লেখক: মিজানুর রহমান সেখ
ভাতের চাল যদি কালো হয় কার সেই ভাত খেতে ইচ্ছে হবে! কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো এই কালো চালের ভাত সাধারণ মানুষ কে খেতেই দেওয়া হতো না। অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্য। ওরাইজা সাটিভা (Oryza sativa L.) নামের কালো, আঠালো, বাদামের স্বাদযুক্ত ভীষণ পুষ্টিকর চালকে একসময় নিষিদ্ধ চাল (Forbidden Rice) বলা হতো। ইতিহাসের পাতা উলটে জানা যায় এক সময় চিনের সম্রাটদের জন্যই কেবল সংরক্ষিত ছিল এই চাল। সম্রাটদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু নিশ্চিত করতে এই চাল খাওয়ার নির্দেশ ছিল এবং সেকারণে সাধারণ জনগণের জন্য এই চাল নিষিদ্ধ ছিল। এই কালো চালের জনপ্রিয়তা এতোটাই ছিল যে একে ‘সম্রাটের চাল’ (Emperor Rice)ও বলা হতো।
স্বাভাবিক চাল, বাদামী চাল, লাল চাল ও কালো চাল – এই চার রকমের চালের মধ্যে কালো চালের গুণাগুণ আধুনিক পুষ্টিবিদদের নজর কেড়েছে। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম পরিচিতি লাভ শুরু করে কালো চাল। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে যেমন-চিন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে এই চালের চাষ উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এই চালের বহিরাংশে আন্তসায়ানিন (anthocyanin) বেশি মাত্রায় উপস্থিত থাকায় চালের রঙ কালো হয় যা আবার কালা4 জিন( kala4 gene) দ্বারা সক্রিয় থাকে।
কৃষিবিজ্ঞানীরা চার রকমের কালো চালের খোঁজ পেয়েছেন। এগুলো হলো:
- ব্ল্যাক জাপনিকা চাল
- ব্ল্যাক গ্লুটিনউস চাল
- ইতালিয়ান কালো চাল
- থাই ব্ল্যাক জেসমিন চাল
অর্ধেক পেয়ালা রান্না করা কালো চালের পুষ্টিমূল্য বিচার করলে দেখা যায় এতে প্রায় ১৬০ কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায় এবং শর্করা থাকে ৩৪ গ্রাম, ফ্যাট ১.৫ গ্রাম, ডায়েটারি ফাইবার ২ গ্রাম, প্রোটিন ৫ গ্রাম ও আয়রন ৪%ডিভি । এই বিশ্লেষণ থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে কালো চাল এমনি চালের তুলনায় অনেক বেশি উপকারী ও স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। বিশেষত তুলনামূলক বিচারে আন্তসায়ানিন, প্রোটিন ও ফাইবার অন্য সব প্রকার চালের থেকেই কালো চালে বেশি আছে।
কালো চালের বহুমুখী উপকারিতা আছে। এই চালে আন্টিঅক্সিডেন্ট প্রচুর থাকায় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ত্বক পরিষ্কার করে ও শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে শরীরকে ফুরফুরে রাখে। কালো চাল শরীরের প্রদাহ (Inflammation) কমায় ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। এতে থাকা ফাইবার হার্টকে সুস্থ রাখে। গবেষণায় জানা গেছে কালো চাল নিয়মিত খেলে সংবহন তন্ত্রে এথেরসক্লেরোটিক প্লাক তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে শিরা ধমনীর ভিতরে ফ্যাট জমে না ও রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। এমনকি এই চাল ক্যান্সারও প্রতিরোধ করে। এতে থাকা আন্তসায়ানিন শরীরে জৈবরসায়নিক বিক্রিয়ায় ছাড়া পাওয়া মুক্ত মূলকের (free radicals) সংখ্যা কমায়। এই মুক্ত মূলক শরীরে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। কালো চাল হজমে সাহায্য করে । এই চালে প্রচুর বি- ভিটামিন থাকায় মানসিক চাপ কমায় ও স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে।
কালো চাল খুবই উপকারী খাদ্য যার উপর আরো গবেষণার প্রয়োজন এবং সাধারণ জনগণ যাতে এই চাল ব্যবহার করতে পারে তাই এই ধানের চাষ বাড়াতে হবে। যেহেতু মাঝারি দানার এই চালের কেজি প্রতি দাম ১২০-২০০ টাকা তাই রোজ সম্ভব নাহলেও মাঝে মধ্যে খাওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র:
1. U.K.S Kushwaha, “Black Rice: Research, History and Development”, Springer International Publishing (publisher), e-book-ISBN : 978-3-319-30153-2, pp. 21-190, DOI: 10.1007/978-3-319-30153-2, 2016.
2. Soma Saha , “Black rice the new age super food”, Amrican International Journal of Research in formal applied & natural Sciences,16-322,PP-51-5,2016.
3. Pratiwi R., Purwestri Y.A. Black rice as a functional food in Indonesia. Functional Foods in Health and Disease ,7(3): 182-194,2017.
4. Ling, Wen Hua, et al. “Red and black rice decrease atherosclerotic plaque formation and increase antioxidant status in rabbits.” The Journal of nutrition131.5 : 1421-1426,2001.
লেখকের কথা: মিজানুর রহমান সেখ
মিজানুর পেশায় শিক্ষক এবং একজন সমাজসেবক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যই মূলত লেখালিখি। লেখক পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স।
আপনার লেখা খুব ভালো লাগে। বাংলায় বিজ্ঞানের প্রচার করতে থাকুন।
প্রথমেই বলি, এটা আমার কাছে নতুন তথ্য–ফলে লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্ত, ফেরবুকে “কালো চাল” বিষয়ে সন্ধান করতে গিয়ে একাধিক এই বিষয়ে তথ্য পেলাম, যেমন –কৃষি টিউব, কুমিল্লার কালো চাল, ইত্যাদি। লেখক যদি এগুলির সূত্র পরে সংযোজন করে দেন, তাহলে বর্তমান রচনাটি আরও তথ্যসমৃদ্ধ হয়।
প্রসঙ্গতঃ জানাই, আমি যখন ১৯৭১-৭২ সালে মহারাষ্ট্রের গোনদিয়াতে (তখন ছিলো ভান্ডারা জেলার একটি তহসীল, এখন এক স্বতন্ত্র জেলা) আয়কর অধিকারী হিসেবে ছিলাম, সে সময়ে সেখানে এবং গোনদিয়া-সংলগ্ন কয়েকটি গ্ৰামে কালো ধান দেখেছি–অত্যন্ত দামী এবং অতি সুগন্ধি চাল তার। এককালে এম এ পড়ার সময়ে এগ্ৰিকালচারাল ইকোনমিক্স পড়তে হয়েছিল বলে, এবং জন্মসূত্রে কৃষিপ্রধান বর্ধমানের মানুষ হিসেবেও, এটি আমার কাছে তখন খুব একটা বড়ো খবর ছিলো। জানিনা, এখনও গোনদিয় বা ঐ অঞ্চলে এই কালো ধানের চাষ হয় কিনা।
লেখক একটু পরিশ্রম করে এবিষয়ে আরও তথ্যাদি সংগ্ৰহ করলে ভালো হয়। একথা অবশ্য প্রমাণিত যে, বাংলাদেশে এই কালো চালের চাষ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনেককাল আগে থেকেই চলছে।
আপনাদের ধন্যবাদ।চেষ্টা করব আরও তথ্য সমৃদ্ধ লেখা দিতে।