, শেষ পর্যন্ত ‘মহাভারতের কথা’ বলার জন্য ক’টা টাকা পেতেন। ক্রমশ স্মৃতিভ্রংশ হয়ে আসছিল। তাতে অস্বস্তিতে পড়ছিলেন তখনকার প্রোগ্রাম অফিসার। সেই অনুষ্ঠানও আর করানো গেল না! তখন অর্থাভাব মেটাতে পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে বেড়াতে লাগলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেখান থেকেও যে বেশি কিছু পেতেন, তা’ও নয়। সামান্য কিছু জুটত।

রেডিয়ো-র মস্ত দায় বয়ে বেড়িয়েছেন চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত। অথচ এমন মানুষকেও বারবার অপমানের মুখে পড়তে হয়েছে! এমন একটি ঘটনার কথা তাঁকে চিনতেন ও জানতেন, বেতার জগতের সাথে যুক্ত মানুষের স্মৃতিতে ভেসে আসে। সেবার, অবসর নেওয়ার পর রেডিয়ো-য় কি একটা কাজে এসেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলেন। সিংহ নামের একজন সিকিউরিটি গার্ড তাঁর কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসলেন। সেদিন মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল তাঁর, থরথর করে কেঁপে উঠেছিলেন, ফর্সা চেহারায় শিরাগুলো দপদপ করে উঠেছিল। তিনি কেবলই চিৎকার করে বলেছিলেন, “জন্ম দিয়েছি রেডিয়োকে আমি! জন্ম দিয়েছি! আমিই জন্ম দিয়েছি! আমার কাছে পাস চাইছ? পাস?” যাঁরা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁদের মনে হয়েছিল এ শুধু চিৎকার করে ক্ষোভ উগরে দেওয়া নয়, এর গভীরে কি লুকিয়ে আছে কান্নাও? এই দৃশ্য আজও অনেকেই কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারেন না।

যে স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর গর্ব, আশির দশকের প্রথম থেকেই তা লুপ্ত হওয়ার নানা উপসর্গ দেখা যেতে লাগল। রবীন্দ্রসদনে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পৌরোহিত্যে। বক্তৃতায় সকলকে হতচকিত করে বলে উঠলেন, ‘কে এই সঞ্জীব চাটুজ্জে, একে তো চিনি না।’ কিছুক্ষণ পরে সংবর্ধনায় পাওয়া উপহার সামগ্রী যখন সঞ্জীববাবু মঞ্চেই তুলে দিলেন বীরেনবাবুর হাতে, তখন সঞ্জীববাবুর হাত ধরে সে কি আকুল কান্না তাঁর! স্ত্রী মারা যাওয়ার মাস সাতেকের মধ্যে শরীরের আরও অবনতি হয়। সুজাতাদেবী জানিয়েছিলেন, ‘‘তখন প্রায়ই বাবা বলতেন, তোমাদের মা অনেক দিন এই ঘরে আসেন না। এক দিন ওকে আসতে বলো।’’

বড় অভিমান ছিল তাঁর। মুখে কিছু বলতেন না। আকাশবাণীর এমেরিটাস প্রোডিউসার-এর মতো সম্মাননার পদ জোটেনি তাঁর। বলতে গেলে কিছুই মেলেনি, না কোনও সরকারি খেতাব, না পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ। মিলেছে তো কেবল গুচ্ছের চাদর আর উত্তরীয়!

৭ নম্বর রামধন মিত্র লেন।
হাতিবাগান পাড়ার শ্যামপুকুর স্ট্রিট। টাউন স্কুলের পাশে সেই গলি ধরে একটু এগোলোই রামধন মিত্র লেন। সে-রাস্তায় আখাম্বা লম্বা হলদে রঙের সাত নম্বর বাড়িটি নিজেই আস্ত একটা ইতিহাস! পাথরের ফলকে লেখা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর নাম। আর মহিষাসুরমর্দিনী তথা বাংলা সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের কথা। তিনি আমৃত্যু ছিলেন এই বাড়ির বাসিন্দা। হলদে বাড়ির বিরাট ফটকের কাঠের দরজা পার হলেই উঠোন ঘেরা ঠাকুরদালান। শ্যাওলা ধরা বিষণ্ণ ঠাকুরদালানে কি চণ্ডীপাঠ করেছিলেন বাঙালির চিরকালের বীরেন ভদ্র?

ডান হাতে ঠাকুরদালান রেখে বাঁ-হাতের কাঠের সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়েই এক সবুজ দরজার তালাবন্ধ ঘর। কে আসেননি ওই ঘরে? বিংশ শতকের নাট্য জগতের নট-নটীর কতজনই তো এই ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন। আজ আর কেউ সে ঘর খুলতে চান না! রাস্তার দিকের খড়খড়ির একটি খোলা জানলা অবশ্য চিনিয়ে দেয় ওই ঘরের আলো-আঁধারির রহস্য। চোখে পড়ে দেওয়ালের দিকের একটি সরু খাট। চেয়ার আর আলমারি। আসবাব বলতে ওইটুকুই। কিন্তু বইগুলো সব গেল কোথায়? যত দিন মানসিক আর শারীরিক সামর্থ্য ছিল প্রাণে ধরে বইগুলো কাউকে তো দিতেন না বীরেন ভদ্র। বইই তো ছিল তাঁর আত্মার আত্মীয়। “অগুনতি বই! কে পড়বে? কোথায় রাখব? কারও সময় নেই। কিছু দিয়ে দিয়েছি আমরা, কিছু কোথায় চলে গেছে।” বলেছেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্যা সুজাতা ভদ্র।
ঘর পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে কোথাও রবীন্দ্রনাথ, তো কোথাও লাল জবা গলায় কালীঠাকুরের ছবি। সিঁড়ি ধরে সোজা তিনতলার ডান হাতের ঘর। সিঁড়ির শব্দ যেন মনে করিয়ে দেয় ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে, চপ্পল পায়ের এক ছায়াকে! এই যেন আকাশবাণী থেকে নিজের ঘরে ফিরলেন তিনি।
ঘরজোড়া বিশাল খাট। তাঁর বিয়ের খাট। এই খাটে বসেই কি আবৃত্তি করেছেন ‘দেবতার গ্রাস’? ঘরে অনেকগুলো জানলা যা দিয়ে আকাশ ঢুকেছে। ঘরের কোণে ছড়িয়ে আছে ভাদ্রের হলদে রঙের পুজো-রোদ্দুর। ঘর থেকে দেখা যায় ছোট্ট ছাদ। ঠাকুমা যোগমায়া দেবী কোনও এক অলস দুপুরে তাঁর স্নেহের বুশিকে (ডাকনাম) শোনাচ্ছেন শেক্সপিয়ার, গিরিশ ঘোষের নাটক…। “চশমা, কলম সবই তো নিয়ে গেছে মিডিয়ার লোক। আমাদের তো কিছুই নেই!” হতাশ গলায় এক সংবাদপত্রের সাংবাদিক কে জানিয়েছিলেন সুজাতা ভদ্র। তাঁর ঘরে পা দিলে হঠাৎ মনে হতে পারে যে কে যেন বলে উঠলেন, “বছরের শুধু এই সময়েই মনে পড়ে? সারা বছর তো কেউ ফিরেও তাকায় না। যত্তো সব!”

১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর অমৃতলোকে যাত্রা করেন ‘বেতার পুরুষ’।
শেষ বয়সের অনেক সাক্ষাৎকারেই বারবার ঠিকরে বেরিয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হতাশা, অভিমান, ‘‘ভাবতেই পারিনি সবাই আমাকে ভুলে যাবে…’’ তবে নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘‘আমাকে ভুলে গেলেও বছরে এক বার সেই দিনটিতে স্মরণ করবেই করবে। তাতেই আমার তৃপ্তি।’’

সত্যি! বেতার তাঁকে যদি বা ভোলে, বাঙালি তাঁকে আজও ভোলেনি। আজও মহালয়ার দিন ভেসে আসে “রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি”…
কণ্ঠ ভেসে আসে মুখ, দেখা যায় না…
তিনি নাম নয়, চেহারা নয়, আস্ত একটা কণ্ঠ, দিগন্ত ছোঁওয়া আকাশ… তিনি ‘বেতার পুরুষ’ শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।


তথ্যসূত্র:
1. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল
2. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই অক্টোবর ২০১৫ সাল
3. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই অক্টোবর ২০১৮ সাল


লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।