লেখক: মিজানুর রহমান সেখ
ভারতবর্ষের মতোই সারা পৃথিবীর জুড়ে সমুদ্র তীরবর্তী ভূভাগে প্রচুর নারকেল গাছ জন্মায়। এটা এমনএকটা গাছ যার প্রতিটি অংশ জনজীবনে কোনো-না কোনোভাবে কাজে আসে। এ গাছের পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় সব কিছুই বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কাঁচামাল তৈরিতে কাজে লাগে। এছাড়া হরেকরকম মুখরোচক নানা পদের খাবার তৈরিতে, পুষ্টিতে সমৃদ্ধ সুস্বাদু পানীয় ও রোগীর পথ্য হিসাবে — নানাক্ষেত্রে নারকেল ব্যবহৃত হয় । এটি পৃথিবীর ‘স্বর্গীয় গাছ’ হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত ও সুপরিচিত। নারকেলের আদিস্থান প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ। এসব স্থান থেকেই পরবর্তীতে শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া গিনি, ওশেনিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ঘানাসহ পৃথিবীর প্রায় ৯৩টা দেশে এর বিস্তার ঘটে। তবে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস এবং ভারত নারকেল উৎপাদনে এগিয়ে।
নারকেল একদিকে যেমন পিঠেপুলি থেকে শুরু করে নানান সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়, তেমনই ভীষণ উপকারী পানীয় হিসাবে প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি সবুজ নারকেল (green coconut) বা ডাব সমানভাবে জনপ্রিয়। বিজ্ঞাপনের প্রচার আলো থেকে অনেক দূরে থাকলেও ডাবের জল পুষ্টিবিদদের নজর কিন্তু এড়ায়নি। কারণ কোনোরকম রাসায়নিকবিহীন এই পানীয় একশো শতাংশ খাঁটি। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন শুধু গ্রীষ্ম নয়, সারা বছর নিয়মিতভাবে কচিডাবের জল পান করলে শরীরে একাধিক রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরী হয়। ডাবের জল সুস্বাদু, সতেজকারক ও ক্লান্তি দূর করে।এই জলে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরিপোষক উপাদান (nutrients) বিশেষত প্রচুর অত্যাবশ্যকীয় খনিজ উপাদান (minerals) পাওয়া যায়।
নারকেল গাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম কোকোস নুসিফেরা (Cocos Nucifera)। পাম গাছের পরিবারভুক্ত হলেও উদ্ভিদবিদ্যায় নারকেলকে বাদাম (nut) জাতীয় খাদ্য না বলে ফল (fruit) বলা হয়।
ডাবের জলের পুষ্টিমূল্য :
ডাবের জল প্রকৃতিগতভাবেই ডাবের মধ্যে আসে। এর মধ্যে ৯৫% জল ও খুব সামান্য ফ্যাট থাকে। এক কাপ (২৪০ মিলি) ডাবের জল থেকে প্রায় ৪৬ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। কার্বোহাইড্রেট ৯ গ্রাম,ফাইবার ৩ গ্রাম, প্রোটিন ২ গ্রাম, আর.ডি.আই (Recommended Dietary Intake)-এর বিচারে ডাবের জলে ভিটামিন সি ১০%, ম্যাগনেসিয়াম ১৫%, ম্যাঙ্গানিজ ১৭%, পটাসিয়াম ১৭%, সোডিয়াম ১১%, ক্যালসিয়াম ৬% থাকে। এক কথায় ডাবের জল ফাইবার, ভিটামিন সি ও অন্যান্য অপরিহার্য খনিজের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা তৈরি :
ডাবের জলে প্রচুর ফেনলিক যৌগ থাকে, এগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পূর্ণ। যা শরীরের বিপাকে উৎপন্ন মুক্তমূলক গুলোর সংখ্যা কমায়। ফলে প্রদাহ (inflamation) ও জারণের ফলে ঘটা কোষের ক্ষয় (Oxidative Damage) রোধ করে। সেই সঙ্গে ডাবের জলে উপস্থিত অ্যান্টি-ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ধর্ম নানাবিধ সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
শরীরে জলের ভারসাম্য রক্ষা :
গরম ও অসুস্থতার জন্য শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ করতে ডাবের জলের বিকল্প পাওয়া মুশকিল। ডাবের জল এবং ও.আর.এসে থাকা জল,চিনি ও ইলেক্ট্রোলাইট-এর পরিমাণ পরস্পর তুল্য। তাই ও.আর.এস-এর পরিবর্তে ডাবের জল রোগীর পথ্য হিসাবে দেওয়া যায়। বিশেষত জিঙ্ক ও ইলেক্ট্রোলাইট থাকায় আগেকার দিনে ডায়েরিয়া ও শিশুদের দস্ত হলে চিকিৎসার জন্য ডাবের জল দেওয়া হতো।
হার্টের সুস্থতা :
ইঁদুরের উপর ডাবের জল প্রয়োগ করে তিন সপ্তাহের গবেষণার ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা জানান ডাবের জল মেটাবলিক সিন্ড্রোম কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বিশেষত ইনসুলিনের মাত্রা, ফুকট্রোজের বিপাক, রক্তচাপ, রক্তে শর্করার মাত্রা,খারাপ ও ভালো কোলেস্টেরল (LDL & HDL ), ট্রাইগ্লিসারাইড ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণে ডাবের জল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এর ফলে হার্ট ভালো থাকে। তাই হার্টের সমস্যায় যারা ভুগছেন নিয়মিত ডাবের জল পান করলে উপকার পাওয়া যাবে।
ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ :
২০১২ সালে হওয়া জার্নাল ফুড অ্যান্ড ফাংশন স্টাডিসে গবেষকরা দেখিয়েছেন ডাবের জলে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং ডায়াটারি ফাইবার ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
এছাড়াও ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে ও ঔজ্জ্বলতা বাড়াতে, বিশেষত ব্রণ-র প্রকোপ কমাতে প্রতিদিন ডাবের জল খেতে ও হাতে-মুখে মাখতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডাবের জলে উপস্থিত খনিজ সমূহ হজমে সাহায্য করে। ওয়াটার রিটেনশন বেড়ে গিয়ে ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কাও হ্রাস পায়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান মেডিকেল জানার্লে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে পটাশিয়াম শরীরে লবনের ভারসাম্য ঠিক রাখার মধ্যে দিয়ে ব্লাড প্রেসারকে স্বাভাবিক রাখে। তাই নিয়মিত ডাবের জল খেলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।লোপ্রেসার বা নিম্নরক্তচাপের ক্ষেত্রেও সমান উপকার দেয় ডাবের জল।ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম কিডনি ভালো রাখে। ডাবের জল শরীরে উপস্থিত টক্সিক উপাদানসমূহ প্রস্রাবের সঙ্গে বের করে দিয়ে নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমায়।
ডাবের জল কখন পান করলে কি উপকার :
ডাবের জলের বহুবিধ উপকার থাকলেও ডাবের জল কখন পান করলে কি উপকার হয় তা জানা দরকার।
প্রাতঃরাশের আগে ডাবের জল :
● সকালে খালি পেটে ডাবের জল ভীষণ উপকারি।এতে থাকা লাউরিক অ্যাসিড (Lauric acid) ইমিউনিটি বাড়ায়, বিপাক দ্রুত শুরু করে ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করে।গর্ভবতী মহিলাদের প্রাতঃ কালীন অসুস্থতা দূর করে ও গ্যাস-অম্বল,বুকজ্বালা থেকে মুক্তি দেয়।
শরীরচর্চার আগে ও পরে ডাবের জল :
● শরীরচর্চার আগে ডাবের জল পান করলে শরীরে প্রয়োজনীয় জলসাম্য রক্ষা করে ব্যায়ামের জন্য শক্তি সরবরাহ করে। ব্যায়ামের পর ডাবের জল দরকারি ইলেক্ট্রোলাইট গুলো সরবরাহ করে ও ক্লান্তি দূর করে।তাই একে প্রাকৃতিক ‘হেলথ ড্রিংক’ বলে।
ভারী খাবার খাওয়ার আগে ও পরে ডাবের জল :
● ভারী খাবার খাওয়ার আগে একগ্লাস ডাবের জল পাকস্থলীর পক্ষে ভালো। কারণ এতে ক্যালোরি কম থাকে ও হজমে সহায়ক। একটু ভরাভাব হওয়ায় ওভার ইটিং বা অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। খাওয়ার পর ডাবের জল পান করলে এতে থাকা খনিজ দ্রুত পরিপাকে সহায়তা করে ও রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
ঘুমানোর আগে ডাবের জল :
●বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার আগে ডাবের জল পান করলে এর সুগন্ধ ও হালকা মিষ্টি ভাব
মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের দুশ্চিন্তা দূর করে, মন শান্ত করে, হার্টের স্পন্দন হার একটু কমিয়ে ভালো বিশ্রামের উপযোগী করে তোলে।শরীরের দূষক পদার্থ মূত্রের মাধ্যমে বের করে দেয়।সেজন্য কিডনি ও মূত্রনালির সংক্রমণ থেকে বাঁচায়। মাথাব্যাথা ও খাদ্যে অনীহা দূরে করে শরীর ফুরফুরে করে তোলে।
সুতরাং ডাবের জল যেকোনো সময় পান করলেই তা শরীরকে সতেজ করে। সুস্বাস্থ্যের জন্য ডাবের জলের কোনো বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র :
1) https://food.ndtv.com/food-drinks/what-is-the-best-time-to-drink-coconut-water-1755236
2) http://www.ais.gov.bd/site/view/krishi_kotha_details
3) https://www.healthline.com/nutrition/green-coconut
লেখকের কথা: মিজানুর রহমান সেখ
মিজানুর পেশায় শিক্ষক এবং একজন সমাজসেবক। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যই মূলত লেখালিখি। লেখক পদার্থবিদ্যা ও শিক্ষাবিজ্ঞানে মাস্টার্স।