লেখক: হৃদয় হক
“The Universe is under no obligation to make sense to you”- Neil deGrasse Tyson
আপনি যখন সৌরজগতের গ্রহগুলোর ডায়াগ্রামের দিকে নজর দেবেন, দেখবেন মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে এক বিরাট শূন্যস্থান। জার্মান বিজ্ঞানী বোড ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কারের ১০০ বছর আগে দেখেছিলেন যে, একটা গ্রহ থেকে তারপরের টা কত দূরে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে তার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। তিনি সেই নিয়মটা লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু সেই নিয়ম মতে মঙ্গল ও বৃহস্পতির ফাঁকটা অনেক বড়। এই গ্যাপ জ্যোতির্বিদদের মনে অশান্তি দিচ্ছিল। ওঁরা এই ফাঁকা জায়গাতে একটা গ্রহ দেখতে চেয়েছিলেন।
১লা জানুয়ারি, ১৮০১ সাল। তাঁরা তাঁদের এই ইচ্ছা আংশিক ভাবে পূরণে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতালীয় জ্যোতির্বিদ জুসেপ্পে পিয়াজ্জি আকাশে একটি আলোক বস্তু দেখতে পান, যার গতি ছিল আকাঙ্খিত গ্রহটির জন্য একেবারেই নিখুঁত। কিন্তু তা দেখতে ছিল একটা সূক্ষ্ম বিন্দুমাত্র। তিনি প্রথমে এটাকে ধুমকেতু ধরে নেন, কিন্তু পরে জানা গেল যে, ওটা ধুমকেতু নয়। আর এই নতুন বস্তুটিকে গ্রহ ধরে নাম দেওয়া হয় সিরিস।
কিন্তু আদৌ কি এটি কোনো গ্রহ ছিল? এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমে সংশয়ী ছিলেন। এর কিছু বছর পর সেই ফাঁকা জায়গায়, ১৮০২ এইরকম ২য় একটি বস্তুর আবির্ভাব ঘটে, তারপর ১৮০৪ সালে ৩য় ও ১৮০৭ সালে ৪র্থ একই জাতের বস্তু দেখা যায়। এ থেকে ওঁরা নিশ্চিত হলেন যে এটি সৌরজগতের নতুন কোনো শ্রেণির বস্তু। যেহেতু এই বস্তুগুলো সেই সময়ের টেলিস্কোপে ছোট ছোট বিন্দুর মত দেখাতো আর খালি চোখে দেখতে পাওয়া তারাদের মত উজ্জ্বল ছিল, তাই এই নতুন বস্তুটির নাম দেওয়া হয় “অ্যাস্টারয়েডস”(Asteroids), যা গ্রীক শব্দ, এর অর্থ হল তারা-স্বরূপ (Star-like) বা তারা-আকৃতিক (Star-shaped)। বাংলার বলা হয় “গ্রহাণুপুঞ্জ”।
বিশ শতাব্দী শুরুর দিকে তাঁরা আরো অনেকগুলো গ্রহাণুর সন্ধান পান যার আজকের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য । অনুমান করা হয় আমাদের সৌরজগতে ১ মিলিয়নের মত গ্রহাণু আছে যা লম্বায় ১ কি.মি. থেকে শুরু আর এদের ব্যাসার্ধ ১০০ মিটার থেকে ১০০ কি.মি. হয়ে থাকে।
কী এই গ্রহাণু?
আসলে কোনটা গ্রহাণু আর কোনটা গ্রহাণু নয় তার জন্য কোনো সংজ্ঞা ধরাবাঁধা নেই, তবে, সাধারণত গ্রহাণু হল ছোট আকৃতির একধরনের বস্তু যা পাথর বা ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি এবং এরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ঘোরে ও এদের সীমানা বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথ পর্যন্ত বিদ্যমান। অবশ্য যেসব ছোট আকৃতির বস্তু বৃহস্পতির কক্ষপথের বাইরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তাদের আলাদা সংজ্ঞা আছে। এ নিয়ে অন্য একদিন গল্প করবো না হয়।
তা এগুলো খেয়ে দেখার ইচ্ছা আছে?
সমস্যা নেই, গ্রহাণুরা নানান ফ্লেভারের হয়। যেমন: বেশিরভাগ অর্থাৎ ৭৫ % গ্রহাণু কার্বন দিয়ে তৈরি, এরা হল সি-টাইপ (C-type) বা কার্বনেশাস। আবার ৬ ভাগের ১ ভাগ বা ১৭% গ্রহাণু সিলিকন বা দস্তার তৈরি এরা হল এস-টাইপ (S-type) বা সিলিকেশাস। আর বাকী ৮% হল এম-টাইপ (M-type) বা মিসসেলেনিয়াস এরা অন্যান্য মেটাল পদার্থের তৈরি তবে এদের মধ্যে লোহা ও নিকেলের আধিক্য বেশি। এদের আকারও বড় উদ্ভট। কেউ গোল, কেউ তে-কোণা, কেউ বা একেবারে লম্বা। বড় গ্রহাণু গুলো মোটামুটি গোলাকার, কিন্তু ছোট গুলো বেশি অনিয়মিত আকৃতির হয়।
বিজ্ঞানীরা এদের আকার, এরা কতটুকু সূর্যের আলোর প্রতিফলন ঘটায় ও কতটুকু তাপ বিচ্ছুরিত করে তার উপর ভিত্তি করে বের করেন। বেশিরভাগ গ্রহাণুই মঙ্গল ও বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝে অবস্থান করে সূর্যকে পরিক্রম করায় এই এলাকাকে বলা হয় প্রধান বেষ্টনি (Main Belt)। এটিরও গঠনপ্রনালী আছে। যেমন: যদি কোনো গ্রহাণুর সূর্যকে পরিক্রমার সময় এমন হয় যে, সেটি সূর্যকে ২ বার পরিক্রমা করতে যে সময় নেয়, বৃহস্পতি গ্রহ উক্ত সময়ে সূর্যকে শুধু ১ বার পরিক্রমণ করে, তাহলে সেই গ্রহাণুটি সূর্যকে পরিক্রমার সময় বৃহস্পতি গ্রহ থেকে সাধারণত বড় মাপের যে আকর্ষণ অনুভব করত বৃহস্পতি গ্রহের পাশ দিয়ে তাকে ২ বার যেতে হয় বলে তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ফলে এরূপ গ্রহাণু তাদের সাধারণ কক্ষপথ থেকে আলাদা হয়ে সরে যেতে থাকে। ফলে সেখানে কিছু ফাঁকা জায়গার তৈরি হয়। ১৮৫৭ সালে বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কির্কউড (Daniel Kirkwood) এই গ্যাপটি লক্ষ করেন, তাঁর নাম অনুসারে এ ফাঁকা জায়গার নাম রাখা হয় কির্কউড গ্যাপ (Kirkwood Gap)। আর বৃহস্পতির সাথে ২:১, ৩:১, ৫:২ ইত্যাদি সাধারণ ভগ্নাংশ বা অনুপাতের প্রদক্ষিণের ফলেও এরকম গ্যাপ দেখা যায়, যা প্রধান বেষ্টনির গঠনে প্রভাব ফেলে।
আপনারা তো জানেনই শনির বলয়েরও ভাগ রয়েছে। আর এভাবে শনির বলয়ের সাথে গ্রহাণুর প্রধান বেষ্টনির একটি মিল দেখা যায়। গ্রহাণুকে আবার অন্যরকমভাবে ভাগ করা যায়, যেমন: কিছু গ্রহাণুর বৈশিষ্ট্য একদম একই অর্থাৎ এদের সব আচার আচরণ অভিন্ন আর এদের প্যারেন্ট বডি বা অরিজিন একই, এরা কোনো এক বৃহৎ বস্তুর ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি সম্ভবত কোনো বড় গ্রহাণুদের সংঘর্ষের ফলে তা ভেঙে এসব ছোট গ্রহাণু তৈরি হয় এদের বলা হয় একই পরিবারভুক্ত বা গ্রুপভুক্ত গ্রহাণু।
আনুমানিক সৌরজগতের এক-তৃতীয়াংশ গ্রহাণুই কোনো না কোনো পরিবারভুক্ত।
যেমন : ইউরোপা ফ্যামিলির চারশোরও বেশি সদস্য রয়েছে। অনেকেই হয়ত নানা মুভিতে দেখেছেন যে, নায়ক ভিলেনকে আক্রমণ করার জন্য মহাকাশে স্পেইসশিপ নিয়ে এই গ্রহাণু বেষ্টনির মধ্য দিয়ে বড় বড় গ্রহাণুর ছোট ছোট ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে এই বেষ্টনির অধিকাংশই ফাঁকা। আর এরা একে অপর থেকে এতটাই দূরে অবস্থিত যে, আপনি যদি একটি গ্রহাণুর উপর দাঁড়ান তাহলে সেখান থেকে আপনার চোখ যদি খুব ভালোও হয় তাও খালি চোখে অন্য একটি গ্রহাণুর দেখা পাওয়া মুশকিল। আর এরা সংখ্যায় বেশি হলেও মোটে এত বড় নয়। আপনি যদি সব গ্রহণু গুলো একত্র করেন তাহলেও তার আকার আমাদের চাঁদের চেয়ে ছোট হবে। গ্রহাণু বেষ্টনির মোট ভর চাঁদের ৪% যা, প্লুটোর থেকেও কম। এরা যে মঙ্গল থেকেও কম ভরের তা এমনিতেই বোঝা যায়, তা না হলে এরা এর চলার পথে বেশ কিছু অসুবিধা ঘটাত, সন্দেহ নেই।
গ্রহাণুদের মধ্যে সেরেস (Ceres) সবচেয়ে বড়। বিজ্ঞানী পিয়াজী প্রথমে এর নাম রাখেন “সেরেরে ফেরদিনানদিয়া” (Cerere Ferdinandea)। “সেরেরে” নামের উৎস হল রোমান দেবী সেরেস যিনি অঙ্কুরোদগম , ফসল ফলানো এবং মাতৃস্নেহের দেবী। আর “ফেরদিনানদিয়া” নামটি এসেছে নেপলস ও সিসিলি’র রাজা ৪র্থ ফার্দিনান্দ-এর নামানুকরণে। কিন্তু এই নাম নিয়ে অনেকের মতবিরোধ থাকায় তার নাম রাখা হয় শুধু “সেরেস”। সেরেস গ্রহাণু বলয়ের একমাত্র বামন গ্রহ । মাত্র ৯৫০ কিলোমিটার ব্যাসের অধিকারী সেরেস গ্রহাণুপুঞ্জের সবচেয়ে বড় জ্যোতিষ্ক। গ্রহাণুপুঞ্জের সকল গ্রহাণুর মোট ভরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভর সেরেসের নিজের। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণসমূহ থেকে জানা যায়, সেরেসের পৃষ্ঠ সম্ভবত পানি, বরফ ও পানিতে দ্রবীভূত বিভিন্ন খনিজ পদার্থের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি । ধারণা করা হয় এর কেন্দ্র পাথুরে এবং চারপাশ ঘিরে তরল পানির মহাসাগর রয়েছে যা কিনা পৃথিবীর সব পরিষ্কার পানি থেকেও বেশি। এছাড়া কিছু বড় গ্রহাণু হল – ভেস্তা, হাইজিয়া ও পালাস। এদের ব্যাস যথাক্রমে ৫৩৪, ৪৫০ এবং ৬০৮ কিলোমিটার।
এবার একটু ভেস্তা (Vesta)-তে ঘুরতে যাওয়া যাক। ভেস্তা হল ২য় বড় ও ভারী গ্রহাণু। এটির আকার গোল তবে পুরো গোল না, এই ধরুন আপনি একটি বড় গোল বলের উপর বসলে তা উপর নিচে চ্যাপ্টা ও দুপাশে যেমন একটু বের হয়ে লম্বা হবে তেমন। এটি পৃথিবী থেকে দেখতে পাওয়ার নিরিখে সবচেয়ে উজ্জ্বল গ্রহাণু। একে গভীর রাতের সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত আকাশে খালি চোখে দেখা যায়। এর দূরত্ব সূর্য থেকে সেরেসের দূরত্বর চেয়ে একটু বেশি। এর দক্ষিণ দিকে সংঘর্ষ প্রাপ্ত হওয়ার কারণে অনেক গর্ত হয়ে গিয়েছে। তবে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন সেখানে আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন গ্রহাণুতে নানা স্পেসক্রাফট বেড়াতে গিয়েছে, এদের বেশিরভাগই ছিল ফ্লাই-বাই। সেসব গ্রহাণুদের মধ্যে কিছু হল : লুটেইটিসা, স্টেইন্স, গ্যাস্প্রা, আইডা ইত্যাদি। অবশ্য গ্রহাণুদেরও উপগ্রহ আছে। আইডা (Ida) হল প্রথম গ্রহাণু যাকে ছোট একটি উপগ্রহের সাথে দেখা মেলে, তার নাম ডেক্ট্যাইল (Dactyl)। আসলে এদের বাইনারি গ্রহাণুও বলা যায়। আরও একটা গ্রহাণুর নাম হল ক্লেওপেট্রা। এটা একটা মাজাদার আকৃতির গ্রহাণু, যাকে বলা হয় ডগ-বোন সেপ। তবে এর দুটো উপগ্রহ আছে।
এবার আসি অন্য কথায়। কিছু বছর আগে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন যে, গ্রহাণুগুলো অনেক বছর ধরে বছর একে অপরের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে সংঘর্ষ ঘটিয়ে আসছে। কখনো অনেক দ্রতগামী এক গ্রহাণু অন্য একটি কে ধাক্কা দেয়, আবার কখনো বা আস্তে। ধীরগতিতে যে সংঘর্ষ ঘটে তা অতোটা বলবৎ নয়। মানে এ সংঘর্ষের ফলে আঘাতপ্রাপ্ত গ্রহাণুর উপর ফাটল ধরে, বা তার উপরই ছোট ছোট পাথুরে খন্ড তৈরি করে কিন্তু তা ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে যায় না। এইরকম অনেক বার আঘাত খাওয়ার ফলে এমন এক অবস্থার তৈরি হয় যার ফলে তাকে বলা হয় Rubble Pile – বাংলায় বলা হয় পাথরের স্তূপ। এটির মানে হল একটি বড় পাথরে অংশ নয় (যেমন: পৃথিবী) কিন্তু বিভিন্ন ছোট ছোট পাথরের সমন্বয়ে গঠিত একটি বস্তু। আঘাতের ফলে যে পাথরগুলো থাকে তা গ্রহাণুটির মধ্যাকর্ষণ বলের ফলে তার গায়ে লেগে থাকে- অনেকটা ওই ফেটে যাওয়া একটা গাড়ির জানালার কাচ যা আপনি হালকা চাপ দিলেই ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে পড়ে যাবে, কিন্তু শুধু কোনোরকম ভাবে টিকে আছে। ঠিক এমন অবস্থায় মধ্যাকর্ষণ বলের ফলে গ্রহাণুটি টিকে থাকে। তবে এর ঘনত্ব অনেক কম কারণ, এই ছোট ছোট পাথর দিয়ে তৈরি বলে এদের মাঝে ফাঁকা জায়গা আপেক্ষিক ভাবে বেশি। এই বিষয়ে আরও ভালভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যখন জাপানের একটি স্পেসক্রাফট “ইটাকাওয়া” নামের একটি গ্রহাণুতে বেড়াতে যায়। এই গ্রহাণুর অবস্থার বিবরণ দাওয়ার জন্য একটা কথাই যথেষ্ট আর তা হল এক “বিশৃঙ্খলাময় জগাখিচুড়ি”। এটা ভাবতেই অদ্ভূত লাগে যে কিছু গ্রহাণু আসলে কিছুই না বরং কিছু মুক্ত ভাবে ভাসমান নুড়ি পাথরের ব্যাগ।
কেন এই গ্রহাণু বেষ্টনি (Asteroid Belt) আছে বা কীভাবে হল?
যখন আমাদের সৌরজগৎ তৈরি হচ্ছিল, আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণার মেঘের কেন্দ্রের আশপাশের অন্য অংশ থেকে বেশি ঘনত্বপূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে খুব দ্রুত সংকুচিত হতে থাকে। সেখানে তৈরি হয় আমাদের প্রোটোসূর্য, তারপর সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং দৃশ্যমান আলোর দেখা মেলে। তাপমাত্রা আরও অনেক বাড়ার পর শুরু হয় নিউক্লিয় বিক্রিয়া, সৃষ্টি হয় আমাদের পরিপূর্ণ সূর্য যা মেঘটির কেন্দ্রের স্থান দখল করে নেয়। এরপর আশেপাশের সকল বস্তু চাকতির ন্যায় আকৃতি ধারণ করতে শুরু করে। আশপাশের সকল বস্তু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। আর সেখান থেকে তৈরি হয় গ্রহ। গ্রহ তৈরি হবার সময় এরা মেঘ থেকে অনেক বেশি উপাদান আকর্ষণ করে নিতে শুরু করে। স্বল্প ভর থেকে অধিক ভর যুক্ত হতে থাকে, আকারও বাড়াতে থাকে। আমাদের রক্ষক মানে বড় ভাই বৃহস্পতি তার আশপাশের অধিকাংশ উপাদান আকর্ষণ করে নেয় তবে সবটুকু নয়। যেগুলো বাকি থাকে তারা ভারী উপাদান গুলো মাঝে টেনে নেয় আর হালকা উপাদান গুলো উপরের স্তরে আকর্ষিত হতে থাকে, মানে তারাও গ্রহ হবার চেষ্টা চালায়। গ্রহ হবার শর্তগুলো মোটামুটি ভাবে পুরিত হয়েছিল, কিন্তু পুরোপুরি ভাবে নয়। তাই গ্রহটি গঠিত হতে পারেনি বা হয়েও স্থিরতালাভ করেনি। কোনো কারণে তারা মহাকাশে অজ্ঞাত বিপর্যয়ের ফলে ভেঙে হাজারো খণ্ড হয়ে যায়, সেই সম্ভাব্য বা বিনষ্ট গ্রহের দেহবস্তুই ছোট ছোট টুকরো হয়ে ওখানে ছড়িয়ে আছে, আর সূর্যকে পরিক্রমণ করছে। তাই আমরা এসব গ্রহাণু দেখি।
আবার অনেকের ধারণা, গ্রহদের জন্মের সময় যে সব অতি ক্ষুদ্র বস্তুর সৃষ্টি হয়েছিল, হয়ত তারা কোনও কারণে জমাট বেধে বিরাট গ্রহে রূপান্তরিত হতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই ভাঙাচোরা গ্রহাণুগুলি সূয্যিমামাকে অন্যান্য ভাগ্নের (গ্রহের) মতোই প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে দিয়েছিল। তাই এদেরকে ব্যর্থ গ্রহও বলা হয়। এরা আবার Minor planet অথবা Planetoid গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত। ধারণা করা হয় যে, বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে আরো অনেক গ্রহাণু ছিল। কিন্তু সেগুলো হয় আমাদের বড় ভাই খেয়ে ফেলেছেন না হয় তার ক্ষমতা দেখাবার জন্য মধ্যাকর্ষণ দিয়ে তাদের কক্ষপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে জোর করে বের করে দেন। অবশ্য এর ফলে হয়তো মঙ্গল গ্রহের আকার ছোট। কারণ মঙ্গল গ্রহ বেড়ে ওঠার সময়, বড় ভাই বৃহস্পতি মনে হয় মঙ্গলের খাদ্য মেরে দিয়েছেন!
মোটামুটি অধিকাংশ গ্রহাণুই প্রধান বেষ্টনিতে থাকে কিন্তু সব গুলো নয়। কিছু কিছু গ্রহাণু মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের ভেতর ঢুকে যায়। এবং অন্যান্য গ্রহাণু থেকে সূর্যের বেশি নিকটে চলে আসে। তাদের বলা হয় মঙ্গল কক্ষপথ লঙ্ঘনকারী গ্রহাণু (Mars Crossing Asteroid) বা “MAC”।
আরো কিছু গ্রহাণু আছে যাদের কক্ষপথ এদের থেকেও সূর্যের অতি নিকটে। তাদের কী বলা হয় ? পৃথিবী লঙ্ঘনকারী গ্রহাণু? আজ্ঞে না! তাদের বলা হয় অ্যাপোলো (Apollo)। এর নামকরণ করা হয় এদের জাতের প্রাপ্ত প্রথম গ্রহাণুটির নামে। আবার আরেক জাতের গ্রহাণু আছে তারা বলতে গেলে সরাসরি পৃথিবীর কক্ষপথের ভেতরেই অবস্থান করে। এদের বলা হয় অ্যাটেন (Aten) গ্রহাণু। অ্যাটেন ও অ্যাপোলো গ্রুপের গ্রহাণু পৃথিবীর অনেক কাছে আসে তাই এদের বলা হয় পৃথিবীর কাছের গ্রহাণু (Near-Earth Asteroid)।
আমোর (Amor) নামের আরেকটি আছে, এরা পৃথিবীর অনেক নিকটে আসে তবে এর কক্ষপথে প্রবেশ করে না, এদের অধিকাংশই মঙ্গলের কক্ষপথ ক্রস করে। কিছু গ্রহাণু আছে যারা পৃথিবীর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে তবে, তার মানে এই না যে এরা আমাদের সবসময় আঘাত করবে, মানে বিষয়টা এমন যে, আপনি তো গাড়ির সাথে ধাক্কা না খেয়ে রাস্তা পাড়ি দিতে সক্ষম হন। কি হন না? কিন্তু মাঝে মাঝে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে আর কি!কিন্তু এর জন্য নানা জ্যোতির্বিদরা সতর্ক আছেন, তাই রাতে নানা অব্জার্ভেটরিস দিয়ে আকাশকে প্রতিনিয়ত স্ক্যান করা হচ্ছে।
আরও এক ধরনের গ্রহাণু আছে যারা ট্রোজান (Trojan) নামে পরিচিত। আগে বলি ট্রোজান কী। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ট্রোজান হল ছোট একটি বস্তু যা বড় বস্তুটির সাথে তার কক্ষপথ ভাগাভাগি করে নেয় যা স্থিতিশীল হয়। এমন স্থিতিশীল জায়গাগুলোকে বলায় লাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট (Lagrange Point) বা এল-পয়েন্ট। ট্রোজানরা এই এল-পয়েন্টে গুলোর ৪ ও ৫ নং পয়েন্ট-এ বিদ্যমান। এই পয়েন্টগুলো ৬০° কোণে আসল বস্তুর কক্ষপথে সামনে ও পেছনে থেকে বড় বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘোরে। গ্রহ ও উপগ্রহের মধ্যেও এই পয়েন্ট কাজ করে, তাই সেখানেও ট্রোজান থাকতে পারে। যেমন : শনির ৪ টি ট্রোজান মুন বা চাঁদ আছে৷ আমাদের সৌরজগতের মধ্যে যেসব ট্রোজান আছে তা মধ্যে বেশিরভাগ ট্রোজান এ বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে অবস্থিত। কারণ, আমাদের সৌরজগতে সূর্য ও বৃহস্পতি হলো সবচেয়ে ভারী বস্তু, ফলে তা লাগ্রাঞ্জের থিওরির সাথে মিলে যায়।
বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে অবস্থিত যেসব ট্রোজান ৬০° সামনে বা আগে থাকে তাদের নামকরণ করা হয় গ্রিক পৌরানিকের নায়কদের নাম অনুসারে, আর যারা ৬০° পেছনে তাদের নাম দেওয়া হয় গ্রীক সেনাপতিদের নামানুসারে। তবে, একত্রে এরা ট্রোজান গ্রহাণু নামে পরিচিত। বৃহস্পতির আনুমানিক ১ মিলিয়নেরও বেশি ট্রোজান আছে এবং তারা ১ কি.মি. থেকেও বেশি বড়। এর চেয়েও বেশি ট্রোজান থাকতে পারে যা বিজ্ঞানীরা দেখেন নি, কারণ গ্রহাণুরা অনুজ্জ্বল, অনেক দূরে এবং এদের পৃষ্ঠতল কালো।
বড় ভাই বৃহস্পতি ছাড়াও অন্যান্য গ্রহেরও ট্রোজান আছে। যেমন: মঙ্গলের ৯টি, নেপচুনের ২২ টি, ইউরেনাসের ২ টি ও পৃথিবীর ১ টি। পৃথিবীর টি আবিষ্কার করা হয় ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে। এটি WISE বা (Wide-field Infrared Survey Explorer) দিয়ে আবিষ্কার করা হয়, যা অবলোহিত আলো ব্যবহার করে মহাবিশ্বের নানা বস্তুর ছবি নেয় বা স্ক্যান করে। এর নাম 2010 TK7 ।
এছাড়াও কিছু গ্রহাণু আছে যা, পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে পড়ে কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে না। তাদের নিজের আলাদা কক্ষপথ রয়েছে যা উপ-বৃত্তাকার এবং হেলানো। যার ফলে তারা পৃথিবীর কাছাকাছিই থাকে কিন্তু আমাদের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। তারা অবশ্য অনেক সময় আমাদের কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। এটি অবশ্য একটু অদ্ভুত। তবে তা অরবিটাল মেকানিক্স-এর সাধারণ বিষয়। কিছু মানুষ এই গ্রহাণুদের পৃথিবীর চাঁদ বলেন, কিছু মানুষের মত তা নয়, তবে বলা যায় এরা আমাদের সাথে কো-অরবিটালে যুক্ত। এমন গ্রহাণু খুবই কম তবে এর মধ্যে নামকরা একটি হল ক্রুয়েনিয়া (Cruithne)। এটি যখন আমাদের কাছাকাছি আসে তখন পৃথিবী ও তার মধ্যে ১২ মিলিয়ন কিলমিটারের পার্থক্য থামে।
আরেকটা কথা, গ্রহাণুদের নাম মূলত দেবীদের নামে হয়ে থাকে যেমন : সেরেস, ভেস্তা, জুনো ইত্যাদি। কিন্তু এদের সংখ্যা এত বেশি হয়ে যায় যে, তা আর দেবীদের নাম দিয়ে কুলানো যায় নি। তাই অনেক প্রসেস করে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের পারমিশন নিয়ে কোনো জ্যোতির্বিদ যে গ্রহাণু আবিষ্কার করে তাঁরা তাঁদের পছন্দের নাম দেন। নামের সাথে নানা নাম্বার ও দেন। অনেক জ্যোতির্বিদরা নিজেদের নামের সাথে মিলিয়েও আবিষ্কৃত গ্রহাণুটির নাম রাখেন।
লেখকের কথা: হৃদয় হক
নাম: মো. সাজেদুল হক। ছদ্মনাম: “হৃদয় হক”। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখালিখি পছন্দের। লিখি, বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য।