বেতার পুরুষ – প্রথম পর্ব

লেখক: রানা চক্রবর্তী

‘‘বীরেনদার কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। দয়া করে ওঁকে বলবেন।’’
মার্জনা চাইছেন মহানায়ক উত্তমকুমার। দুর্গতির জন্য।
দুর্গতি মানে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌’, মহালয়ার দিন আকাশবাণীর এক বিশেষ অনুষ্ঠান, যা প্রচারিত হয়েছিল চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বদলে। ১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার দিন। ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠল সেই চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নয়, ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌’৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সেই এক মহালয়াতেই বাতিল হয়েছিল। এসেছিল ওই নতুন অনুষ্ঠান। যার প্রধান ভাষ্যপাঠক ছিলেন উত্তমকুমার।

কিন্তু কী ছিল সেই ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌’? স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অসীমা ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, অপর্ণা সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষ্যপাঠে ছিলেন উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

যে ঐতিহ্য সেই প্রথম বারের জন্য ছিন্ন হল সেই ঐতিহ্যটি এক বার ফিরে না দেখলে বোঝা যাবে না এই পরিবর্তনের গুরুত্ব। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-বাণীকুমারের যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাঙালির ঘরে ঘরে মহালয়ার সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে স্রষ্টা হিসেবে প্রধানত তিন জনের নাম জড়িয়ে আছে। বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু সেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র নাম প্রথম থেকেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ছিল না। বাণীকুমারের লেখা থেকেই তার ইতিহাসটা পড়া যাক: “১৯৩০-এর ১লা এপ্রিল সরকারী পরিচালনাধীনে এসে ভারতীয় বেতারের নতুন নামকরণ হলো ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। কলকাতা বেতার প্রতিষ্ঠানে স্বভাবতই তাই জেগে উঠলো জনচিত্তের পরে আকর্ষণী-শক্তি সবিশেষ বিস্তার করবার অদম্য উৎসাহ। চললো নব নব অনুষ্ঠান-সম্ভার সাজাবার অক্লান্ত আয়োজন। এরই ফলে জন্ম নিলো ‘বেতার বিচিত্রা’। সাধারণত সংগীত-বহুল অনুষ্ঠানই বৈচিত্র্যে অধিক আদরণীয় ছিলো। সেই সূত্রে শ্রীশ্রী মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি চম্পূ রচনা করি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছর চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারিত হয় ‘বসন্তেশ্বরী'”

এই বসন্তেশ্বরীর পরে ১৯৩২ সালেরই মহাষষ্ঠীর প্রভাতে বাণীকুমারের লেখা আর একটি গীতি-আলেখ্য প্রচারিত হয়, যার বিষয় ছিল মহিষাসুর বধ। তখন তার নাম ছিল ‘শারদীয় বন্দনা’। তারই ভাষ্যকে এর পরে আরও পরিমার্জিত করে ১৯৩৪ সালের ৮ই অক্টোবর, মহালয়ার দিন সকালে প্রচারের ব্যবস্থা হয়। আর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রথম শোনা যায় ১৯৩৬ সালে। সেই প্রথম মহিষাসুরমর্দিনী কিন্তু মহালয়ায় নয়, মহাষষ্ঠীর দিন প্রচারিত হয়েছিল। পরে তার প্রচারসময় স্থির হয় মহালয়ার দিন সকালে। কিন্তু সেই প্রথম প্রচারের প্রস্তুতি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কলমে ভীষণ আকর্ষক: ‘‘পঙ্কজ সুর তুলে ও সুরারোপ করে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে গান তোলাতে লাগলেন। রাইচাঁদও এক বিরাট অর্কেস্ট্রা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। সেকালের সবচেয়ে বড় বাজিয়েরা গানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন।’’

এ হেন মহাযজ্ঞ যে মহিষাসুরমর্দিনী চল্লিশ বছর ধরে আকাশবাণীতে হয়ে আসছিল, যার প্রতিটি সম্প্রচারের দিন আকাশবাণীতে উপস্থিত থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, সেই অনুষ্ঠান না বাজিয়ে নতুন অনুষ্ঠান বাজানোর নির্দেশ এসেছিল দিল্লি থেকে। কিন্তু শ্রোতাদের প্রবল আপত্তিতে পরের বছর থেকেই ফিরে আসে মহিষাসুরমর্দিনী। প্রবল আপত্তি মানে অজস্র চিঠি, টেলিফোন।

১৯৭৬ সাল। আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ। পরিবর্তিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান। নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়োয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। এবং চূড়ান্ত ফ্লপ। সমালোচনার ঝড় উঠল। বেতার অফিস ভাঙচুর হল। অফিসের সামনে লোকে গালিগালাজ করতে লাগল। অনেকের এমনও মনে হয়েছিল যে মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! এ বার বুঝি অমঙ্গল কিছু ঘটবে!

উত্তমকুমার কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও অযোগ্যতার কথাও বলেছিলেন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহই দিয়েছিলেন। সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে তিনি শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে তিনি নাকি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, “লোকে যদি নেয় নিক।” এ কথা জানা যায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পুত্র প্রদ্যোৎকুমার ভদ্রের কাছ থেকে।

বেতার কর্তৃপক্ষ একেবারে গোপনে তাঁকে কিছু না জানিয়ে এই নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করায় তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?”

মহিষাসুরমর্দিনী না-বাজানো সম্পর্কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বক্তব্য ছিল, “আমি তো অমর নই, একদিন না একদিন অন্যদের তো এগিয়ে আসতেই হবে এ কাজে।”

কিন্তু এ কথা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি বছর মহালয়াতে বাঙালির ভোর হয় মহিষাসুরমর্দিনী দিয়েই। আর সেই অনুষ্ঠান বাঙালির চিরকালের ঠাকুরঘরই। ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’-এর অশেষ দুর্গতি-র পরে দুর্গতির কারণ বলতে গিয়ে উত্তমকুমার যে নিজেই বলেছিলেন, ‘‘ঠাকুর ঘরকে রিনোভেট করে ড্রয়িং রুম বানালে যা হয়, তাই-ই হয়েছে।’’

বহু মানুষের চাহিদায় সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। আশ্চর্যের কথা হল, এই সম্প্রচার হবে শুনে অভিমান, ক্ষোভ সব ভুলে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ পুনরায় কাজে নেমে পড়েছিলেন। প্রথম দিকে টেপরেকর্ডিং করা অনুষ্ঠানের চল হয়নি। আকাশবাণী-তে সব অনুষ্ঠানই হত লাইভ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা অনেকেই আগে মহড়ার জন্য চলে আসতেন বেতারে। মহড়ার অবসরে চলত চা-পান, রঙ্গরসিকতা।

একদিন, যথারীতি কেউ আড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তো কেউ বা ঘুরছেন এদিক-সেদিক। বাণীকুমার বসে আছেন রেকর্ডিং-এ। ও দিনের আগে ভাষ্য অংশ পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে। হঠাৎই অলস রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের অনুকরণে বলতে শুরু করলেন। তাতে চারিদিকে বেশ একটা মৃদু হাসির ভাব জাগল। …কিন্তু বাণীকুমার দ্রুত রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আরে আরে থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল! হোক! হোক না ওই ভাবেই…।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে বললেন, “আরে না না একটু মজা করছিলাম!” কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন,“মোটেই না! দারুণ হচ্ছিল! ওইভাবেই আবার করো তো।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আবার শুরু করলেন, “দেবী প্রসন্ন হলেন…।”

সেদিনই বাংলার ইতিহাসে সংযুক্ত হল এক নতুন মাত্রা। অন্য ধারায় মহালয়ার পাঠ। দুর্গাপুজোর কার্টেন রেজার! এক হলদে রঙের রোদ্দুরে মায়া যেন! শরৎ এসে হাজির হয় পুজোর আকাশে। অনেকের বাড়িতে এক সময় রেডিয়ো এসেছিল মহালয়ার আগমনী হিসেবেই, আর এই রেডিয়ো বলতে আমরা বুঝতাম তখন ওই মানুষটিকে। যাঁর নাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

দেশে-বিদেশে মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, অথচ তিনি কিন্তু সে সবে বিন্দুমাত্র সাড়া দিতেন না। বলতেন, “বেশ মজা আর কি, পুরাণ পড়ব না, চণ্ডীপাঠ করব না, শুধু বৈঠকখানায় বসে স্টিরিয়োতে মহিষাসুরমর্দিনী শুনে কর্তব্যকার্য শেষ। কাজীদা (নজরুল) হলে কী বলতেন জানো? বলতেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, যত্তোসব!”

শরতের পুজো, পুজোর কলকাতা, কলকাতার বেতার, বেতারের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র! ইনি এমন এক বাঙালি, যাঁর অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। এই অনুষ্ঠানের এতটাই জনপ্রিয়তা যে, তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা মিথ। অনেকেই বলেন, চণ্ডীপাঠের আগে স্নান করে পট্টবস্ত্র পরে পুরোহিতের সাজে বসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তবে তাঁর কন্যা সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘বাবাকে কখনও ঠাকুরকে একটা ধূপও দিতে দেখিনি। অনুষ্ঠানের দিন বিয়ের জোড়টা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।’’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠের গাম্ভীর্যে মুখরিত হয়ে ওঠে মহালয়ার আধো ঘুমে-আধো জেগে থাকা পাড়া। বাঙালির ক্লিন্ন মনে সঞ্চারিত হয় ভাবরস। তখন কারও মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে মায়ের মৃন্ময়ী রূপ, কারও চোখে ভাসে তাঁর ইষ্ট দেবতা, কেউ বা হয়তো দেখতে পান তাঁর হারানো প্রিয়জনকে। ‘‘আমরা চার বোন ছাদে বসে তখন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতাম। হিম পড়ত। তাই গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে নিতাম। মন দিয়ে শুনলে দেখবেন, শুনতে শুনতে চোখে জল চলে আসে…’’ কথাগুলোর বক্তা ছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুজাতা।

কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালির মাতৃ-আবাহনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকে সে যাত্রাপথের শুরু। ‘বেতার জগৎ’ বিক্রি থেকে বেতারের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছনোর দীর্ঘ পথেই কেটেছে তাঁর জীবনের আলো-ছায়া। ঘর নয়, কাজই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের প্রিয় সঙ্গী। তবু অবসরের পরে তেমন আর্থিক সুবিধে পাননি। আক্ষেপ করেছেন, দুঃখ পেয়েছেন। তবু বেতারের সঙ্গ ছাড়েননি।

১৯০৫ সালের ৪ঠা অগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। বাবা কালীকৃষ্ণ ভদ্র এবং মা সরলাসুন্দরী দেবী। রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে আসেন খুবই ছোট বয়সে। বাড়িটি কিনেছিলেন তাঁর ঠাকুমা। তাঁর উপার্জিত অর্থে। পঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানির প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সময়ের নিরিখে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম পাঠ বীরেন্দ্রর। বাড়ির কাছেই তেলিপাড়া লেনে কয়েক জন ছাত্রকে নিয়ে একটি প্রাইভেট স্কুল শুরু করেছিলেন রাজেন্দ্রনাথ দে। তিনি সাত্ত্বিক মানুষ, মাছ-মাংস খেতেন না। ছোট্ট বীরেনকে খুব স্নেহ করতেন। ওঁর বাড়িতেই দশ বছর বয়সে প্রথম চণ্ডীপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এর পরে টাউন স্কুলে ভর্তি হন। তবে রাজেনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগে ছেদ পড়েনি।

অঙ্কে মন ছিল না বীরেন্দ্রর। ম্যাট্রিক পাশ করেই জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটিগণিতের যত বই ছিল, সব গঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এত দিনের বোঝা লঘু করতে পেরে সে কী আনন্দ! তবে ছোটবেলা থেকেই স্মৃতিশক্তি প্রখর। ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। এক বার রাজেনবাবু এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বীরেনের নাম লিখিয়ে দেন। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ ছিল আবৃত্তির বিষয়। মাঝে মাঝেই তাগাদা দিতেন, মুখস্থ কত দূর হয়েছে জানার জন্য। তবে ‘আজ করছি, কাল করছি’ বলে বীরেন কাটিয়ে দিতেন। প্রতিযোগিতার তিন-চার দিন আগে হুঁশ হল ছেলের। চল্লিশ পাতার কবিতা মুখস্থ করতে হবে। আত্মবিশ্বাস ছিল একটু বেশি। শিখেও ফেললেন নির্দিষ্ট দিনের আগেই। প্রতিযোগিতায় দু’-চার পৃষ্ঠা বলার পরেই থামতে বলা হয় বীরেনকে। তবে তাঁর উচ্চারণ শুনেই হোক বা মুখস্থ শক্তির পারদর্শিতা দেখে— এক বিচারক আরও কিছুটা অংশ শোনাতে বলেন তাঁকে। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন বীরেন।

স্কুলে দুষ্টুমিও ছিল তাঁর অভিনব। এক বার নকল টিকি চুলের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন। আর গরু লেজ দিয়ে যে ভাবে মাছি তাড়ায়, সে ভাবেই ছটফট করছিলেন ক্লাসে। বাকি ছাত্ররা হেসে লুটোপুটি। কিন্তু স্যারের চোখে পড়তেই সমূহ বিপদ। বেশ কয়েকটা চড়-চাপড় খেতে হয়েছিল তাঁকে। আবার ক্লাসে নতুন কেউ এলে ল্যাং মেরে ফেলেও দিতেন।

তবে খেলাধুলোয় একেবারেই উৎসাহ পেতেন না কিশোর বীরেন। সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, টেনিস… কিছুতেই না। নিজেই লিখেছেন, ‘‘ঘুড়ি পর্যন্ত ওড়াতে গিয়ে দেখেছি আমি অন্য কারও ঘুড়ি কাটতে পারতুম না। এক বার ফুটবল খেলতে গিয়েছিলুম গড়ের মাঠে। বাবা বললেন, ও সব খেলাটেলা ছেড়ে দাও। ব্যস, সেখানেই ওই খেলাতেও ইতি।’’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পাঠরত। ১৯২৭ সালের ২৬ অগস্ট ডালহৌসির এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে বোম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে। এর আগেও কলকাতায় ছোট ছোট দু’টি বেতারকেন্দ্র ছিল। তবে শ্রোতাদের মধ্যে সে ভাবে আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি। ‘চিত্রা সংসদ’ নামে একটি ক্লাবের সদস্য ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। গান-বাজনা, অভিনয়ের চর্চা হত সেখানে। সেই দলেই ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার), পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, সত্য দত্ত, বিজন বসু প্রমুখ। নাট্য পরিচালনার সূত্রে আলাপ হয় মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে, যিনি পরে ‘চিত্রগুপ্ত’ নামে লিখতেন। বীরেন্দ্র তাঁকেও নিয়ে এলেন ওই ক্লাবে।
নতুন স্থাপিত বেতারকেন্দ্রের ভারতীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হল নৃপেন মজুমদারের কাঁধে। সহকারী হিসেবে রইলেন রাইচাঁদ বড়াল ও রাজেন্দ্রনাথ সেন। বেতারের নিজস্ব নাটকের দল থাকলেও বাইরের কয়েকটি দলও তখন রেডিয়োয় অনুষ্ঠান করত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও চিত্রা সংসদের অন্যরা ভাবলেন, তাঁরাও তো একটা নাটক করতে পারেন। পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ দিয়ে যোগাযোগ করলেন রেডিয়োর সঙ্গে। নৃপেনবাবু রাজি হলেন। ১৯২৮ সালের ২১ অগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিচালনায় রেডিয়োয় পরিবেশিত হল সেই নাটক। অংশগ্রহণে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাকিরা। কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম যোগাযোগ।
১৯২৮ সালে বিএ পাশ করে বাবার এক বন্ধুর সুপারিশে যোগ দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিনের বিরতি বা বিকেলের অবসরে চলে আসতেন রেডিয়োয়। যেখানেই যেতেন, আসর জমিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে নৃপেনবাবু তাঁকে আহ্বান জানালেন। চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন রেডিয়োয় ১৯২৮ এর শেষের দিকে।

১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু করলেন ‘মহিলা মজলিশ’। রেডিয়োর প্রথা ভেঙে একেবারে অন্য রাস্তায় হেঁটেছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। মহিলাদের জন্য ‘মহিলা মজলিস’ আরম্ভ করেছিলেন ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে। পরে যদিও তিনি ‘শ্রীবিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে অনুষ্ঠান প্রচার করেন। তিনি এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। ভগিনী নিবেদিতা, সাবিত্রী, দ্রৌপদী, বিজ্ঞানের নানা খবর, সাহিত্যে নারীদের স্থান, ইউরোপের নারীদের কথা… এমন নানা বিষয়ে আলোচনা হত সেখানে। শ্রোতাদের চিঠিপত্র পড়ে শোনাতেন। পিয়ানো বাজাতেন। মহিলাদের মতামত চাওয়া হলেও বলে দেওয়া হত, মহিলারা যেন ব্যক্তিগত কথা জানিয়ে পত্র না লেখেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে এই অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক ওঠে। মহিলাদের কী করা উচিত, বলা উচিত তা বিষ্ণুশর্মা কেন ঠিক করে দেবেন? অননুকরণীয় বাগ্মিতায় অল্প সময়ের মধ্যেই মহিলামহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন বীরেন্দ্র। বহু লোক সে সময় রেডিয়ো স্টেশনে এসে বিষ্ণুশর্মাকে দেখতে চাইতেন। কিন্তু বিষ্ণুশর্মারূপী বীরেন্দ্র ভদ্র আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে অধরাই ছিলেন।
ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে পাক্ষিক পত্র হিসেবে প্রকাশিত হল বেতারকেন্দ্রের মুখপত্র ‘বেতার জগৎ।’ সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। পরে সেই দায়িত্ব পেলেন নলিনীকান্ত সরকার। সম্পাদনার কাজেও বীরেন্দ্রর উৎসাহ ছিল অগাধ। সালটা ১৯৩৬। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষের অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ বেতার জগৎ বেরোনোর কথা ২৫ জানুয়ারি। ঠিক তার চার দিন আগে মারা গেলেন সম্রাট পঞ্চম জর্জ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলে নলিনীকান্ত ঠিক করলেন, সংখ্যাটি পঞ্চম জর্জ সংখ্যা রূপে প্রকাশ পাবে। বীরেন্দ্র ছুটলেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে (এখনকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি)। পঞ্চম জর্জ সম্পর্কিত দু’টি মোটা মোটা বই এনে তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ লিখে ফেললেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংখ্যা।

১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে প্রথম বার প্রচারিত হয় বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ তবে ১৯৩১ সালে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে প্রথম বার শোনা গিয়েছিল সেই অনুষ্ঠান, যেখানে বাণীকুমার শ্রীশ্রী চণ্ডীর কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করেন। শ্রোতাদের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয় সেটি। তখনই সকলে ভাবেন, ষষ্ঠীর সকালে এমন একটি অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়! সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’ নাট্য রচনাশৈলী অনুসরণে নতুন ভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন করলেন বাণীকুমার। কয়েকটি গানে সুরযোজনা করেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র ও রাইচাঁদ আর অধিকাংশ গানে পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনায় ও শ্লোক আবৃত্তিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।

‘‘বীরেন জেঠা কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেন না। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আটটা-ন’টা নাগাদ শতরঞ্চি আর বালিশ নিয়ে চলে যেতেন বেতারকেন্দ্রে। বাবাকে গাড়ি নিতে আসত রাত দুটো নাগাদ।’’ বক্তা বাণীকুমারের বড় ছেলে নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য। ‘‘বীরেন জেঠা বাবাকে ডাকতেন ‘বোদে’ বলে। সকলের সামনে অবশ্য ‘বাণী’ বলতেন। কায়স্থ ঘরের ছেলে হয়ে চণ্ডীপাঠ করবেন, এতে কর্তৃপক্ষও ভয় পেয়েছিলেন। তবে বাবা বলেছিলেন, এটা শুধু বীরেনই করতে পারে। ও-ই করবে।’’ আরও জানিয়েছিলেন নৃসিংহবাবু।

অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আবেগকম্পিত কণ্ঠে একটু সুর জড়িয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে উঠলেন—‘‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…’’ পঙ্কজ মল্লিক হাত নেড়ে ইশারায় জানিয়ে দিলেন, “ঠিক আছে, চালিয়ে যাও”। সেই হল শুরু…প্রথম কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করলেন যুগ্ম ভাবে রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিক। পরে একক ভাবে পঙ্কজ মল্লিক। পরবর্তী কালে অনুষ্ঠানে কিছু পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হয়। গানের শিল্পীও বদলায়। তবে গ্রন্থনা ও আবৃত্তির শিল্পী ছিলেন অপরিবর্তিত। ‘‘অনুষ্ঠানের পরে বীরেন জেঠার অন্য রূপ। প্রাণখোলা, হাসিখুশি। সারা পাঞ্জাবিতে লেগে থাকত নস্যি। আর কাউকে সামনে পেলেই তাঁর জামায় নস্যি লাগিয়ে দিতেন,’’ জানিয়েছিলেন নৃসিংহবাবু। স্মৃতিচারণায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ লিখেছেন, ‘‘দু’টি জিনিসের নেশা ছিল। নস্যি আর থিয়েটারে অভিনয়।’’


বেতার পুরুষ – শেষ পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন


তথ্যসূত্র:
1. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল
2. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই অক্টোবর ২০১৫ সাল
3. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই অক্টোবর ২০১৮ সা


লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।