পাহাড়ি বালিকা

লেখক: অনুকূল বিশ্বাস

ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। আনুমানিক পাঁচটা বাজে। অনবরত গুলির শব্দে বুমচুমের ঘুম ভেঙে যায়। সে মায়ের পাশ থেকে অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। সে চায় না এখনই মায়ের ঘুম ভেঙে যাক। পা টিপে টিপে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায় সে। বসন্তের ঊষা লগ্নে রবির কিরণ দুধসাদা কুয়াশায় মোড়া পাহাড়ি উপত্যকায় লুকোচুরি খেলছে। এমন মনলোভা সৌন্দর্য আস্বাদনে বুমচুম নিয়ত অভ্যস্ত। সে তো রোজ এই সময় জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে এমন নয়নাভিরাম স্বর্গীয় শোভা দেখতে দেখতে অপেক্ষা করতে থাকে কখন গুলির শব্দ বন্ধ হবে। প্রতিদিন টানা দু’ঘণ্টা এমন গুলিবর্ষণের শব্দে পুংচুং গ্রামের পাহাড়ি উপত্যকা কেঁপে উঠে। তারপর ধীরে ধীরে উপত্যকা তার স্বাভাবিক নিস্তব্ধতায় ফিরে আসে।

উত্তর সিকিমের একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম পুংচুং। হিমালয়ের কোলে চু-নদীর তীরের এই গ্রামটিতে বড়জোর জনাদশেক পরিবারের বাস। একদিকে চু-নদী ও বাকি তিনদিকে পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটিতে খুব ছোট্ট একটি ঘরে অসুস্থ মাকে নিয়ে বারো বছরের বুমচুম বাস করে। পক্ষাঘাতে দীর্ঘদিন ধরে তার মা শয্যাশায়ী। তার মা অসুস্থ হওয়ার পর তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে যান। বুমচুম তখন খুব ছোট্ট।সে মায়ের কাছে শুনেছে তার বাবা নাকি তাদের পাশের গ্রামে আবার নতুন করে অন্য কারোর সঙ্গে সংসার পেতেছেন। সংসারের এই জটিল অঙ্ক ছোট্ট বুমচুমের মাথায় ঢোকে না। সে শুধু বোঝে অসুস্থ মাকে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ন্যূনতম আয়ের সন্ধানে তাকে ছুটে বেড়াতে হয়। কখনো পাহাড়ি ফুল তুলে, কখনো জঙ্গলে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে, কখনো-বা পাহাড়ি ফল পেড়ে সেগুলি বিক্রি করে রোজগারের চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু এগুলো দুর্লভ ও তার বিক্রয় মূল্য অতি নগণ্য। তার চেয়েও মারাত্মক সমস্যা হলো এমন দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ওগুলো কেনার মানুষের বড্ড অভাব। ফলে ওগুলো করে মা ও মেয়ের দু-বেলা ঠিকমত অন্ন জোটে না।

তাদের বাড়ি সংলগ্ন একটি মাঠ আছে। ভারতীয় আর্মি পাহাড় কেটে মাঠটি তৈরি করেছেন। এটা আসলে ভারতীয় আর্মির ফায়ারিং স্কোয়াড। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত এখানে জওয়ানদের ফায়ারিং অনুশীলন চলে। সাতটার সময় যখন ফায়ারিং বন্ধ হয়, তখন বুমচুম একটি পলিথিনের প্যাকেট ও এক টুকরো লোহার রড নিয়ে দৌড়ে মাঠে পৌঁছায়। শুরু হয় তার তল্লাশির পালা। জমি থেকে খুঁজে বার করে টুকরো টুকরো গুলির খোল। সেগুলি সংগ্রহের পর নেমে পড়ে সীসার খোঁজে। এক টুকরো লোহার রড দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সীসা বের করে। প্রায় এক ঘন্টা ধরে তার এই সীসা সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তারপর ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত বুমচুম সেগুলি মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরে। ততক্ষণে তার মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে ঢুকে মাকে দুই টুকরো পাউরুটি দিয়ে যৎসামান্য টিফিন করিয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ে। প্রায় ৩ কি.মি পথ পায়ে হেঁটে পাহাড়ি বাজার রংপুতে পৌঁছায়। সেখানে একটি দোকানে সংগৃহীত গুলির খোল ও সীসা বিক্রি করে সে। তারপর সেখান থেকে কিছু খাবার, চাল ও সবজি কিনে বাড়ির পথে রওনা হয়।

প্রতিদিনের এই রুটিনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এমন হাড়ভাঙা খাঁটুনি খেটেও সে খুশি। দিনের শেষে মায়ের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে পারছে ,তার কাছে এরচেয়ে সুখের ও পরিতৃপ্তির কিছু নেই। সেইসঙ্গে বুমচুম মাকে সুস্থ করার সাধ্য মত চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর মত সামর্থ্য নেই তার। রোজ একবার মাকে ধরে সে বিছানায় বসানোর চেষ্টা করে। তার ধারণা মা বসতে পারলেই হাঁটতে পারবে, আর হাঁটতে পারলেই সুস্থ হয়ে যাবে। তাকে সুস্থ করার প্রচেষ্টায় মেয়ে যা কিছু করছে, সেসব দেখে তার মায়ের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। সে মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলে ‘দেখো মা, আমি যখন বড় হব, তখন তোমায় ঠিক সুস্থ করে তুলবো’। মায়ের অশক্ত হাত বুমচুমের মাথায় রেখে বলেন’ তাই যেন হয় মা। আমি যে তোর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না’।

বুমচুমের মা ফুল খুব ভালোবাসেন। প্রতিদিন বিকেলে গোধূলি নেমে এলে সে পাহাড়ি ফুলের সন্ধানে বের হয়। চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা হরেকরকম বাহারি ফুলের সমাহার। বিভিন্ন রঙের রডোডেনড্রন, প্রিমুলা প্রভৃতি ফুলের মন ভোলানো সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করে। সেগুলি সংগ্রহ করে চু-নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেরে। গোধূলির রক্তিম আলো চু-নদীর নীল জলে হরেক রঙের লুকোচুরি খেলে। সেই ভুবনমোহিনী রূপ আস্বাদনে বুমচুমের সারাদিনের মন-ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। তার শিশুমন বিচরণ করতে থাকে এক স্বপ্নালোকে। তার স্বপ্নলোকের পুরোটা জুড়েই রয়েছে তার মা। মায়ের ভালো হয়ে ওঠা, মায়ের সুস্থতা — সে এক মা-ময়ী মায়াবী জগৎ। ধীরে ধীরে পাহাড়ের গা বেয়ে অন্ধকারের চাঁদ নেমে আসে। বুমচুম আশ্রয় নেয় মায়ের কোলে।

এভাবেই তার জীবনের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অতিক্রম করে বছর পার হয়ে যায়। এরমধ্যে একদিন বুমচুম ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি কুড়োচ্ছে, এমন সময় আর্মির জলপাই রঙের পোশাক পরা একটি লোক তার কাছে আসেন। এতদিন সে দূর থেকে ওদের দেখেছে। এত কাছ থেকে এই প্রথম ওঁদের দেখছে সে। ফলে সে একটু ভয়ই পাচ্ছিল। লোকটি তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোর নাম কি রে? তুই কোথায় থাকিস?’ সে কাঁপা কাঁপা গলায় তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল ‘বুমচুম। ঐ তো, পাহাড়ের কোলে আমাদের কুঁড়ে ঘর আছে।’ তারপর লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সে কেন রোজ গুলির খোল কুড়োয়! এছাড়াও, আরো জানতে চান তার বাড়িতে আর কে কে আছেন? বুমচুম উত্তর দেয়, ‘আমি এগুলো বিক্রি করে যে টাকা পাই তা দিয়ে আমার ও মায়ের খাবার কিনি।’ বুমচুম আরও বললো যে, সে ও তার মা দুজনে থাকে। সবকিছু শোনার পর লোকটি দু-চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে লাগলো। সেটা দেখে ছোট্ট বুমচুম বলে উঠে ‘জানো আঙ্কেল, — আমার মা-ও তোমার মতো কাঁদে। আমি মাকে বলেছি বড় হয়ে মায়ের সব কষ্ট দূর করে দেবো।’ কথাগুলো শুনে লোকটি তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “হ্যাঁ মা, তুই বড় হয়ে মায়ের সব কষ্ট দূর করতে পারবি’। বুমচুম তাঁকে জিজ্ঞেস করে ‘আচ্ছা, তুমি কাঁদছো কেন? তোমারও বুঝি আমার মায়ের মত খুব কষ্ট?’ লোকটি তার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে বললেন ‘সে তুই এখন বুঝবি না। আমার মত বড় হলে সব বুঝতে পারবি ‘। লোকটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে পড়ল মায়ের ঘুম ভাঙ্গার সময় হয়েছে। তাই সে বলল ‘ আঙ্কেল, এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে। কিন্তু তোমার নামটিই তো শোনা হলো না। মাকে গিয়ে কী বলবো’? তিনি বললেন ‘তুই মাকে গিয়ে বলবি বৈজু আঙ্কেলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।‘ বৈজু নামটি শোনামাত্রই সে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটে পালাল।

শীতকালের সকালে সমস্ত উপত্যকা ঢাকা থাকে শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে। এই সময় প্রকৃতির অনন্য রূপ-লাবণ্য স্বর্গীয় ঐশ্বর্য কে হার মানায়। পাহাড়ি গ্রাম পুংচুং তুষার মুকুট মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভরদুপুরে পাহাড়ের কোলে মেঘ কুয়াশার দল লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠে। এমন হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেও ভারতীয় আর্মির অনুশীলন যথাসময়ে হয়ে থাকে। কিন্তু বুমচুম প্রবল ঠান্ডার মধ্যে এত ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। অসম্ভব ঠান্ডায় প্রয়োজনীয় শীতের পোশাক তার নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। কিন্তু তাকে তো ফায়ারিং মাঠে যেতেই হবে। এমনই একদিন সে যখন মাঠে পৌঁছাল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাঠে গিয়ে দেখে একটিও গুলির খোল ও সীসা কোথাও পড়ে নেই। মাঠের মাঝখানে চুপচাপ বসে পড়লো সে। আজ তাকে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হবে, সেটা ভেবে কান্না পেল তার। দুচোখের জল বাঁধ মানল না। আজ যে সে মায়ের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে পারবে না।

বেশ কিছু দূর থেকে সেনা ছাউনিতে বসে বৈজুনাথ সবকিছু লক্ষ্য করছিলেন। বুমচুমের কান্নার ধ্বনি তাঁকে সেখানে বসে থাকতে দিল না। ধীরে ধীরে তিনি বুমচুম এর পাশে এসে দাঁড়ালেন। লক্ষ্য করলেন এমন ফুলের মতো মেয়েটি খোল ও সীসা না পাওয়ার বেদনায় সুর তুলে কাঁদছে। সেই সঙ্গে প্রবল ঠাণ্ডায় সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। ক্ষীণস্বরে বৈজুনাথ বললেন ‘ এই নে , তোর গুলির খোল ও সীসা। তুই আসতে দেরি করছিলি বলে আমি কুড়িয়ে দেখেছি।’ পিছন ফিরে তাকিয়ে বুমচুমের বেদনাশ্রু নিমেষে আনন্দাশ্রুতে পরিণত হল। কান্না হাসির দোলাচলে সে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

গুলির খোলের প্যাকেটটি হাতে নিয়ে সে বলল ‘জানো আঙ্কেল, এইগুলি বিক্রি করে যা টাকা পাই তা দিয়ে আমার ও মায়ের কোনও ক্রমে দু’বেলার অন্নসংস্থান হয়’। এমন নিষ্পাপ শিশুর মুখ থেকে এসব কথা শোনার পর বৈজুনাথের চোখের জলে বুক ভেসে যেতে লাগল। নিজেকে সামলে তিনি বললেন ‘আমার সঙ্গে একটু এগিয়ে আয়।’ তিনি বুমচুমকে একটি ঘরে নিয়ে গেলেন।

অতি সুন্দর একটি সোয়েটার তাকে পরিয়ে দিয়ে বললেন ‘দ্যাখ তো, এটাতে তোকে কেমন মানাচ্ছে! যা, মায়ের কাছে ফিরে যা। তোর মায়ের ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে।’ যাবার সময় সে বলল ‘আঙ্কেল, তুমি খুব ভালো। আমি কোনদিনও এমন সুন্দর সোয়েটার পরিনি।’

সেদিন ভোররাত থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। ফায়ারিং অনুশীলন শেষ হওয়ার পরও বৃষ্টি থামছে না। বুমচুম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন দেখলো বৃষ্টি থামছে না, অগত্যা সে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারা মাঠ ঘুরে ঘুরে সেগুলি সংগ্রহ করতে লাগলো। মেয়েটি এমনভাবে বৃষ্টিতে ভিজছে দেখে বৈজুনাথ তার থেকে এগিয়ে এলেন। কাছে এসে তার মাথায় ছাতা ধরতেই বুমচুম পিছন ফিরে দেখে আর্মি আঙ্কেল। সে বলল ‘জানো আঙ্কেল, বাড়িতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম যদি বৃষ্টি থামে কিন্তু থামার নাম নেই। তাই চলে এলাম।’ তিনি বললেন ‘এই নে, ছাতাটা ধর। এক হাতে ছাতা ধরে আস্তে আস্তে বাড়ি চলে যা।’

তারপর থেকে এইভাবে প্রতিদিন সকালে বুমচুম এর জন্য একটি করে অনভিপ্রেত উপহার অপেক্ষা করত। বৈজুনাথ রোজ তাকে কিছু না কিছু দিতেন। সেই উপহার হাতে পেয়ে সে যে অনাবিল হাসি হাসতো সেটাই ছিল বৈজুনাথের পরম প্রাপ্তি। তার খুশিতে আত্মহারা হওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেছেন এসবের মধ্যেও বুমচুমের অন্তরে এক অদৃশ্য দুঃখ লুকিয়ে আছে। সেটা হল তার মায়ের অসুস্থতা।

বেশ কয়েকদিন পর, একদিন সকালে দুইজন ডাক্তারসহ এক আর্মি মেডিকেল টিম বুমচুমের বাড়িতে এসে হাজির হল। তাঁরা এসে বললেন ‘বৈজু স্যার তাঁদের পাঠিয়েছেন।’ মেডিকেল টিম তার মাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ দিয়ে গেলেন। ওষুধ খাওয়ার পর তার মা একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলেন। সাতদিন পর তার মা বিছানা থেকে উঠে বসলেন। এটা বুমচুমের কাছে ম্যাজিকাল ঘটনা বলে মনে হল। তার মা বুমচুমকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তিনি উঠে বসতে পারলেন। পরের দিন সকালে বুমচুম আর্মি আঙ্কেলকে এই সুখবরটা দিল। খবরটি শুনে তিনিও খুব খুশি হলেন। তিনি বুমচুমের মাথায় হাত রেখে বললেন ‘দেখবি ,সব আগের মত হয়ে যাবে। তোর মা আবার হাঁটতে পারবে।’ বুমচুম তাঁকে বলল ‘আঙ্কেল, মা তোমায় আমাদের বাড়ি যেতে বলেছে।’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যাবো একদিন। আগে তোর মা সুস্থ হয়ে উঠুক।’

যতদিন যায় তার মা একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলো। একদিন সকালে বুমচুম ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে ফেরার পর তাকে পাশে বসিয়ে তার মা বললেন, ‘তুই পূর্ব জন্মে আমার মা ছিলি, তাই-তো আমায় পুনর্জন্ম দিলি।’ এরপর আকাশের দিকে দুহাত তুলে তিনি বললেন ‘হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, তোমার অশেষ কৃপায় আমি ধন্য, বৈজুনাথ নামের যে দেবদূতকে তুমি আমাদের জন্য পাঠিয়েছো, তার সর্বময় মঙ্গল কোরো। এমন মহান হৃদয়ের কৃপায় আমার পুনর্জন্ম হলো।’ কথাগুলো শেষ হতে না হতেই তার দু’গাল বেয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। বুমচুম দুই হাত বাড়িয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।

প্রতিদিন একটি করে উপহার পেয়ে সে মহানন্দে নাচতে নাচতে ঘরে ফিরতো। এসময় তার মা লক্ষ্য করেছেন বুমচুম আর আগের মত বিষণ্ণ মনে ঘরের কোণে বসে থাকে না। তার মধ্যেও প্রাণোচ্ছল ভাবের উদয় হয়েছে। দুঃখের অন্ধকার যে ঘরটিকে দিনরাত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আটকে রেখেছিল বেশ কিছুদিন ধরে সেই ঘরে একটু একটু করে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। তমসার ঘোর ধীরে ধীরে কাটতে চলেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বুমচুম এর মা লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। তার মনটা ছটফট করছে ফায়ারিং স্কোয়াডে যাওয়ার জন্য। যাঁকে তিনি দেবদূত হিসেবে মানেন তাঁকে স্বচক্ষে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। বুমচুমের কাছে অনেক বার অনুরোধ পাঠিয়েও তাঁকে এই বাড়িতে আনতে পারেনি। তাই তিনি নিজেই মাঠে যাবেন ঠিক করেছেন।

একদিন সকালে মেয়ের হাত ধরে তিনিও ফায়ারিং স্কোয়াডে চলে আসলেন। কিন্তু সেখানে বৈজুনাথকে দেখতে পেলেন না। বুমচুম অনেক খোঁজাখুঁজি করল, কিন্তু সেখানে তাঁকে দেখতে পেল না। তারপর সে মায়ের হাত ধরে আর্মি ক্যাম্পের ভিতরে প্রবেশ করল। সেখানে ডিউটি অফিসারকে তিনি বৈজুনাথের কথা জিজ্ঞেস করলেন। ডিউটি অফিসার বললেন যে ওই নামে কোনও আর্মি অফিসার এখানে নেই। তাঁর কথা বুমচুমের মন মানতে চাইল না। তাই সে বারেবারে বলছে আর্মি আঙ্কেল ভেতরে আছেন।

বুমচুমের মা-মেয়েকে শান্ত করে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন। তিনি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন কিন্তু ছোট্ট শিশুকে সে কথা বোঝানো যাচ্ছে না। তারপর থেকে প্রতিদিন বুমচুম ফায়ারিং স্কোয়াডে গিয়ে তন্ন তন্ন করে আর্মি আঙ্কেলকে খোঁজে, চিৎকার করে আর্মি আংকেল বলে ডাকতে থাকে। তার সেই সুরেলা কন্ঠের প্রতিধ্বণি সে নিজেই শুনতে পায়। কিন্তু বৈজুনাথের কন্ঠ শুনতে পায় না। রাতের অন্ধকার অবসানে ভোরের আলো উৎসারিত হয়, ভোরের অজান্তেই দিন পেরিয়ে উপত্যকায় গোধূলি নেমে আসে, আবার রাতের অন্ধকার চারদিকে গ্রাস করে নেয়, ফিরে আসি নতুন সকাল। কিন্তু আর্মি আঙ্কেলের ফেরার পথ চেয়ে বুমচুমের মনের অন্ধকার দূর হয় না।


লেখকের কথা: অনুকূল বিশ্বাস
জন্ম ২২শে জুন, ১৯৭৫, মালদা জেলার বামনগোলা ব্লকের রাঙ্গামাটিয়া গ্রামে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। প্রথমে নয়মৌজা হাইস্কুলে শিক্ষকতার পেশায় যোগদান। বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির, মালদহে শিক্ষকতার পেশায় কর্মরত। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় সমান আগ্রহী। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের আদর্শে অনুপ্রাণিত। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় বিশ্বাসী। ছাত্র জীবন থেকেই কবিতা ,গল্প ও প্রবন্ধ লেখা শুরু। ইতিমধ্যে দুটি কাব্যগ্রন্থ “উদাসীমনে” ও “রাঙামাটির পথে” এবং দুটি গল্প সংকলন “পানসি” ও “অন্তরীপে জীবন” প্রকাশিত হয়েছে।
সন্মাননা:
১। National Award :
Taranews Channel “সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মাননা” ২০২০
২। National Awrad :
“BEST TEACHER AWARD” 2020, in recognition of valuable contribution to the academic community and the students & literature for writing various books by INSTITUTE OF SCHOLARS (INSC), BENGALURU.

শেয়ার করে বন্ধুদেরও পড়ার সুযোগ করে দিন

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।